বুক নাকি ফেইসবুক?

প্রকাশের সময় : 2021-01-20 14:22:39 | প্রকাশক : Administration
বুক নাকি ফেইসবুক?

মোহাম্মদ মাহবুব রব্বানী: তথ্যপ্রযুক্তির অসাধারণ উন্নতি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপক বিকাশের ফলে বর্তমানে ইড়ড়শ এবং ঋধপবনড়ড়শ এর ব্যবহারিক দিকটি সবচেয়ে বেশি আলোচ্য বিষয়। যেহেতু ফেইসবুকের উপস্থাপনা বা প্রেজেন্টেশন ব্যবহারকারীর নিকট অনেক বেশি আকর্ষণীয় এবং ফেইসবুকের কনটেন্ট অনেক বেশি বৈচিত্র্যময় তাই মানুষ বইয়ের চেয়ে ফেইসবুক ব্যবহারে অনেক বেশি আগ্রহী।

তাছাড়া ফেইসবুক পড়ার বা দেখার জন্য ব্যবহৃত ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসগুলোও ফেইসবুকের লেখা, ছবি বা ভিডিওকে অনেক আকর্ষণীয়ভাবে ব্যবহারকারীদের সামনে উপস্থাপন করে। দেশের মোটামুটি সব জায়গায় যেহেতু বর্তমানে মোবাইল নেটওয়ার্ক শক্তিশালী সেহেতু যেকোনো অবস্থাতেই একজন ব্যবহারকারী ফেইসবুকে ঢুকতে পারেন।

ফলে বাস্তবতা এমন দাঁড়িয়েছে যে, ব্যবহারিক দিক বিবেচনায় বইয়ের চেয়ে চেহারা বই বা ঋধপবনড়ড়শ অনেক বেশি সহজলভ্য এবং জনপ্রিয়। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা বই পড়ার চেয়ে চেহারা বই পড়েন বেশি, ফেইসবুকে সময় ব্যয় করেন বেশি এবং দৃশ্যত ফেইসবুকেই আনন্দও পান বেশি। ফলে যাদের বইয়ে নিমগ্ন থাকবার কথা সেই সব শিক্ষার্থীরাও বইয়ের পাতা না উল্টিয়ে ফেইসবুক নিয়ে অধিকাংশ সময় ব্যস্ত থাকেন।

একটা সময় ছিল যখন শিক্ষিত সমাজ বিখ্যাত কোনো লেখকের নতুন বই বাজারে আসার অপেক্ষায় থাকত। দুপুরের খাবারের পর কিংবা রাতে ঘুমাতে যাবার আগে বই পড়তে পড়তে মানুষ ঘুমিয়ে পড়ত। স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা ছুটির পর পাড়ার লাইব্রেরিতে গিয়ে দুয়েক ঘণ্টা বসে বই পড়ে আসত।

স্কুল-কলেজ বা পাবলিক লাইব্রেরি থেকে বই ধার নিয়ে বাসায় বসে পড়ত। অনেকে আবার পরস্পরের মধ্যে বই আদান প্রদান করত। বইয়ের প্রতি মানুষের ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম। পছন্দের একটা বই সংগ্রহ করার জন্য মানুষ অনেক কষ্ট করত। বই পড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ ছিল। অবসর কাটানোর সর্বোত্তম উপায় ছিল বই পড়া।

যাত্রাপথে সময় কাটানোর জন্য মানুষ বইকে সঙ্গী হিসাবে বেছে নিত। বই ছিল মানুষের সার্বক্ষণিক বন্ধু। অথচ এখন শুধু নতুন প্রজন্মই নয়, মোটামুটি সব বয়সীরাই ফেইসবুক নামক বইটি পড়েন। ঘুমোতে যাবার সময় এখন বইয়ের বদলে মানুষ ফেইসবুক ব্যবহার করে। মোবাইল ফোনের স্ক্রিন স্ক্রলডাউন করতে করতে ঘুমোতে বিলম্ব হওয়া এখন অনেকের জীবনের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।

