হারানো শৈশব; কুড়ানো সেই সব!! (৬৪ তম পর্ব)

প্রকাশের সময় : 2019-09-26 12:14:12 | প্রকাশক : Administration
হারানো শৈশব; কুড়ানো সেই সব!! (৬৪ তম পর্ব)

ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীনঃ গোখরা সাপের কথা শুনে তৈয়্যব স্যার দৌঁড়ে এলেন। স্যারও খুব ভয় পেয়েছিলেন। কিন্তু দিয়েছিলেন অভয়। বলেছিলেন, “ওরে তোরা ভয় পাসনে্। এ তো বাংলাদেশ; সাপ আর নেউলের দেশ। ওসবকে ভয় পেলে কি চলে! ওসবের সঙ্গেই তো আমাদের জন্ম জন্মান্তরের বাস। দেখিস, তোদের কষ্টটা একদিন সার্থক হবে। তোরা কষ্ট করছিস বলেই স্কুলের জমিতে এত বড় দীঘিটা হচ্ছে। তোরা হাতে হাত দিয়ে কাজ করছিস বলেই অন্যের দখলকরা এত্ত এত্ত জমি স্কুল উদ্ধার করতে পেরেছে।

স্যার বলেছিলেন, এভাবে এগুতে পারলে একদিন স্কুলের রূপটাই আমরা পাল্টে দিতে পারবো। এসডিও (মহকুমা প্রশাসক) সাহেবের সাথে আমার কথা হয়েছে। তিনি স্কুলে সাউন্ড সিস্টেম দেবেন। সব ক্লাসে ক্লাসে সাউন্ডবক্স লাগাবো। ময়মনসিংহ জেলা স্কুল আর ধলা স্কুল ছাড়া এই সিস্টেম আর কেউ পাবে না। কত্ত বড় খুশির খবর আমাদের জন্যে! আমাদের সবগুলো ক্লাসরুম হবে আধুনিক। নতুন ব্ল্যাকবোর্ড আসবে। ভারী সুন্দর হবে স্কুল তখন।

হেডস্যার বলছিলেন আর কাঁপছিলেন। স্যারকে এতটা আবেগী সচরাচর হতে দেখিনি। দিন পর আমি আর থাকবো না। কেউই চিরদিন থাকে না। তোরাও থাকবি না। কিন্তু শতবর্ষী এই স্কুলটা থাকবে। যুগ যুগ ধরে থাকবে। আর থাকবে তোদের দায়িত্ব। মাতৃরূপী এই স্কুলের প্রতি তোদের জন্ম জন্মান্তরের দায়িত্ব। তোরা আসবি। পৃথিবীর যেখানেই থাকিস, তোরা আসবি। সারা পৃথিবী থেকে যত জ্ঞান আহরণ করবি, সবকিছু নিয়েই আসবি। আর সে সব জ্ঞান বিলিয়ে দিবি নতুন প্রজন্মের মাঝে। ভবিষ্যত প্রজন্মের তোদের ছোটছোট ভাইবোনদের মাঝে।

বলতে বলতে সেদিন স্যার কান্না লুকাতে পারেননি। কান্না আর স¦প্ন এমনি হয়। লুকিয়ে রাখা যায় না। কাউকে না কাউকে শেয়ার করতে হয়। আমি কাউকে শেয়ার করতে না পারলেও স্যারের বক্তব্যের প্রতিটি কথা সেদিন অন্তরে গেঁথে নিয়েছিলাম। শুধু তাই নয়; জীবনের ব্রত হিসেবেও নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আল্লাহ্পাক কোনদিন আমাকে সুযোগ দিলে স্কুলের উন্নয়নে শরীক হবো। জীবনের অর্জিত সব জ্ঞান বিলিয়ে দেব সমাজের সর্বস্তরে।

একদিন স্বপ্নের স্কুলকে গড়ার জন্যে নিজহাতে স্কুলের যে পুকুর কেটেছিলাম, বহু বছর পরে সুযোগ পেয়ে সেই স্কুলেই একের পর এক উন্নয়নমূলক কাজ করা শুর“ করলাম। দীর্ঘ প্রবাস জীবনের অর্জিত অর্থের কিছুটা দিয়েই শুরু করলাম। খুব যে অর্থ ব্যয় হয়েছে তা নয়। তবে কাজগুলো হয়েছে খুবই বড় এবং সামাজিকভাবে প্রশংসিত। এর সুফল ভোগ করছে শিক্ষার্থীর দল এবং এর ফলাফল রয়েছে আজো বিদ্যমান।

