হারানো শৈশব; কুড়ানো সেই সব!! (৩১ তম পর্ব)

প্রকাশের সময় : 2018-05-24 22:26:22 | প্রকাশক : Admin
�হারানো শৈশব; কুড়ানো সেই সব!! (৩১ তম পর্ব)

ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীনঃ স্যাররা এমনই হন। সব সময় ছাত্রের মঙ্গল কামনা করেন। সারাটা জীবন উপদেশ দিয়ে যান। ছাত্র আর সন্তানকে কখনো আলাদা করে দেখেন না। আলম স্যারও তেমনই। সেই যে ছেলেবেলা থেকে আলম স্যারের দোয়া পাওয়া শুরু করেছি; আজো পাচ্ছি! অকৃপণ ভাবে পাচ্ছি! পরম পূজনীয় এই মানুষটির স্নেহের পরশে ক্লাশ সিক্সের পূরোটা সময় পার করেছি। প্রথম দিকে একমাত্র তিনি এবং দীগেণ স্যার ছাড়া আর কেউ আমাকে তেমন জানতেন না; চিনতেনও না। সময় যত গড়িয়েছে কেউ কেউ চিনতে শুরু করেছেন বটে। তবে সংখ্যায় তেমন নয়। সাধারণত ছোট ক্লাশের কাউকে ঐ ক্লাশে ক্লাশ নেয়া শিক্ষক ছাড়া আর কোন শিক্ষক তেমন চেনেন না। আমিও ব্যতিক্রম ছিলাম না।

তবে দীগেণ স্যার ব্যতিক্রম। তিনি আলাদা ভাবে খুব করে চিনতেন। বাহার ভাইয়াকে বাসায় এসে পড়াবার সুবাদেই আমাকে চিনতেন। সরল সহজ এক অদ্ভুত রকমের ভাল মানুষ আমাদের দীগেণ স্যার। ভাইয়াকে পড়াতে এসে অপেক্ষায় বসে থাকতেন। ছাত্র ঘুমিয়ে আছে; তার ওঠার অপেক্ষায়। ঘন্টা পার হতো; ছাত্র জাগতো না, তিনিও যেতেন না। পরিবার নিয়ে থাকতেন স্কুল বোর্ডিং লাগোয়া বাসায়। ভারী কাঁচের চশমায় চোখ উঁচু করে সবাইকে দেখতেন। আর পড়াতেন অংক এবং বিজ্ঞান। ক্লাশ এইট পর্যন্ত পড়াতেন। সরল অংক নামের প্যাঁচগোছ মার্কা পাটিগণিতের অংক তাঁর কাছেই শেখা।

পাশাপাশি স্কুলের শরীর চর্চার বিষয়টিও স্যার দেখভাল করতেন। যদিও অফিসিয়ালি ফিজিক্যাল শিক্ষক ছিলেন রহমান স্যার। দুজনে মিলেই ওসব দেখভাল করতেন। দারুন মিল ছিল স্যারদের মাঝে। এখনকার মত রেশারেশি ছিল না। দীগেণ স্যার সকালের এসেম্বলী কিংবা পিটি ক্লাশ নিতেন। মাঝে মাঝে বিশেষ করে শীতের সকালে আয়োজন করতেন স্কাউট জাম্বুরীর। সাদা পেন্ট শার্ট আর জুতা মুজা পড়িয়ে পিটি করাতেন। কুইক মার্চ! লেফট রাইট লেফট!! বলে সারা মাঠ ঘুরিয়ে বেড়াতেন। ডাবল মার্চ বললেই আমরা ব্যাকরন মেনে ছন্দের তালে তালে দৌঁড়াতাম। শুধু কি দৌঁড়! স্যারের লেখা বয়সস্কাউট সংগীতও ছিল। পিটি শেষে প্রতিদিন কোরাসে গাইতাম সেই সংগীত। অপূর্ব কথার শ্র“তিনন্দন সুরটি কার করা ছিল জানা নেই। কিন্তু কথাগুলো এখনো ঠোঁটস্থ; আমরা বয়স্কাউট!  আমরা বয়স্কাউট! এই পৃথিবীর মানুষের বুকে আমরা জাগাবো প্রাণ। আমরা যেথায় গেয়ে চলি ভাই জাগরনি জয় গান! আমরা বয়স্কাউট!! আমরা বয়স্কাউট!!!

