করোনা দিনের ডায়েরি...
প্রকাশের সময় : 2021-01-20 14:54:29 | প্রকাশক : Administration
ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীন
১১তম পর্ব
দেশে বৈশাখ এলো আর ঢামাঢোল বাজবে না, তা কি হয়! করোনা আছে তো কি হয়েছে! ঢামাঢোল বাজানো শুরু হয়ে গেছে। বেশ ভালভাবেই শুরু হয়েছে। আশপাশে চেনাজানা সরকার বিরোধী যতজন আছে, সবাই একসংগে সরব হয়ে উঠেছে। সকালের কাকডাকা ভোরে পাখিরা একসংগে যেভাবে কিচিরমিচির করে ওঠে, সরকার বিরোধীরাও সেভাবে কলরবে মেতে উঠেছে। বৈশাখী গানের প্যারোডি করা সুরে চাল আর তেল চোরদের সামনে নিয়ে এসেছে।
যেন আনন্দ আর ধরে না। কিসের করোনা, কিসের কি? যেন উৎসব লেগেছে। শুধু আনন্দ আর আনন্দ। মনে হচ্ছে করোনা এখন দেশের কোন সমস্যাই না। বরং আনন্দের উপকরণ। দেশের একমাত্র সমস্যা গুটিকয়েক চালচোর। সারাদেশের ৬৮ হাজার গ্রামে ৬৮ জনও নয়; চোর ধরা পড়েছে হাতে গোণা গুটিকয়েক। তারা ধরা পড়েছে সরকারের তৎপরতায় সরকারের বাহিনীর হাতেই। কৃতিত্ব তো সরকারের। তবুও ঐ বন্ধুরা লাফিয়ে উঠলো সরকারের বিরুদ্ধে।
একবারও ভাবলো না, ওদের ধরেছে সরকার নিজেই। যখন পুলিশ মানুষ পিটায় তখন পুলিশ হয় সরকারের। আর যখন পুলিশ চোর পিটায়, চোর ধরে; তখন পুলিশ সরকারের হয় না। এই হলো ওদের কনসেপশন। আসলে দেশটা পুরোপুরি তিনটে গ্রুপে ভাগ হয়ে আছে; উসকানি গ্রুপ, মন্তব্যকারী গ্রুপ আর কর্তব্য পরায়ণ গ্রুপ। প্রথম গ্রুপ ইস্যু একটা পেলে রঙচঙ মাখিয়ে উসকানি দেয়া শুরু করে। ২য় গ্রুপ ডানবাম বিচার না করে ঢালাও মন্তব্য করে যায়। আর সবচেয়ে অসহায় এবং দূর্বল গ্রুপ এসবে না যেয়ে সামাজিক দায়িত্ব পালন করে।
করোনায়ও তাই হচ্ছে। প্রথম দুইগ্রুপ তাদের কাজ অবিরত করেই যাচ্ছে। দেশের বারোটা বাজাবার সব আয়োজনে তারা ব্যস্ত। আর ৩য় গ্রুপটি যতটুকু পারছে করোনায় ভূমিকা রাখছে। যারযার জায়গা থেকে যতটুকু পারছে ভূমিকা রেখেই যাচ্ছে। তবে, মূলত করোনা সঙ্কট কাটাতে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে সরকার। নানাভাবে সরকারী সাহায্য সহযোগীতা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে স্থানীয় সরকার কাঠামোকে কাজে লাগানো হচ্ছে।
কিন্তু কোন কোন জায়গায় ব্যতিক্রম আছে। চোখের সামনে দিয়ে এত্তএত্ত চালগম যাবে, আর তা শুধু কেউ কেউ চেয়ে চেয়ে দেখবে, তা কি হয়! চোখ দিয়ে, মুখ দিয়ে চেখে দেখতে কার না ইচ্ছে করে! ইচ্ছে করে বলেই তসরূপের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। করোনায় সরকারী সাহায্য চুরির অভিযোগ উঠছে মূলত ইউপি চেয়ারম্যান এবং সদস্যদের বিরুদ্ধে। সংখ্যাটি হাতেগোনা হলেও সরকার প্রধান বসে থাকেননি। মানব জাতির এই দুঃসময়ে যারা এমন ঘৃণিত অপরাধ করছে তাদের বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতার নীতি ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