২০১২ সালে উদ্যোগ নিলাম কলেজ শাখা চালু করার। ১লা জুলাইতে অনুমতি পাবার আগেই সাহস করে কলেজের প্রথম ব্যাচ চালু করে দিলাম। মহা ধুমধামে নবীন বরণ হলো; আমরা রজনীগন্ধ্যার স্টিক দিয়ে সবাইকে বরণ করে নিলাম। একটা আনন্দ আনন্দ রব চারদিকে। ৩৪ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে কলেজ শুরু হলো। আমাদের আনন্দে এবার উদ্বেলিত পুরো ধলা গ্রাম। সেদিন একটা অদ্ভুত ব্যাপারও ঘটলো। মঞ্চে আমাকে অবাক করে দিয়ে একটা ক্রেস্ট হাতে ধরিয়ে দেয়া হলো এবং এই প্রতিষ্ঠানের আজীবন দাতা সদস্য করে বরণ করে নেয়া হলো। হঠাৎ করে আজীবন দাতা সদস্য করে দেবার ব্যাপারটা আজো আমার কাছে পরিস্কার নয়। আজীবন দাতা সদস্য হিসেবে আসলে আমার দায়িত্ব এবং কর্তব্য কী সেটা আজো আমি ঠিকভাবে বুঝতে পারছি না।    

না বুঝাটা আমারই ব্যর্থতা। তবে কেউ আমাকে ব্যাপারটা বুঝিয়েও দেয়নি এটাও সত্যি। তাই তেমন ভাবে না বুঝলেও অনেকটা অবুঝ বালকের মত ধলা হাই স্কুল নিয়ে বেশী বেশী করে ভাবা শুরু করলাম। এরই এক পর্যায়ে ডিসেম্বরের কনকনে শীতের সকালে আয়োজন করলাম বার্ষিক পরীক্ষার আনুষ্ঠানিক ফলাফল প্রকাশ। বেশ আনন্দঘন পরিবেশে দারুণ উপভোগ্য হলো দিনটি। যারা ভাল ফলাফল করলো তাদের পুরস্কৃত করলাম এবং সিদ্ধান্ত হলো, এখন থেকে প্রতি বছর এভাবে আনুষ্ঠানিকভাবে ফলাফল প্রকাশ করা হবে এবং যারা ১ম থেকে ৩য় হবে তাদেরকে নিয়মিত ভাবে পুরস্কার দিয়ে উৎসাহিতও করা হবে। স্কুলের শিক্ষার মানোন্নয়নে এই কাজটি বেশ ভূমিকা রাখবে বলে আমার মনে হয়েছিল সেই সময়টাতে।

এর মধ্যে চলে আসলো মার্চ, ২০১৩; প্রতিষ্ঠানের ১২০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর আয়োজন। আমি ভাবলাম এ তো সাংঘাতিক রকমের একটা ইজ্জতের ব্যাপার। এদিন বড় বড় মানুষেরা আসবে; মন্ত্রী আমলারা আসবে, আসবে স্থাানীয় নেতৃবর্গ। প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা আসবে, এলাকার গণ্যমান্য মানুষেরা আসবে। পুরো এলাকাবাসী চলে আসবে স্কুলের আঙিনায়। সবাই এসে যদি স্কুলের ভাঙাচোরা দৈন্যদশা দেখে তাহলে কী বলবে! একজন প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে এর দায়ভার তো আমিও এড়াতে পারি না।

আমার নিজেরও কিছুটা দায়ভার আছে মনে করে প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী আয়োজনের আগেই পুরো স্কুলের মেরামতসহ প্রয়োজনীয় নানাবিধ কাজে হাত দিলাম। অনেক জায়গায় টিনের চালা নষ্ট ছিল বলে বৃষ্টিতে পানি পড়ে ক্লাশরুম ভিজে যেত; ছেলেমেয়েদের খুব কষ্ট হতো। আমরা পুরোনো নষ্ট টিনগুলো বদলিয়ে নতুন টিন লাগালাম। সবগুলো টিনশেড রুমে সিলিং দিলাম যাতে গরমে ছেলেমেয়েরা কষ্ট না পায়। ভাঙ্গা দরজা জানালা সব নতুন করে বানালাম। আরো ৫০টি নতুন ফ্যান পাঠিয়ে দিলাম স্কুলে। চৈত্রের প্রচন্ড গরমে আমাদের ছেলেমেয়েদের কষ্টের কথা ভেবে এটা করলাম। এভাবেই শেষ করলাম যাবতীয় কাজ। এতে স্কুলটি অনেকটা নতুন সাজে সাজলো; কিছুটা সাবেক চেহারা ফিরেও পেল। ভাবলাম আজীবন দাতা সদস্য হিসেবে একটা কাজ অন্তত করা হলো।

