করোনা দিনের ডায়েরি...

প্রকাশের সময় : 2020-09-03 17:42:41 | প্রকাশক : Administration
করোনা দিনের ডায়েরি...

১ম পর্ব

প্রথম থেকেই আমার শোনিম বিপদসীমার মধ্যেই ছিল। চারদিকে থমথমে পরিবেশের মাঝে সকল সময় আতঙ্কে থাকাটা বিপদজনক তো বটেই। কেবল বিপদ নয়, মহাবিপদে আমারও থাকার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে তখনও ভাইরাসটি হানা দেয়নি বলে দেশবাসীর সাথে আমিও আপাত বিপদমুক্ত ছিলাম। শোনিম ছিল না। মোটেও বিপদমুক্ত ছিল না। ওর দেশে ভাইরাসটি আগেই ঢুকে পড়েছে। প্রচন্ড ঠান্ডার দেশে মরণঘাতক করোনার ঘাঁটি গেড়ে বসতে সুবিধে অনেক। তাই বিপদটা বেশিই ছিল।

আমি যখন ঢাকা ছাড়ি, তখনও দেশ আমার বিপদমুক্ত। বিপদমুক্ত পুরো দেশবাসীও। আমি জেনেশুনেই এমন মুক্ত হাওয়া ছেড়ে বিপদের দিকে রওনা দেই। এটাই বাস্তবতা। ছোট্ট শোনিমকে বিপদভূমিতে রেখে বিপদমুক্ত পরিবেশে কোন বাবা কি থাকতে পারে! পারে না! কোন বাবাই পারে না! সবার মত সাধারণ বাবা বলে আমিও রওনা দিয়েছি। কিন্তু যাত্রাপথ সুখকর ছিলনা। শোনিমের জন্যে সারাটা পথ খুব আতঙ্ক আর ভয় নিয়েই কেটেছে আমার। না জানি কী হয়, না জানি কী দেখবো ওই দেশে পৌঁছে; এই ভাবনাতেই কেটে যায় যাত্রাপথের পুরোটা সময়।

ল্যান্ডিংয়ের পর খানিকটা অবাকই হই। অনেকদিন ধরে দেখা এয়ারপোর্টের সাথে আজকের পোর্টের কোন পার্থক্যই তো নেই। সবকিছুই স্বাভাবিক মনে হলো। যেন ঠিক আগের মতই চলছে। এয়ারপোর্টের পরিবেশ দেখে আমার মনেই হয়নি এদেশেও করোনা বাসা বেঁধেছে। সবই ছিমছাম, পরিপাটি। কোন পরিবর্তন নেই। নেই শঙ্কিত পরিবেশ। তবুও শঙ্কিত মনে শতশত মানুষের ভিড়ে আমার চোখ কেবল দুটো চোখ খুঁজছে। যে চোখদুটো দেখার আশায় সারারাত আমার দুটো চোখের পাতা এক করতে পারিনি।

শোনিম খুব স্বাভাবিক ভাবেই আছে। হাসিমাখা মুখে এয়ারপোর্ট এরাইভ্যালে আমাকে নিতে এসেছে। একা আসেনি। সাথে করে আজ মাকেও নিয়ে এসেছে। গলায় লাল মাফলার পেঁচানো হালকা সুয়েটার গায়ে টিনএজার শোনিম। বড় চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে আর হাসছে। অবাক হলাম ওর মুখে মাস্ক না  দেখে। শুধু শোনিম কেন, একটি মানুষ খুঁজে পাইনি  যে বা যিনি মাস্ক পড়ে আছেন। রাস্তাঘাট, দোকানপাট, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সবই কোলাহলময়। অথচ কমবেশী প্রায় দেড়শতাধিক মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এদেশে। আর প্রতিদিনই আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। ইতিমধ্যে একজনের মৃত্যুও হয়েছে।