জেল ছাড়া তাদের কোথায়ও জায়গা হবে না। স্থানীয় সরকারে তো নয়ই, জায়গা হবে না দলেও। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সাময়িকভাবে যাদের বহিষ্কার করেছে তাদের সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, কোন না কোন অনিয়মের সঙ্গে জড়িত এসব চেয়ারম্যান মেম্বাররা। সাধারণ মানুষ মনে করছে সরকারের এই কঠোর নীতি বাঁচাবে তাদের। ত্রাণ বিতরণে নানামুখী অনিয়মের অভিযোগে দেশের ৫টি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে বরখাস্ত করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। পৃথকভাবে প্রত্যেকের খোঁজ নিয়ে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এছাড়া আরও সাত জন ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে সরকার, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী খুবই কঠিন। কঠিন শাস্তির হুংকার তিনি দিয়েছেন। তিনি কেবল হুংকারই দেখান না। শেখ হাসিনা যা বলেন, তা করে দেখান। একবার তিনি বলেছিলেন জনগণের জন্য দেওয়া ত্রাণ নিয়ে যারা অনিয়ম বা দুর্নীতি করবে তাদের রাজনৈতিক পরিচয় যাই হোক, কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। সেই ঘোষণা অনুযায়ীই ত্রাণ বিতরণে অনিয়মসহ বিভিন্ন অভিযোগে কয়েকদিনে মোট ৩৫ জন স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে সরকার।
বরখাস্তকৃত এই জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে কয়েকজন ইতিমধ্যেই গ্রেপ্তার হয়ে জেলহাজতে আছেন। ‘অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়িয়ে জনস্বার্থের পরিপন্থী’ কাজ করায় স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইনের ৩৪ (১) ধারা অনুযায়ী তাদের বরখাস্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশে ত্রাণ আত্মসাতের ঘটনা আগেও ঘটেছে। কিন্তু ত্রাণ নিয়ে অনিয়ম করায় তড়িৎ গতিতে জনপ্রতিনিধিদের গ্রেপ্তার ও বরখাস্ত হওয়ার নজির জননেত্রী শেখ হাসিনাই স্থাপন করলেন।
দুঃখজনক হলেও সত্যি! যারা চালচুরি দেখে হুমরি খেয়ে সংবাদ ভাইরাল করছে, তারা একটিবারের জন্যে বাহ্মণবাড়িয়ায় প্রায় দু’লক্ষাধিক লোকের জানাজা দেখে একটি মন্তব্যও করেনি। এটা যে চাল চুরির চেয়ে ভয়ানক রকমের বিধ্বংসী হতে পারে, সে ব্যাপারে সামান্য টেনশানও নেই। করোনা নিয়ে এত মাতামাতি, দেশ নিয়ে এত ভাবনা! অথচ এই জায়গাটিতে চুপ। মুখে কলুপ এটে চুপ মেরেছে।
স্বীকার করছি, করোনা মোকাবেলায় সরকারের এখনো অনেক অব্যবস্থাপনা আছে। কিন্তু নিজেরা সচেতন না হয়ে শুধু সরকারকে গালি দিলেই কি করোনা মুক্ত হওয়া সম্ভব? মানুষ লাখে লাখে বাড়ি যাবে, শ্রমিকরা হেঁটে ঢাকা আসবে, বাজারে থাকবে উপচেপড়া ভিড়, লুকিয়ে বাসার ছাদে জামাত করবে, পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে বিকালে হাওয়া খেতে বেরোবে। কেউ সরকারের কোন কথাই শুনবে না। শুধু সরকারকে গালি দিয়েই যাবে?
