উপমহাদেশ কোন্ পথে!!
প্রকাশের সময় : 2020-01-16 17:13:50 | প্রকাশক : Administration
ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীনঃ খেলা আমার শোনিমের খুবই ফেভারিট। সব সময়ই খেলতে চায়। কেবল বিশেষ বিশেষ খেলা নয়, একটা হলেই হয়। সুযোগ পেলেই শুরু করে দেয়। আর ক্রিকেট, ফুটবল হলে তো কথাই নেই। শোনিম যত না এসব খেলা দেখতে আগ্রহী, তার চেয়ে ঢের বেশী আগ্রহী সেসব খেলা খেলতে। আমি ঠিক অতটা না। ওর মত না। এক সময় না খুব খেলতাম, না এখন খুব খেলা দেখি। দেখি না বললেই চলে।
তবে তরুণ বয়সে তেমন ছিলাম না। পাগল ছিলাম। আমি একা না; দেশের সব মানুষ তখন পাগল। ফুটবলের কঠিন পাগল। একদিন ক্রিকেট আসলো। আমরা বুঝতে শুরু করলাম। এবং মজাও পেতে শুরু করলাম অল্প অল্প করে। বাংলাদেশের জাতীয় পর্যায়ে ক্রিকেট তখন একেবারেই সীমিত মানুষের খেলা। এলিটদের খেলা। বিদেশী দল কালেভদ্রে দেশে এলেও তাদের নিয়ে তেমন হৈচৈ নেই। তাদের আনাগোনা যত না স্টেডিয়ামে আলোচিত, ঢের বেশী আলোচিত ছিল হোটেল সোনারগাঁয়ে।
কারণও ছিল। ওখানে ক্রিকেটারদের নিয়ে মুখরোচক নিউজ পাওয়া যেত। যেত রমণীদের আনাগোনা। এই লাইনে একনাম্বারে ছিলেন আজকের পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। (যাকে বাংলাদেশের একশ্রেণীর মানুষ সাচ্চা মুসলিম মনে করেন এবং তার হাতে ঝান্ডা তুলে দিয়ে ইসলামী বিশ্বের চমৎকার নেতা বানাবার স্বপ্নে বিভোর।) রমণীদের নিয়ে ইমরান খানের বেলাল্লাপনা তখন সকল সীমানা ছাড়িয়ে যেত। তিনি এসবকে কখনো কেয়ারও করতেন না। বাংলাদেশকে কখনো বিদেশও মনে করতেন না। মনে করতেন নিজের দেশ। তখন সময়টাও তেমন ছিল। আশির দশক। বাংলাদেশে পাকিস্তানীদের স্বর্গরাজ্য।
আশির দশকে চট্টগ্রামে এসেছিলো পাকিস্তান ক্রিকেট টিম। বিমানবন্দরে নেমেই বাংলাদেশ নিয়ে ঠাট্টা মশকরা, ফুল, জাতীয় পতাকা পায়ে দলা এসব শুরু করেছিলো ইমরান বাহিনী। পরে পরিস্থিতি এতোটাই উত্তপ্ত হয়ে পড়েছিলো যে একদল তরুণ স্টেডিয়ামে চেয়ার দিয়ে পিটিয়ে তাদের ঠান্ডা করতে বাধ্য হয়েছিলো। পাকিস্তানের এক মেজর আমাদের এক অফিসারকে কলার চেপে ধরেছিলো জাতিসংঘের সদর দপ্তরের সামনে। নব্বই দশকের এই ঘটনায় বাংলাদেশি গায়ের জোরে পারেননি। কিন্তু পরদিন বাংলাদেশিরা জুতা নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন পাকিস্তানিকে ধরার জন্য।
পাকিস্তানে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের কবর ছিল। ৭১ থেকে ২৬ বছর ছিল। ২০০৬ সালে সে কবর ঢাকায় আনা হয়। কিন্তু জানেন তো কী লেখা ছিল সে কবরে? পাকিস্তানের চতুর্থ শ্রেণীর কবরস্থানের সে কবরে ‘গাদ্দার’ লিখে ফলক লাগিয়ে দিয়েছিল পাকিরা। আর আমরা? পাকিদের রেখে যাওয়া উচ্ছিষ্ট ছানাপোনা, দালাল, যুদ্ধাপরাধীদের কবরে লিখি শহীদ। কেবল কবরে নয়; সেদিন একটি পত্রিকাও বড় বড় হরফে শহীদ লিখে প্রচার করেছে।