ক্লাসের ফাঁকে ছেলেমেয়েরা যেখানে বই পড়ত এখন তারা ঐ সময়টাতে ফেইসবুক দেখে। অবসর কাটানোর জন্য মানুষ এখন বইকে নয়, ফেইসবুককে সঙ্গী হিসাবে বেছে নেয়। নতুন বই সংগ্রহের চেয়ে মানুষ এখন ফেইসবুক ফ্রেন্ড বাড়ানোতে বেশি আগ্রহী। কোন লেখকের বই বেরুল তা জানার চেয়ে ফেইসবুকে কে কী পোস্ট করল সেটা জানতে বেশি আগ্রহী।

২০০৪ সালে ফেইসবুকের শুরুর দিকে বাংলাদেশে ইন্টারনেট এবং উন্নত প্রযুক্তির মোবাইল ফোন সহজলভ্য ছিল না। ফলে ফেইসবুক তখন আমাদের ঘাড়ে চেপে না বসলেও বর্তমানে ফেইসবুক আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে মিশে গেছে। পরীক্ষার আগের রাতে যে ছেলে বইয়ের পাতায় ডুবে থাকবার কথা সে এখন ফেইসবুকে প্রশ্ন খুঁজে কিংবা অন্য বন্ধুদের কাছে কোনো সমস্যার সমাধান চায়।

বই পড়ার অভ্যাসের সাথে ফেইসবুক ব্যবহারের বিস্তর তফাত রয়েছে। পৃথিবীর তাবৎ জ্ঞান, আনন্দ, বেদনা বা যেকোনো প্রকার তথ্য এবং সাহায্য এখন ফেইসবুকে পাওয়া যায়। বইয়ের পাতা উল্টানোর চেয়ে ফেইসবুকে অনুসন্ধান করা অনেক সহজ। একটা তথ্য জানতে চাইলে ফেইসবুক হাজারটা তথ্য অনুসন্ধানকারীর সামনে উপস্থাপন করে।

ফেইসবুকে পারস্পরিক ডিজিটাল মিথস্ক্রিয়ার অবারিত সুযোগ রয়েছে। যখন তখন যে কারও সাথে কথা বলে একাকীত্ব কাটানো যায়। সমস্যা হচ্ছে ফেইসবুক থেকে প্রাপ্ত কোনো তথ্যই সত্যতা যাচাইকৃত নয় কিংবা সম্পূর্ণ নয় বরং আংশিক বা অসম্পূর্ণ। তাছাড়া বৈচিত্র্যময় ফেইসবুক মানুষকে সহজেই বিভ্রান্ত করে এবং প্রলুব্ধ করে দীর্ঘসময় আঁকড়ে ধরে রাখে।

আজকালকার ছেলেমেয়েরা দুই ঘণ্টা একটি বই পড়ার চেয়ে ছয় ঘণ্টা ফেইসবুক পড়ে বা ব্যবহার করে এবং কিভাবে এতটা সময় কেটে গেল তার খেয়ালই রাখে না। অধিকাংশ ফেইসবুক পোস্টই হয়তো খবর, নয়তো আড্ডার সংগে প্রাসঙ্গিক। ফলে এক দিকে যেমন তাদের সময় নষ্ট হয় অন্যদিকে মানসিকভাবেও তারা বিভ্রান্ত হয়। কারও লেখা পড়ে তারা হাসে, পরক্ষণেই অন্য কারও দুঃসংবাদ দেখে মর্মাহত হয় কিংবা ভিন্ন কারও লেখায় কোনো অনিয়মের ঘটনা জেনে ক্ষুদ্ধ হয়।

হয়তোবা তার পরেই অন্য কারও সুখবর জেনে ঈর্ষান্বিত হয়। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ ইত্যাদি অনেক কিছুই ফেইসবুকে এখন পাওয়া যায় অথবা বন্ধুরা শেয়ার করে। সেসবের কোনোটিই মনোমত নয়। ফলে কোনটা খাঁটি আর কোনটা মাটি তা বোঝা দুষ্কর। ফেইসবুকের পাশাপাশি অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা শেয়ারিং মাধ্যমও এক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত।