এই জাতিকে রক্ষা করার সাধ্য আসলে কারও নেই। সরকার যতো চেষ্টাই করুক, করোনার বিস্তার ঠেকাতে পারবে না। আমরা আত্মহত্যা করতে চাইলে সরকার কীভাবে ঠেকাবে? আমরা জোশ তুলে জানাজা পড়লাম বটে, তবে দু’দিন পর সেই আমরাই চিৎকার করবো, বাহ্মণবাড়িয়ায় পর্যাপ্ত আইসিইউ নেই কেন? আর বৈশাখে চালচোর নিয়ে প্যারোডি বানানোর দলেরা ইচ্ছেমত প্যারোডি বানাবে আইসিইউ বিহীন বাংলাদেশকে নিয়ে।
এদের কাজ কেবলই প্যারোডি বানানো। আর খুব কৌশলে মানুষের মনে আতঙ্ক ছড়ানো। উদ্দেশ্য, বিপদ বুঝে কায়দা করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলা। করোনা থেকে জাতির মুক্তিপ্রাপ্তি নিয়ে এদের কোন মাথা ব্যথা নেই, টেনশানও নেই। টেনশান কেবল সরকারের পতন নিয়ে। লাগলে কোটি লোক মরবে। মরুক। তবুও তাঁদের ভাল লাগে এইভেবে যে সরকারের খবর হয়ে যাবে তাতে। ব্যাপারটি এমন যে, নিজে মরবে; তবুও সরকারকে মেরে ছাড়বে।
রাজনীতির এমন নোংরা অবয়ব দেখলে রাজনীতির প্রতি ঘৃণাই জন্ম নেয়। ভালবাসা হারিয়েছে অনেক আগেই। এখন ঘৃণা জন্মাচ্ছে। একদিন দেশের রাজনীতি এমন ছিল না। দেশটাও এমন ছিল না। তখন দেশের জন্যে রাজনীতি হতো। এখন দলের জন্যে হয়, নিজের জন্যে হয়। মহামারী তো আগেও এসেছে এদেশে। তখন এসব নিয়ে রাজনীতি হয়নি। মানুষ নোংরা রাজনীতি করেনি। মানুষ মানুষের সেবা করেছে। এবং বিজ্ঞানের মাধ্যমেই জয় করেছে মানুষ।
অনেক বছর আগের কথা। বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে যক্ষ্মার মড়ক লেগেছে। কিন্তু কোন ঔষধ নেই পৃথিবীর কোথায়ও। থাকবে কিভাবে? যক্ষ্মার কোন ঔষধই বের হয়নি। লোক মারা যাচ্ছে নিত্যদিন। গাঁওগেরাম লাশের গন্ধে ভারী হয়ে উঠছে। মানুষজনের মাঝে শুধু হতাশা আর আতঙ্ক। তবে বেশীদিন লাগেনি। খুব তাড়াতাড়িই বের হয় যক্ষ্মার ঔষধ। তারপর থেকে এখন আর যক্ষ্মায় কেউ মারা যায় না।
এর আগে কলেরায়ও যেত। গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যেত। ওই সময় মানুষ জানত না, শুধু নুন আর চিনি দিয়ে পানি গুলে খেলে কলেরা প্রতিরোধ করা যায় এবং আস্তে আস্তে ভাল হয়। কলেরার দিন শেষ। এখন কলেরা আর কোন রোগ নয়। কলেরার মত আমরা ম্যালেরিয়াও দেখেছি। মশাবাহিত এই রোগে হাজার হাজার মানুষ মরে গেছে। কিন্তু এখন ম্যালেরিয়া তেমন কিছু না। এই রোগের প্রতিষেধক বেরিয়ে গেছে।
বর্তমানে যে করোনা, একদিন এরও প্রতিষেধক বেরিয়ে যাবে। এজন্য বিজ্ঞানীরা দিনরাত পরিশ্রম করছেন। এবং আশাও করছেন। তাই আতঙ্কিত হয়ে কী হবে? তার চেয়ে ভরসায় থাকা দরকার। বিজ্ঞানের ওপর ভরসা। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বিজ্ঞানের ওপর আস্থা রাখা দরকার। কাজ একটাই; দুর্যোগে দিশেহারা না হয়ে ধৈর্য্য ধরা এবং ঘরে থাকা। সর্বোপরি আল্ল−াহপাক তো আছেনই। তিনি নিশ্চয়ই তার বান্দার মঙ্গল করবেন!! চলবে...