সন্দেহ নেই এরা পাকি দালাল। মুখে ভারত বিরোধীতা করে এরা বাংলাদেশপ্রেমী সাজে। মূলত এরা অন্তরে পাকিস্তানকে লালন করে; এরা সাক্ষাত পাকিস্তানের দালাল। এদের অন্তরে বাংলাদেশের কোন জায়গা নেই। আপাদমস্তক এরা বাংলাদেশ বিরোধী। ঠিক উল্টোটাও আছে। মুখে পাকিস্তানের বিরোধীতা করে বাংলাদেশপ্রেমী সাজার প্রচুর মানুষ আছে। মূলত এরাও সাক্ষাত ভারতের দালাল। এদের অন্তরে বাংলাদেশের কোন জায়গা নেই। আপাদমস্তক এরাও বাংলাদেশ বিরোধী।
দুঃখজনক হলো এই দুই গ্রুপের সংখ্যা এবং যাতাযাতিতে সত্যিকারের বাংলাদেশপ্রেমীরা ভালমন্দকে আলাদা করতে পারছে না। প্রকৃত বাংলাদেশপ্রেমীদের আইডেন্টিফাই করতে পারছে না। করবে কিভাবে? এরা কঠিন বর্ণচোরা। দেশ হিসেবে ভারত-পাকিস্তান নিজেরাও বর্ণচোরা আচরণ করে প্রকৃত বাংলাদেশপ্রেমীদের বিভ্রান্ত করে। কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতের বিতর্কিত সিদ্ধান্তে পাকিস্তানের ভূমিকায় মনে হয় সাচ্চা মুসলিমপ্রেমী জাতি। কিন্তু ৭১ পর্যন্ত মুসলিম বাঙালীদের প্রতি ওদের এজিদী শাসনামলের কথা এখনও বিশ্ববাসী জানে।
বাঙালী মুসলিমদের প্রতি ওদের ব্যবহার বুঝতে হলে পেছনে যেতে হবে না। সারাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা পাকিস্তানী কমিউনিটিতে গেলেই ওদের বিশ্রী চেহারা দেখা যাবে। আজও ওরা বাঙালী মুসলিমকে মানুষ মনে করেনা। কিন্তু দরদ উপচে পরে কাশ্মিরী মুসলিমদের প্রতি। এ কথাটি যেমনি সত্যি, তেমনি এটা সত্যি যে, ভারত এই উপমহাদেশে বেশ কিছুদিন যাবত পরিকল্পিতভাবে যে মরণ খেলায় নেমেছে তারও শুরু কাশ্মিরীদের স্বায়ত্তশাসন হরণ করা দিয়েই। তারপর একে একে আর ধাপে ধাপে এগিয়েছে। বিভিন্ন নদীতে মরণবাঁধ দিয়ে বাংলাদেশকে গলা টিপে মারার উদ্যোগ নিয়েছে সেই ১৯৬৪ সালে। তারপর আর থেমে থাকেনি। বাঙালীদের প্রতি ভারতীয়দের প্রকৃত মনোভাব বোঝার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো ক্রিকেট। ক্রিকেটে ওরা নিজেদেরকে লুকিয়ে রাখতে পারেনি। তবে ওদের আচরণ সবচেয়ে বেশী উম্মোচিত হলো নাগরিকত্ব বিল এবং নাগরিকপঞ্জি নিয়ে। ভারত এখন উম্মাদ হয়ে গেছে।
নাগরিকত্ব বিল এবং নাগরিকপঞ্জি নিয়ে ভারত এখন উত্তাল। ভারতের বিজেপি মনে করছে, নাগরিকত্ব বিল এবং নাগরিকপঞ্জির মাধ্যমে তারা বাংলাদেশকেও চাপে রাখতে পারবে। আর বিরোধী কংগ্রেসও স্বীকার করেছে “বিজেপি ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য” এই বল প্রয়োগ করেছে। এর ফলে হিন্দুত্ববাদের উত্থান ঘটবে এবং মুসলমানসহ ভারতের সংখ্যালঘুরা আস্তে আস্তে দেশ ত্যাগ করবে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা করছেন আরো ভিন্ন হিসেব। তারা বলছেন নাগরিকত্ব বিল এবং নাগরিকপঞ্জির সবচেয়ে বেশি চাপ সহ্য করতে হবে বাংলাদেশকে। প্রথমত বিজেপি সরকার মনে করছে বাংলাদেশে যে অর্থনীতির উন্নতি হচ্ছে সেই অর্থনীতির উন্নতি ভারতের কোন কোন ক্ষেত্রে অস্বস্তির কারণ। সেইজন্য বাংলাদেশকে চাপে রেখে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিধারাকে বাধাগ্রস্থ করার একটা কৌশল ভারত নিয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছে।
