করোনা দিনের ডায়েরি...

প্রকাশের সময় : 2021-02-03 16:30:31 | প্রকাশক : Administration
করোনা দিনের ডায়েরি...

ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীন

১২তম পর্ব

 

আল্লাহর উপর ভরসা করেই পার করছি করোনার দিন, করোনার রাত। আজ অবদি একটা রাত দু’চোখের পাতা এক করেছি বলে মনে পড়ে না। সবার ভোর হয় ভোরের নিয়মে। আমার ভোর নিয়ম মানে না। ভোর হয় রাত দশটায়। রাত দশটা বাজলেই আমার ভিতর পুলক কাজ করে। শরীরে একটা মোচড়ামুচড়ি শুরু হয়। গোছগাছ শেষ করি। রাতের খাবার, এশার নামাজ সব শেষ করে নেই।

সবশেষে করি শান্তির গোসল। বাইরে তুষারঝড়া কনকনে ঠান্ডায় তুষারপাত দেখতে দেখতে শাওয়ার করার মজাটা অন্যরকম। তাপমাত্রা ভালই নেমেছে। মাইনাস বিশ থেকে পঁচিশে ওঠানামা করছে। দেশটাই এমন। বেশিরভাগ সময়ই ঠান্ডা। এসবই বাইরের কথা। ঘরের ভেতর সব উল্টো। সবকিছুই গরম। গরম শাওয়ার রুমও। শাওয়ারে গরম পানি ছেড়ে একটানা দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি। কাটাবার চেষ্টা করি দিনের সকল অবসাদ, সকল চিন্তার গ্লানি।

টেবিলে চিনিছাড়া চা রাখা আছে। র’ চা। আমার ভারি পছন্দের এবং দেখার মত লাল টকটকা। শোনিমের আম্মু রোজ বানিয়ে রাখে আমার জন্যে। শাওয়ার শেষে এমনই বড় কাপের এককাপ চা আমার চাইই চাই। চিনি নেই, দুধ নেই। কেবলই চায়ের পাতা মেশানো পানসে চা। কিন্তু মুখে দিলে রাজ্যের স্বাদ। একেকটা চুমুকে নেমে যায় সকল দুশ্চিন্তা। সকল অবসাদ।

লিখতে বসেছি। কিন্তু লেখা আসছে না। ঠিক কী লিখবো, বুঝতে পারছি না। দুপুরেও পারিনি। দুপুরের মত এখনও কিছু না লিখে চুপচাপ বসে থাকবো কি না সেটাও জানি না। বুঝতে পারছি করোনা আমার স্বাভাবিক বোধ শক্তিকে আঘাত করেছে। একটু একটু করে আঘাত করে অনেকটা ক্ষমতাহীন করে দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে আমার ঘুমে।

প্রতিদিন রাতভর না ঘুমিয়ে ফজর শেষে বিছানায় যাই। সকাল সাতটা থেকে আটটার মধ্যে। উঠি দেরি করে; পড়ন্ত বিকেলে। তাড়াহুড়া করে জোহর পড়ি। শোনিমের আম্মুর তাড়া খেয়ে অগত্যা ল্যাপটপে বসি। কীবোর্ড, মাউস এবং মাউসপ্যাড পরিস্কার করি। কিন্তু ঠিকঠাক মত আর লিখতে পারি না। কীবোর্ডে আঙুল পড়ে। কিন্তু আগায় না। হাতও আগায় না। লেখাও না।

বাইশ বছর আগে যখন সিমেক নিয়ে যাত্রা শুরু করি করি করছি, তখন হাতও আগাতো। আগাতো ভাবনাও। জাপানী জীবনটা আসলে আগানোর জীবন। খুব উপভোগ করতাম সবকিছু। বেশি উপভোগ করতাম ইনফরমেশন টেকনোলজির ব্যবহারিক দিকগুলো। তখনও ল্যাপটপ বের হয়নি। ডেস্কটপের যুগ। টিভির মত দেখতে মনিটরে মাউস ঘুরিয়ে নেট দুনিয়ায় ঢুকতাম। ঢুকে দুনিয়াটা দেখে ফেলতাম। পড়তাম ঢাকার তরতাজা সব পত্রিকা।

সাতদিনের পুরানো বাসী পত্রিকায় অভ্যস্ত টোকিওতে থাকা আমার বাঙালী চেনাজানারা সে সব বিশ্বাস করতো না। এবং আড়ালে আবডালে গাঁজাখোর বলতো। বলতো চাপাবাজ। এত মিষ্টি করেও বলতো না। মোটামুটি মিষ্টি একটা গালি দিয়ে বলতো, হালায় চাপাবাজ। আমি গুলিকে ভয় পাই; গালিকে নয়। তাই ওসবের দিকে না তাকিয়ে নিজের কাজে নামি। নামি ব্যবসায়। এবং আইটি দিয়েই শুরু করি। শুরু করি একটা রঙিন স্বপ্ন নিয়ে। দেশ বিদেশের কাজ করবো আর ঘরে ঘরে ছোটবড় সবার হাতে কম্পিউটার তুলে দেবো।

আরো কত কী! এসবে কাছের মানুষেরা আমায় পাগল বলতো। এখন বলে না। বরং ওরাই পাগল বনে গেছে। গেল বিশ বছরে সিমেকের আইটিতে সফলতা দেখে ওরা রীতিমত পাগল। এখন আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। মুখে মুখে প্রশংসা। তবে প্রশংসাও করে মিষ্টি একটা গালি দিয়ে, হালায় রিয়েলি জিনিয়াস। ওরা আসলে তখনও আমাকে রিয়েলাইজ করতে পারেনি। এখনো পারছে না।

