বিষয়টি ভাবা দরকার! ভাববে কি সরকার?
প্রকাশের সময় : 2019-10-09 18:25:30 | প্রকাশক : Administration
ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীনঃ বেশ আগের কথা। ঢাকা শহরের বর্জ্য আবর্জনা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যে সচিবালয়ে ঘোরাঘুরি করছি। দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। মাসে মাসে বিদেশ থেকে ঢাকা আসি আর প্রস্তাবনা নিয়ে ঘুরি। খানদানী দেশের নাম শুনে প্রথমে দেখা দেয় সবাই। যত্ন আত্নিক করেই দেখা দেয়। পরে তেমন মজা না পেয়ে আরেক জনকে দেখিয়ে দেয়। কিন্তু কেউই আসল পথ দেখায় না। দেশের বিদ্যুতের তখন খুবই নাজুক অবস্থা। এই আছে তো এই নেই। এমনি অবস্থায় প্রায় শুণ্য খরচের জ্বালানী দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন একটা চমৎকার প্রযুক্তি। তেল, গ্যাস লাগবে না; ময়লা আবর্জনা দিয়েই পাবো বিদ্যুৎ!
ঢাকা শহরের সব বাসাবাড়ী সহ ক্লিনিক এবং হাসপাতালের আবর্জনাকে সুষ্ঠভাবে সংগ্রহ করে সাভারের কাছাকাছি কোথায়ও নিয়ে ওসব পুড়িয়ে বিদ্যুৎ বানানো। ভাইরাস ব্যাকটেরিয়াযুক্ত বিপদজনক আবর্জনাও পুড়ে ছাই হবে, ঢাকা শহরও হবে অধিকতর স্বাস্থ্যসম্মত। আর বোনাস হিসেবে সস্তায়, একেবারে কম খরচে পাবো বিদ্যুৎ। এক কাজে এত কাজ আর কোথায় হয়! শুনে প্রথমে সবাই বাহ্বা দেয়। আরো শুনতে চায়। বেশী শুনতে চায় নিজের বেনিফিট। নিজের নয়, দেশের বেনিফিটের কথা শুনে চুপসে যায়। মুখ বিবর্ণ হয়। বিষয়টি বোঝা যায় মিটিং শেষের তাড়া দেখে। কিছু একটা বলে শেষ করতে হবে বিধায় আধুনিক প্রযুক্তির বিষয়ে নিজের সীমিত জ্ঞানের কথা বলে গাইগুই শুরু করে এবং প্রসঙ্গ এড়াতে চায়।
বাঙালী চাইলে কী না পারে! শেষ পর্যন্ত দারুণভাবে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যায়। এড়িয়ে যাবার কৌশলটাও দারুণ। আধুনিক প্রযুক্তির বিষয়ে জ্ঞান না থাকুক, আইনী জটিলতা এবং আমলাতান্ত্রিক মারপ্যাঁচের পান্ডিত্তে কোন কমতি নেই। আমাকে হাইকোর্ট জজকোর্ট সব দেখিয়ে একেবারে আমলাতান্ত্রিকভাবে এড়িয়ে যায়। বিদায় বেলায় আমি আর কিছু না বুঝি, কেবল এটুকু বুঝতাম, চেয়ার দখলে থাকা বড় কর্তাব্যক্তিটি আর কিছুতে পারদর্শী না হলেও ভাল মারপ্যাঁচ শিখে গেছেন; ভাল আমলা হয়েছেন।
বিসিএস আমলা। বিসিএস বিষয়টি আমার মাথায় তখন থেকেই ঘোরপাক খায়। তবে তেমন করে ঢোকেও না, বুঝেও আসে না। কেবলই আফসোস হয়। নিজে বিসিএস না করে উচ্চ শিক্ষার্থে দেশের বাইরে চলে যাওয়াতে আফসোস হয়। আফসোস করে যাচ্ছি আজ অনেক বছর ধরে। আমার শোনিমের তখন কেবল জন্ম। দেখতে দেখতে ও আজ প্রায় পনের বছরের বালক। এই এতদিনেও আফসোসটি যায়নি, আর বিষয়টিও আমার কাছে পরিস্কার নয়। কেবল এইটুকু বুঝি যে বাংলাদেশে কী ডাক্তার, কী ইঞ্জিনিয়ার; সবাই বর্তমানে বিসিএস নিয়ে ব্যস্ত।
এক বিসিএস পাশ তো সকল দুঃখ নাশ। অদ্ভুত বিষয়। বিসিএস পদ্ধতিতে ডাক্তার হয়ে যায় পুলিশ, ইঞ্জিনিয়ার হয় জজ। প্রাণীবিদ্যার শিক্ষার্থী হয় ম্যাজিস্ট্রেট। মনে হয় পৃথিবীতে এর চেয়ে চমকপ্রদ শিক্ষা পদ্ধতি আর কোথায়ও নেই।