সংখ্যায় একজন হলেও মৃত্যুটি মানুষকে আতঙ্কিত করেছে। মৃত্যুকে কে ভয় না পায়! তাই সতর্ক হয়েছে। কিন্তু এলোমেলো হয়ে যায়নি। মাস্ক কেনার জন্যে হুমরি খেয়ে দোকানের সেলফ খালি করে ফেলেনি। সবাই মিনিমাম মাত্রায় মাস্ক কিনেছে যেন অন্যরা এসেও কিনতে পারে। কেননা দরকার তো সবার। আবার বেঁচে থাকার জন্যেও তো সবাইকে দরকার। এটা সত্যি, সকলেই ভালো থাকতে চায়, সুস্থ থাকতে চায়। কিন্তু স্বার্থপরের মতো একা বাঁচতে গেলে বিপদের সম্ভাবনাও বেশি। ধরুন আপনি একাই সুস্থ আছেন। তাতে আপনার মৃত্যুর সম্ভাবনা বাড়বে। কারণ সবার শেষে একদিন আপনাকে যখন করোনা ধরবে, তখন সেবা করার লোক থাকবে না। এই পৃথিবীতে একা একা কোনভাবেই বেঁচে থাকা যায় না। বাঁচতে হলে সবাইকে লাগে। সবাইকে নিয়েই বাঁচতে হয়।

এসব বিবেচনা না করে বাজারের সব মাস্ক এবং সাবান আপনি একাই কিনে সাবার করে ফেললেন। ভেবেছেন এতে করে আপনি বেশি নিরাপদে বাঁচবেন! মোটেই তা নয়। বরং মাস্ক না থাকা আপনার চারপাশের সবার দেহে ভাইরাস থাকবে। কারণ তাদের স্যানিটাইজার নেই। সাবান নেই। তখন আরও বেশি করে ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। তাই মাস্ক, টয়লেট পেপার বা সাবান মজুদ করলে লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণই আপনার বেশি।

লাভ ক্ষতির কথা না হয় বাদই দিলাম। বাদ দিলাম মাস্কের কথাও। কেননা, কোন কোন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, সুস্থ লোকের মাস্ক পড়ারই দরকার নেই। যার হাঁচি কাশি আছে কেবল তিনি মাস্ক পড়বেন। আর সতর্ক থাকবেন। যেন ব্যবহৃত মাস্কটি সঠিক জায়গায় ফেলা হয়। যেখানে সেখানে থুথু ফেলা, হাঁচি কাশি দেয়া ঠিক নয়। নিয়ম মেনে নাক মুখ কনুই দিয়ে ঢেকে হাঁচি দিতে হবে। মেনে চলতে হবে পরিচ্ছন্নতা। হাত দিয়ে মুখ স্পর্শ করা, নাক খোঁচানো, এসব মোটেই ঠিক নয়।

অহেতুক বেশি বেশি ভয় পাওয়াও ঠিক না। অন্তত পরিসংখ্যান তো তাই বলে। এই রিপোর্ট  লেখা পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসে মোট মৃত্যু হয়েছে ৪,২৫৮ জনের। আর শুধু বাংলাদেশে ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছেন ৫,২২৭ জন। কোনটা বেশী ভয়াবহ? এদিকে ঢাকায় কোটি  কোটি ডেঙ্গু মশা। কাকে কামড়ায়নি এই ভয়ানক মশা? কে কামড় খায়নি? কিন্তু সবার কি ডেঙ্গু হয়েছে? হয়নি। হলে মহামারী লাগতো। ডেঙ্গু  যেমনি সবার হয়নি, তেমনি করোনায়ও সবার আক্রান্ত হবার কথা না। তাই ভয় না পেয়ে আল্লাহর উপর ভরসা রাখা দরকার। দরকার নিয়ম মেনে চলার।

সমস্যা হলো, আপনি না হয় নিয়ম মেনে চলবেন; সতর্ক হবেন। অতিরিক্ত নয়, হিসেব করেই মাস্ক কিনবেন। কিন্তু এই সমাজ তো হিসেব করে লোভ করে না। লাভ করে না। লাভ এবং লোভ করার ক্ষেত্রে ভয়াবহ রকমের বেহিসেবী হয়। ঢাকা শহরের আনাচে কানাচে মাস্ক বিক্রেতার দল ভয়ানক লোভ করে মজুদদারী করলো এবং দাম বাড়িয়ে বাজারে ক্রাইসিস করে দিল। কী অবলীলায় মাস্ক, স্যানিটাইজার মার্কেট থেকে আউট করে দিলো? কিন্তু কেন? কেন দরকারের সময় দাম বাড়বে? ২০ টাকার মাস্ক কেন ৫০ টাকা হবে?