স্যারের লেখা আরো একটি গান ছিল। বরণ সংগীত। স্কুলের অনুষ্ঠানে অতিথি বরণের সংগীত। কাউকে বলতে হতো না। দীগেণ স্যার মনের গরজে সব করতেন। স্যার রিহার্সালে ডেকে নিজেই গলা ছেড়ে গাইতেন, তোরা কে দেখবিরে, দেখবি যদি আয়! ইন্সপেকটার সাব আসিয়াছেন স্কুলের আঙিনায়!! তোরা কে দেখবিরে!... আরে মুক্তাগাছার মন্ডারে ভাই, ধলার কাঁচা দই! মাখাইয়া খাইলে পরে এমন মজা কই! তোরা কে দেখবিরে দেখবি যদি আয়!!!

আর মাঠে টুর্নামেন্ট হলে তো কথাই নেই। হাফপেন্ট পড়ে জার্সি গায়ে তিনি মাঠে নামতেন রেফারিং করতে। মুখে বাঁশি ফুকিয়ে মাঠ কাঁপিয়ে বেড়াতেন। লম্বা মুজার স্পাইকের জুতা পায়ে তিনি যখন নামতেন মনে হত ঢাকার মাঠেই ফুটবল খেলা দেখছি। আসলেও তখনকার দিনে ধলা স্কুলের মাঠে ঢাকা স্টেডিয়ামের নিয়মত খেলোয়াড়রাই অংশ নিত। কেউ হায়ার করে আনতো আবাহনীকে, কেউ আনতো মোহামেডানকে। আবার সব দল থেকে বেছে বেছে খেলোয়াড়ও আনতো।

স্থানীয় বিভিন্ন এলাকা নিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ আয়োজন করতো “ষোড়শীবালা শিল্ড টুর্নামেন্ট”। ফুটবলের এক অনন্য টুর্নামেন্ট। চারদিকে সাজ সাজ রব পড়তো। যেনতেন নামে নয়, জমিদার বাবুর স্ত্রীর নামে এই শিল্ড। সাড়ে সাত কেজি ওজনের রুপার শিল্ড অত্র এলাকার অন্য কোথায়ও নেই। যেমন দেখতে সুন্দর, তেমনি ওজনে। এই ওজনটাই ছিল এর বড় বৈশিষ্ট্য। ভাবলে আজো শিহরণ জাগে মনে!

শিহরণ খেলাতেও জাগতো। অবশ্য প্রতিদিন খেলা থাকতো না। সপ্তাহে দু’দিন খেলা হতো। বাকী দিনগুলোতে মাঠে এলাকার বড় ভাইয়েরা খেলতেন। আমাদের খেলার জায়গা হতো প্রাইমারীর মাঠে। ছোট্ট মানুষদের জন্য ছোট্ট মাঠ। আমি ঠিক খেলতাম না, খেলা শিখতাম। বল ছাড়াই শিখতাম। বাজারের দর্জির দোকান থেকে ফেলে দেয়া ছিট কাপড়ের ছোটছোট অনেকগুলো পিস এনে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বল বানাতাম।

এই বল এর সমস্যা হলো পানিতে পড়ে গেলে সব শেষ। ভিজে টুপু টুপু। তাই বেটার ছিল জাম্বুরা।  পানিতে পড়–ক বা না পড়–ক, সমস্যা ছিল না। সমস্যা ছিল জাম্বুরা জোগাড় করা নিয়ে। চুরি করে জাম্বুরা জোগাড় করা খুব কঠিন ছিল। মাঠের পাশের খালেক প্রফেসার সাহেবের বাসার গাছের মোটামুটি সাইজের একটা জাম্বুরা নানা ফন্দি ফিকির করে চুরি করতে পারলে দিন তিনেক নিশ্চিন্তে খেলতে পারতাম। একেবারে লুতা হয়ে গেলে আর পারতাম না।

এই জাম্বুরার কারণে কিনা জানি না, আব্দুুর রহমান স্যার ক্লাশে ঢুকেই আমাকে জাম্বুরার বাপ বলে ডাকতেন। একেক সময় একেক অদ্ভুত নামে তিনি ডাকতেন! স্যারের আচরণই ছিল অদ্ভুত। সব সময় অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ বানাতেন। মুখে ভেংচি কেটে দাঁতে কিটিমিটি দিয়ে বলতেন, এই জাম্বুরার বাপ! বই লইয়া আয়। তাড়াতাড়ি আয়। লেহাপড়ার খবর নাই! খালি খেলা আর খেলা। এই খেলা তোরে খাইবো। পরীক্ষায় ডাব্বা মাইরা খাব্বা খাবি তুই!