আপনি চার বছর কোন এক বিষয়ে পড়াশুনা শেষ করে কেবল একটি পরীক্ষা দিয়েই ভিন্ন বিষয়ে ক্যারিয়ার গড়তে পারেন। বিসিএস আসলেই তো বিরাট ব্যাপার। চোখমুখ বন্ধ করে এত্ত এত্ত পড়তে হয়। সব মুখস্থ পড়া। আমার কাছে বিসিএস মানে “বিরাট সিলেবাসের সিস্টেম”। কার জন্মস্থান কোথায়, কার বাবার নাম কী, কে কবে কোন রাজ্য জয় করেছে, এগুলো পড়তে হয়, জানতে হয়। তবে এগুলো বিসিএস ক্যাডাররা পরবর্তিতে কোন্ কাজে লাগায় আমি জানি না। সাম্প্রতিক বিষয়াবলীর জন্য শত শত তথ্য পড়তে হচ্ছে; অথচ ২-৩ মাস পরই সেই সকল তথ্য মূল্যহীন। তাহলে পড়ে লাভটা কি হলো? পড়াটা আমি প্রয়োগ করলাম কোথায়? যেখানে বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থী বর্তমান রাষ্ট্রপতির নাম জানেনা, সেখানে ৫০০-১০০০ বছর আগে কে দেশ শাসন করেছে সেইটা পড়ে কোন কাজে লাগাবে?
এমবিবিএস পাস করার পরও সাধারণ জ্ঞান পড়তে হচ্ছে বিসিএস করার জন্য! রোগীর চিকিৎসার জন্য কার জন্ম কত সালে, কোন স্থানের পুরনো নাম কী, কোন পন্ডিত কত সালে দেশে এসেছেন, কে দেশের সুনাম করে গেছেন ইত্যাদি কি লাগে? কার কন্ঠে গাওয়া গান, কে কোন বই লিখেছেন, কোন দেশের মুদ্রার নাম কি, কোন দেশের রাজধানীর নাম কি কেউ মুখস্ত বলতে না পারলেই সে মেধাহীন? এক আজব দেশ!
ফিনল্যান্ডের রাজধানী কোথায়? রুয়ান্ডার মুদ্রার নাম কী? কোন্ লেখকের মৃত্যু সাল কত? কেউ এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারলেই ট্যালেন্টেড আর না পারলেই গোল্লা! আদৌ কি এগুলো ট্যালেন্ট বিচার করার অস্ত্র? আরো অদ্ভুত লাগে-কোন্ উপন্যাস কোন সাহিত্যিকের, কোন্ ছোটগল্প কোন্ লেখকের, কোন্ কাব্যগ্রন্থ কোন্ কবির এগুলো জেনে কি করব যদি সেই গ্রন্থগুলোই না পড়া হয়! লেখকরা এগুলো লিখে গেছেন পড়ার জন্য, জীবনে প্রয়োগ করার জন্য; নাম মুখস্থ করে রাখার জন্য নয় নিশ্চয়ই।
আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, এমন অযৌক্তিক আর বেমানান পড়াশোনা পৃথিবীর আর কোথাও হয় না। আমি বলছি না যে ইতিহাস, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সাহিত্য এগুলোর বিপক্ষে আমি। মানুষের জীবনে এগুলোর যথেষ্ট প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে সবার কেন সব বিষয় জানতে হবে? যার যে বিষয়ে ট্যালেন্ট সে সেই বিষয় জানবে। যার যে বিষয়ে আগ্রহ বেশি সে সেই বিষয়ে পড়াশোনা করবে।
কিন্তু এদেশে সে সুযোগ নেই। ভাল ক্যারিয়ার গড়তে চাইলে, সবচেয়ে সেরা ক্ষমতা সম্পন্ন চাকুরী করতে চাইলে আপনি শিক্ষা জীবনের চার বা পাঁচ বছরে শেখা বিশেষ বিষয়ের পড়াশুনা বাদ দিয়ে বাধ্য হবেন গাদা গাদা বই মুখস্থ করে একেবারেই সম্পর্কহীন তথ্য দিয়ে মাথার মগজ ভর্তি করে রাখতে। যা ভুলতে আপনার তিনমাসও লাগবে না। অথচ মাত্র তিন মাসের এই তথ্যজ্ঞান আপনাকে সবার চেয়ে জ্ঞানী বানাবে। আপনার ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিবে; বদলে দিবে ক্যারিয়ার। আপনার একাডেমিক শিক্ষার কোন মূল্যই থাকবে না!