ফেইসবুক-এর প্রতি আসক্তির কতগুলো কুফল আমরা দেখতে পাই। শিশুশিক্ষার্থীদের দীর্ঘসময় ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের দিকে তাকিয়ে থাকার ফলে তাদের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ডিভাইসের স্ক্রিনের দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকার ফলে চোখের সমস্যা হয়, পড়াশোনায় মনোযোগী না হয়ে কপি পেস্ট করার প্রতি মানুষের ঝোঁক বাড়ে, সৃষ্টিশীলতার চর্চা না করে অন্যের উপর নির্ভরতা বৃদ্ধি পায়। বিজ্ঞানের সুফল আমাদেরকে অবশ্যই নিতে হবে; কিন্তু কীভাবে? কোনোভাবেই বই পড়ার সময়কে সংকুচিত করে বা বইকে পাশ কাটিয়ে ফেইসবুক, ইউটিউব বা অন্যান্য ইন্টারনেট মাধ্যমের দিকে ঝোঁকা উচিত নয়। আধুনিক গ্রন্থাগারে কাগজের বইয়ের পাশাপাশি ইলেক্ট্রনিক বইয়ের (সফট কপি) সরবরাহ থাকে। গ্রন্থাগারের নিবন্ধিত পাঠক গ্রন্থাগারের ওয়েবসাইটে ঢুকে লগ-ইন করে নিজের ঘরে বসেই বই পড়তে পারেন নিজের ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসে।

বই পড়ার অভ্যাস তৈরি হলে মানুষ আরেকটা বই-ই পড়বে কিন্তু ফেইসবুক পড়ার অভ্যাস তৈরি হলে তা আসক্তিতে রূপ নেবে। সামাজিক যোগাযোগ রক্ষার জন্য ফেইসবুক ব্যবহারের দরকার আছে কিন্তু সেটা কখনোই বইকে এড়িয়ে নয়। বই পড়ার জন্য পাঠাগারের গুরুত্ব অপরিসীম। একেকটি পাঠাগার জ্ঞানের ভাণ্ডার।

নানা বিষয়ের বইয়ের সমাহার থাকে একেকটি পাঠাগারে। পাঠক পাঠাগারে যেয়ে বসে বই পড়ছে এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কী হতে পারে। পাঠাগারে বসে বই পড়ার সুবিধা অনেক। তখন কেবল বই-ই পড়া হয় অন্য কিছু নয়। ফলে বইয়ের প্রতি মনোযোগ আসে অনেক বেশি এবং পড়ার আনন্দ উপভোগ করা যায় পরিপূর্ণভাবে।

পাঠাগারে বসেই হোক কিংবা নিজে সংগ্রহ করেই হোক, কাগজের বই-ই হোক কিংবা ইলেক্ট্রনিক বই-ই হোক, আমাদের বই পড়া উচিত। নতুন প্রজন্মকে বই পড়তে উদ্বুদ্ধ করা উচিত। বিশেষকরে এই করোনাভাইরাস মহামারীকালে ফেইসবুক বা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সময় বেশি ব্যয় না করে ঘরে থাকা বই কিংবা অনলাইন থেকে ইলেক্ট্রনিক বই ডাউনলোড করে পড়া উচিত।

আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ফেইসবুক একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। ফলে ফেইসবুক নয়, বইয়ের ওপর নির্ভরতা বাড়িয়ে জ্ঞানার্জন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায়ও কৃতকার্য হতে হবে বইয়ের ওপর নির্ভর করেই। শুধু শিক্ষার্থীরাই নয়, অনলাইনের প্রতি সবার অপ্রয়োজনীয় আসক্তি কমিয়ে বইয়ের প্রতি মনোযোগী না হলে জাতি এক সময় মেধাশূন্যতার ঝুঁকিতে পড়বে। তাই ফেইসবুক নয়, বুকই হোক আমাদের সার্বক্ষণিক বন্ধু। -বিডিনিউজ২৪ডটকম

 

সম্পাদক ও প্রকাশক: সরদার মোঃ শাহীন
উপদেষ্টা সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম সুজন
বার্তা সম্পাদক: ফোয়ারা ইয়াছমিন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: আবু মুসা
সহ: সম্পাদক: মোঃ শামছুজ্জামান

প্রকাশক কর্তৃক সিমেক ফাউন্ডেশন এর পক্ষে
বিএস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড,
ওয়ারী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০ হতে প্রকাশিত।

বানিজ্যিক অফিস: ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
বার্তা বিভাগ: বাড়ি # ৩৩, রোড # ১৫, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
ফোন: ০১৮৯৬০৫৭৯৯৯
Email: simecnews@gmail.com