একবার জাপানে মুলা চাষ করে একজন কৃষক ব্যাপক লাভবান হয়েছেন। জমির অর্ধেক মুলা বিক্রি করতেই কাঙ্খিত লাভ উঠে আসে। তাই কৃষক সিদ্ধান্ত নিলেন বাকি অর্ধেক বিক্রি না করে জমি সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেবেন। যেন সবাই বিনা মূল্যে প্রয়োজন মতো নিতে পারেন। কিন্তু দেখা গেল, কেউ একটির বেশি মুলা নিচ্ছে না। কারণ কারও এর অতিরিক্ত প্রয়োজন নেই। লোকেদের যখন প্রশ্ন করা হয় মাত্র একটি নিচ্ছেন কেন? জবাবে তারা বলেন, অন্য লোকদের নেওয়ার সুযোগ দিতে চাই।

ঠিক বিপরীত চিত্র বাংলাদেশে। এদেশে রাতে  ঘোষণা দেওয়া হলো তিনজন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। আতঙ্কিত না হয়ে সবাইকে পরিষ্কার থাকা ও বাইরে মাস্ক পরিধান করে চলাচল করতে বলা হলো। অথচ রাতেই মাস্ক উধাও! রাতের ভেতর  দেশের বাজারে মাস্ক সংকট! মহা সংকট। দুটো সংকট একসাথে হলো। একটি প্রাকৃতিক, অন্যটি কৃত্রিম; মানুষের তৈরি। আমরা চাইলেই প্রকৃতির সঙ্গে পেরে উঠতে পারি। কিন্তু মানুষের সঙ্গে  কোনোভাবেই পারি না।

এককালে এ বাংলায় মানুষ ছিল মানুষের জন্যে। আজও মানুষ মানুষেরই জন্যে। তবে উপকারের জন্যে নয়; ক্ষতির জন্যে। অবস্থান ঠিক রেখে কেবল লক্ষ্যটি পালটে দেয়া হয়েছে মাত্র। সৃষ্টির আদিকাল  থেকেই মানুষের ক্ষতি মানুষ যতটা করতে পেরেছে, অন্য কোন প্রাণী ততটা করতে পারেনি। আজো করোনা যতটা করতে পারবে, মানুষ করছে তার চেয়ে ঢের বেশী। কী না পারে মানুষ! মানুষের জীবন নিয়েই মানুষ ব্যবসা করছে। জীবনকে জিম্মি করে ব্যবসা! কত অবলীলায় করে যাচ্ছে। আর ভুলে যাচ্ছে ধর্মের কথা, দায়িত্বের কথা, সর্বোপরি মনুষ্যত্ববোধের কথা।

বোধ থাকলে তো আর এমনই মহাপাপের তথাকথিত  মৌসুমী ব্যবসায় আসতো না। সব সময় পাপবোধ মাথায় থাকতো। মানুষ হিসেবে কেবল ব্যক্তি কিংবা পারিবারিক স্বার্থ নয়; সামাজিক স্বার্থ তথা দায়িত্বের কথা, কিংবা ধর্মীয় মূল্যবোধের কথা মনে রাখতো।  কোনভাবেই অনৈতিকতার দিকে পা বাড়াতো না। অনৈতিকতা সবকিছু ছারখার করে দেয়। সমাজে নিজের অবস্থানকে খুবই নীচুতে নামিয়ে দেয়। অনৈতিকভাবে সবকিছুর দাম বাড়াতে গিয়ে মানুষ  যে মানুষের দামটাই কমিয়ে দিল, নীচে নামিয়ে দিল - সে হিসেব কি আদৌ মানুষ রেখেছে? চলবে....

 

সম্পাদক ও প্রকাশক: সরদার মোঃ শাহীন
উপদেষ্টা সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম সুজন
বার্তা সম্পাদক: ফোয়ারা ইয়াছমিন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: আবু মুসা
সহ: সম্পাদক: মোঃ শামছুজ্জামান

প্রকাশক কর্তৃক সিমেক ফাউন্ডেশন এর পক্ষে
বিএস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড,
ওয়ারী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০ হতে প্রকাশিত।

বানিজ্যিক অফিস: ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
বার্তা বিভাগ: বাড়ি # ৩৩, রোড # ১৫, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
ফোন: ০১৮৯৬০৫৭৯৯৯
Email: simecnews@gmail.com