প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী অনুষ্ঠানের ১ম দিনের সন্ধ্যায় মাঠ ভর্তি অগনিত মানুষের সামনে আয়োজকবৃন্দ আমাকে সম্মান দিয়ে বক্তৃতা দেয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন। এতো দর্শকের সামনে ফ্যাঁসফেসে গলায় কথা বলার ব্যাপারটা আমার জন্যে এত সহজ ছিল না। তারপরও সাহস করে এবং সহজ করে একদমে অনেক কথা বলে ফেললাম। নানান কথার মাঝে একটা স্বপ্নের কথাও বললাম। কলেজ শুরু হবার কারণেই আমার এই স্বপ্ন দেখা এবং সবাইকে সেই স্বপ্ন দেখানো।আমি বলেছিলাম একদিন বড় পরিসরে পরিচ্ছন্ন একটি কলেজ ক্যাম্পাস হবে। বড় বড় দালান উঠবে। খোলা খেলার মাঠ থাকবে; থাকবে মিলনায়তন ও জিমনাসিয়াম। লাইব্রেরী ও বিজ্ঞানাগার হবে; হবে শহীদ মিনার ও মুক্ত মঞ্চ। একপাশে থাকবে একটি নয়নাভিরাম মসজিদ; যেখান থেকে মুয়াজ্জিনের আযান ভেসে আসবে! একদিন কলেজ উন্নীত হবে বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছেলেমেয়েরা বাগান ঘেরা ধলা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছুটে বেড়াবে; মুক্ত মঞ্চে গাইবে গান। দৃপ্ত কন্ঠে নেবে শপথ; বড় হয়ে মানুষের মত মানুষ হবার শপথ!

একটা সুন্দর কলেজ ক্যাম্পাসের পাশাপাশি শিক্ষার মানোন্নয়নের কথাও বলেছিলাম। বলেছিলাম আমি এসব করবো কেবল আমার ২য় মা রূপী এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্যে; দুর্গতদের কোন আশ্রয় কেন্দ্রের জন্যে নয়। আমার উদ্দেশ্য ছিল এলাকার ছেলেমেয়েরা একটি চমৎকার পরিবেশে, শিক্ষায় আধুনিক মান সম্পন্ন একটি প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করে ওদের উজ্জল ক্যারিয়ার গড়বে, গড়বে চমৎকার ভবিষ্যত।

দেরী করিনি। অনুষ্ঠান শেষ করেই সবাইকে নিয়ে কলেজ অনুমোদন আনার প্রক্রিয়ায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম; দৌঁড় ঝাঁপ শুরু করলাম। মাত্র দেড় মাসের চেষ্টায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন মিলল। ৮ই জুলাই ২০১৩; কলেজ কোড পেলাম। ক্ষুদ্র এই জীবনে কম কিছু পাইনি। কিছু পাওয়ার আনন্দে উদ্বেলিতও হয়েছি বহুবার। কিন্তু কলেজ কোড পাওয়ার বিষয়টিতে কেমন আনন্দিত হয়েছিলাম কিংবা কতটুকু আবেগী হয়েছিলাম তা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়।

আনন্দে আমার চোখে পানি এসে গেল। আমি ধরে রাখতে পারলাম না; শত চেষ্টা করেও দু’ফোটা অশ্রুকে গাল বেয়ে নীচে নামতে না দিয়ে পারলাম না! আনন্দের কারণ এই ভেবে যে ১২০ বছরের ধলা উচ্চ বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন হয়ে গেল আমারই হাতে! এ যে এক ইতিহাস!! নতুন নাম দিলাম “ধলা স্কুল এন্ড কলেজ”। আজ চোখের জল কেবল আমাকে পরাজিত করেনি; পরাজিত করেছে এলাকাবাসীর এতদিনকার দূর্ভাবনা আর হতাশাকে; জয়ী হয়েছে সবার অদম্য ইচ্ছা শক্তি আর সব মানুষের হৃদয় নিঙরানো আকাঙ্খার। চলবে...

 

সম্পাদক ও প্রকাশক: সরদার মোঃ শাহীন
উপদেষ্টা সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম সুজন
বার্তা সম্পাদক: ফোয়ারা ইয়াছমিন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: আবু মুসা
সহ: সম্পাদক: মোঃ শামছুজ্জামান

প্রকাশক কর্তৃক সিমেক ফাউন্ডেশন এর পক্ষে
বিএস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড,
ওয়ারী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০ হতে প্রকাশিত।

বানিজ্যিক অফিস: ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
বার্তা বিভাগ: বাড়ি # ৩৩, রোড # ১৫, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
ফোন: ০১৮৯৬০৫৭৯৯৯
Email: simecnews@gmail.com