আমি বিসিএস ক্যাডারকেও মুল্যহীন কিংবা অপ্রয়োজনীয় বলছি না। কেবল বলছি এই ক্যাডার হবার ভ্রান্ত এবং আজগুবি প্রক্রিয়াটি নিয়ে। আমি বিশ্বাস করি সরকার পরিচালনার জন্যে বিসিএস ক্যাডার অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং এই জন্যেই প্রক্রিয়াটি সুষ্ঠ পদ্ধতিতে সম্পন্ন করা প্রয়োজন। রাজনৈতিক সরকার তার সকল কর্মকান্ড পরিচালনা করে এই ক্যাডারদের হাত দিয়েই। তাই তাদের আলাদা রকমের হবার প্রয়োজন।
কিন্তু আলাদা রকম বানানোর নামে বাস্তবে যা হচ্ছে আমার আপত্তি ঠিক এই জায়গাটিতেই। বাস্তবতাটা আসলেই বাস্তবতা বিবর্জিত হচ্ছে বলেই ঠিক পনের বছর আগে দেশের জন্যে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বর্জ বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনার প্রস্তাবনাকে অবিশ্বাস্য কিংবা হাস্যকর মনে করে হালকাভাবে উড়িয়ে দিয়েছেন দায়িত্বশীলেরা। সঠিক মানুষদেরকে সঠিক পদ্ধতিতে সঠিক জায়গায় বসাতে না পারার কারণেই এটা হয়েছে। আর এতে বঞ্চিত হয়েছে জাতি, বঞ্চিত হয়েছে দেশ।
তাই এ থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। খুব তাড়াতাড়িই দরকার। অধিকাংশ বিশ্ব, বিশেষ করে ধনে এবং জ্ঞানে উন্নত বিশ্বের শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় মুখস্থ করার বিষয়টি নেই। আত্মস্থ করার বিষয় আছে। আত্মস্থ আর মুখস্থ এক বিষয় নয়। তাই মুখস্থ নির্ভর পড়াশুনা থেকে বিসিএস ক্যাডারদের যেমনি বেরিয়ে আসা দরকার, তেমনি দরকার পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা থেকেই মুখস্থ বিষয়টি উঠিয়ে দেয়ার। মুখস্থ বিষয়টি মানুষকে খুবই স্বল্প সময়ের জন্যে জানলেওয়ালা বানাতে পারে, দীর্ঘ সময়ের জন্যে পারে না। পারলে আইনস্টাইন নিজেও সব কিছু মুখস্থ করে চলতেন।
একবার বিজ্ঞানী আইনস্টাইন সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন। হঠাৎ এক সাংবাদিক প্রশ্ন করল, "স্যার, আপনি কি জানেন এক মাইলে কত কিলোমিটার?" আইনস্টাইন বললেন, "না, আমি জানি না।" সাংবাদিকটি সবিষ্ময়ে বললো, "সে কি ! আপনি এত বড় বিজ্ঞানী অথচ এটাও জানেন না?" উত্তরে আইনস্টাইন বললেন, "যে তথ্য রেফারেন্স বই ঘেঁটে দুই মিনিটের মধ্যে বের করা যায় সেই তথ্য মস্তিষ্কে জমা রাখতে যাব কেন? আমি মস্তিষ্ক ব্যবহার করি চিন্তাভাবনার জন্য; অর্থহীন জ্ঞানের গুদাম হিসেবে বানানোর জন্য নয়।"