খাব্বা শব্দের অর্থ আমি এখনো জানি না। কোনদিন জানার চেষ্টাও করিনি। কিন্তু স্যার চেষ্টা করেছিলেন আমার বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট জানার। ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট হবে। আমরা ক্লাশ সিক্সের শিক্ষার্থীরা বসে আছি দক্ষিণের টিনশেডের একেবারে পূর্বদিকের ঘরে। বিভিন্ন প্রাইমারী স্কুল থেকে ফার্স্ট হয়ে আসা শিক্ষার্থীরা খুব আশায় বসে আছে হাইস্কুলেও ফার্স্ট হবে।

আশার সময় আর শেষ হয় না! এক পর্যায়ে সব স্যারদের সাথে নিয়ে হেড স্যার এসে পিনপতন নিরবতার মাঝে প্রথমস্থান অধিকারীর নাম ঘোষনা করলেন। সবাই এদিক ওদিক তাকিয়ে ছাত্রটিকে  খুঁজছে; কিন্তু পাচ্ছে না। আবার নাম ঘোষনা করলেন। একেবারে পেছনের বেঞ্চে বসা পিচ্চি সাইজের এই আমি এবার দাঁড়ালাম। কিন্তু সামনে থেকে দেখতে সমস্যা হচ্ছে বিধায় রহমান স্যার জোরে জোরে বলছেন, জাম্বুরার বাপ! তোরে দেহা যায় না! তুই বেঞ্চের উপ্রে খাড়া। সবার হাসির মাঝেই আমি দাঁড়ালাম। কিন্তু স্যার হাসলেন না! কাছে এসে বেঞ্চ থেকে নামিয়ে কপালে একে দিলেন চুমু। ভালবাসা এবং দোয়ায় মাখা জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চুমু!!

চুমু বেশী দিতেন আমার মা। সেদিন ফার্স্ট হয়ে বাসায় ফেরাতে অনেকগুলো চুমু দিলেন। একেকটা চুমু দেন আর হাত দিয়ে আমার মুখ মুছে দেন। মায়ের চুমু আমি অহরহ পেতাম। আমার কাজেকর্মে খুশী হয়ে মা চুমু দিতেন। কেবল পড়াশুনায় নয়, আমি মোটামুটি সব কাজেই পটু ছিলাম। বিশেষ করে বাজার করার কাজে। মোটামুটি কিছুটা কমদামে বাজার করতে পারতাম বলে আম্মা খুব খুশী থাকতেন সব সময়। দাম কম কিন্তু জিনিস ভাল এবং পরিমানে বেশী; এটাই ছিল আমার বৈশিষ্ট্য। মাকে খুশী করার আশায় আমিও চেষ্টায় থাকতাম সর্বদা।

একবার পরিমল দাদার ভাই ভুলু দাদার পানের দোকান থেকে পান সুপারী কিনছি। দাদা গুণে গুণে পান দিচ্ছেন। কিন্তু পানপাতায় ময়লা থাকাতে সবগুলো পান নিয়ে গেলেন টিউবওয়েলের কাছে ধোয়ার জন্যে। ছালায় বিছানো থরে থরে সুপারীতে সাজানো দোকানে পাহারায় রেখে গেলেন আমাকে। বিশাল সুযোগ! আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে পটাপট বেশ কয়েকটা সুপারি পকেটে পুরে নিলাম। মনে বড় আশা আজকে আম্মা খুব খুশী হয়ে আমাকে এত্ত এত্ত চুমু দেবেন।

আম্মা মহা খুশী। অল্প টাকায় এত বেশী সুপারী দেখে আমাকে আবারো টাকা দিয়ে বললেন, যা! বাজারে গিয়ে আরো কিনে নিয়ে আয়। আমার কলিজায় কামড় পড়লো। জাতি সাপের কামড়। অবস্থা খুবই বেতাল। সব চিচিং একেবারে ফাঁক হয়ে যাচ্ছে। কম টাকায় ভাল বাজার করার তেলেসমাতি আজকেই শেষ। খুলে না বলে উপায় নেই। অগত্যা সত্যি কথা খুলে বললাম। কথা শেষ হতে পারেনি। মা আমার হঠাৎ অচেনা হয়ে গেলেন! শুরু করলেন ধোলাই দেয়া। কথায় কথায় চুমু দেয়া মা আমার কথায় কথায় চটকানা দিচ্ছেন। থামাথামি নেই; চটকানা দিয়েই চলেছেন। চলবে....

 

সম্পাদক ও প্রকাশক: সরদার মোঃ শাহীন
উপদেষ্টা সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম সুজন
বার্তা সম্পাদক: ফোয়ারা ইয়াছমিন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: আবু মুসা
সহ: সম্পাদক: মোঃ শামছুজ্জামান

প্রকাশক কর্তৃক সিমেক ফাউন্ডেশন এর পক্ষে
বিএস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড,
ওয়ারী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০ হতে প্রকাশিত।

বানিজ্যিক অফিস: ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
বার্তা বিভাগ: বাড়ি # ৩৩, রোড # ১৫, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
ফোন: ০১৮৯৬০৫৭৯৯৯
Email: simecnews@gmail.com