দ্বিতীয়ত বাংলাদেশকে দর কষাকষি করার ক্ষেত্রে দূর্বল করাও চাপে রাখার একটি কারণ। বাস্তবে দেখা যায়, সম্পর্ক ভালো করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যতটা উদার এবং দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে যতটা ছাড় দিয়েছে, ভারত ততটা করেনি; ততটা ছাড় দেয়নি। অনেক অনেক বিষয়ে ভারত সমস্যার সমাধান এড়িয়ে গেছে কিংবা যাচ্ছে। এখন এই নাগরিকপঞ্জি এবং নাগরিকত্ব বিলের ফলে বাংলাদেশ কথা বলারই সময় পাবে না । সময় কেটে যাবে নাগরিক অধিকার নিয়ে কথা বলতে বলতেই।
তৃতীয়ত বাংলাদেশকে চাপে রাখার একটা বড় কারণ হচ্ছে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক। বাংলাদেশ বিভিন্ন অর্থনৈতিক বিষয়ে চীনের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক তৈরী করেছে। বিশেষ করে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ডে চীনের ঠিকাদারী ভালো চোখে দেখছে না ভারত। আর এজন্যই বাংলাদেশকে একটি চাপে রাখলে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক কমিয়ে ফেলতে বাধ্য হবে বলে কূটনৈতিকরা মনে করছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, একদিকে আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব আর উপমহাদেশে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা; এই দুই লক্ষ্য নিয়েই করা হয়েছে নাগরিকত্ব বিল এবং নাগরিকপঞ্জি। তবে ফল হলো উল্টো। ভারত নিজেই এতে উত্তপ্ত হলো আর অস্থির হলো বাংলাদেশ, পাকিস্তান আর অফিগানিস্তানসহ পুরো ভারতীয় উপমহাদেশ। অসাম্প্রদায়িক ভারতের নেতৃত্বে পুরো উপমহাদেশই এখন সাম্প্রদায়িক উম্মাদনায় ভাসছে।
এককালে সারাবিশ্বে অসাম্প্রদায়িক তথা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের চমৎকার উদাহরণ ছিল ভারত। দুঃখজনক হলো, ৭২ বছরের সেই আচরণ থেকে ভারত ক্রমান্নয়ে সরে এসে সমগ্র উপমহাদেশে একটা কঠিন অস্থিরতার সৃষ্টি করলো। অথচ এককালে অসাম্প্রদায়িক শব্দটা পাক-ভারত উপমহাদেশে খুবই জনপ্রিয় একটি শব্দ ছিল। বিশেষ করে ব্রিটিশ আমলে। ব্রিটিশরা অনেক ব্রিটিশগিরী করলেও অন্তঃত এই একটি কাজ ভাল করেছিল। ভারতবর্ষকে অসাম্প্রদায়িক রাখতে চেষ্টা করেছিল।
ব্রিটিশরা এদেশে অনেক কিছু নিয়ে অনেক চেষ্টাই করেছে। অনেক কিছু চাপিয়ে দিতে চেয়েছে। তবে ওদের কোন রকম চেষ্টা ছাড়াই এদেশে দুটি নেগেটিভ শব্দ চালু হয়েছে। একটি ব্রিটিশ আর একটি ইটিশপিটিশ। ওদের খাসিলতের কারণে যথার্থভাবেই এমনটি চালু হয়েছে। তখনকার দিনে একাধিক ব্রিটিশ প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে শলাপরামর্শ করলে সাধারণ মানুষ দূর থেকে বলতো, “এইবার খবর আছে। ঐ যে দেখ্, ব্রিটিশরা ইটিশপিটিশ করতাছে।”
দিন বদলের পালায় শব্দটি এখন আর সেই অর্থ বহন করে না। কালের বিবর্তনে শব্দটির অর্থ বদলে গেছে। কিন্তু মূল ভাব বদলায়নি। মূল ভাব এখনো বিদ্যমান। আজ ভারতের অমিতবাবুরা বাংলাদেশসহ আশেপাশের দেশগুলোকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে যে ইটিশপিটিশ শুরু করেছে, তার ফলাফল বড়ই ভয়ানক। শেষ পরিণতি কি হয় কেউ জানে না! আর শেষ পর্যন্ত উপমহাদেশের সম্প্রীতি কোথায় গিয়ে ঠেকে তা একমাত্র আল্লাহই মালুম!!!