তখনও আমি চাপাবাজ ছিলাম না। আর এখনো জিনিয়াস না। জিনিয়াস ওরা, আমাদের সিমেক সিস্টেমের তরুণ পোলাপানেরা; যারা করোনায় সামান্যতম হার মানেনি। বিশ্বমহামারীতেও ঘরে বসে দেশবিদেশের ক্লাইয়েন্টদের তাক লাগিয়ে দিল। বুঝিয়ে দিল সার্ভিস কাকে বলে। আলাদা আলাদা টিমওয়ার্ক করে একটার পর একটা প্রজেক্ট এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ক্লাইয়েন্ট বুঝতেই পারছে না বাংলাদেশে লকডাউন চলছে। বুঝতে পারছে না, সিমেক সিস্টেমও লকডাউনের আওতায়।

সবচেয়ে বেশী অবাক হয়েছে আমাদের জাপানীজ ক্লাইয়েন্ট। ওদের ধারণা মেলেনি। ধারণা করেছিল করোনায় বাংলা কুপোকাত হবে। লাশ পড়বে রাস্তায়। ঢাকা হবে লাশের শহর। বাংলাদেশ ধরা খাবে। ধরা খাবে ঘাউড়া করোনার কাছে। ওরা ভাবতেও পারেনি বাঙালী এই পিচ্চি পিচ্চি প্রোগ্রামারের দল করোনার কাছে হারবে না। বরং করোনাই ওদের কাছে হেরে যাবে।

আসলেই তাই। লকডাউন ওদেরকে থামাতে পারেনি। ওরা বুঝিয়ে দিয়েছে করোনার ক্রান্তিকালেও কিভাবে ওয়ার্ক অর্ডার বের করে আনতে হয়। ওরা জিনিয়াস বলেই করতে পারছে। দেশ এবং বিদেশের বেশ কয়েকটা বড় কাজ পেয়েছে। সবই পেরেছে সঠিক নেতৃত্ব আর পরিশ্রমের কারণে। ওরা প্রমাণ করেছে আমরা পরিশ্রমী জাতি। তাই করোনাভাইরাস সারা দুনিয়াকে আতঙ্কিত করলেও আমরা ঘাবড়াতে পারি না। আমাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যুদ্ধ করে টিকে থাকার ইতিহাস আছে আমাদের।

ভয়ের কী আছে? আমরা লড়াকু জাতি। ১৯৭০, ৯১ আর ৯৮ সালে লড়াই করেছি। ৭০ এর ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ৮ লাখ আর '৯১ সালে ৩ লাখ মানুষ মারা যায় আমাদের দেশে। মুক্তিযুদ্ধকালে এক ভয়ঙ্কর অবস্থার মুখোমুখি হয়েছিলাম। তখন তো ত্রিশ লাখ শহীদ হয়েছে। ইজ্জত গেছে কয়েকলক্ষ মা-বোনের। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিল, বিরোধিতা করেছিল। সব মোকাবেলা করেই আমরা যুদ্ধে জিতে স্বাধীন বাংলাদেশ করেছি।

এখন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশের প্রধানমন্ত্রী। এই জাতির আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয় তাঁর প্রাণান্তকর চেষ্টা। তিনি আহার নিদ্রা ত্যাগ করেছেন আমাদের জন্য। প্রতিনিয়ত দেশের মানুষের জন্য সর্বোত্তম পন্থা আবিষ্কারের চেষ্টা তাঁর। এদেশের স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, কৃষি, শিল্প সবকিছুর হিসেব রাখছেন তিনি।

তবে সোশ্যাল মিডিয়া দেখলে মনে হয় না এসব আমাদের কারো মনে আছে। মনে হচ্ছে আমরা ভীষন ভীতুর জাতি। ভীতুর আন্ডা। দিনরাত ভয়ে পুতুপুতু করছি আর ঘনঘন ওয়াশরুমে যাচ্ছি। ওয়াশরুম হলো ভয় তথা পুতপুতানি কমাবার শ্রেষ্ঠ জায়গা। বর্জ্য ত্যাগের মত ভয় ত্যাগেরও উত্তম জায়গা। এ জায়গায় আজকাল কষা পেটের মানুষগুলোও বারবার যাচ্ছে। করোনার ভয়ে তাদের লুজমোশন শুরু হয়েছে। লুজ তো লুজ। খায়ও পানি; হাগেও পানি।

এ তো গেলো চরিত্রের একদিক। অন্যদিকে গুজবে গা ভাসিয়ে অসত্য প্রচারে নাম্বার ওয়ান জাতি আমরা। গুজব আর গুজব। কেউ কেউ গুজব ছড়িয়ে বলে বেড়াচ্ছে, করোনায় দেশে দশ লাখ মানুষ মারা যাবে। দেশে ভবিষ্যতে এমন অভাব হবে যা কল্পনারও অতীত। রাস্তায় রাস্তায় লোক মরে পড়ে থাকবে। ধরার লোক থাকবে না। লাশ পঁচবে, গলবে। কুকুরেও ছোবে না।

এগুলো দিনে একবার পড়লে ভাতের ক্ষুধা নষ্ট হয়। জান যায় যায় করে। অথচ নষ্টের দলেরা সারাদিনভর এমনি আজগুবী আতঙ্ক দেয়া খবর পোষ্ট দিতেই থাকে। এসব পড়ে আমরা ক্লান্ত হই; ওরা ক্লান্ত হয় না। ১৯৯৮ সালের বড়মাপের বন্যায় বিবিসি বাংলাদেশের দুই কোটি লোকের মৃত্যুর আভাস দিয়েছিল। আভাস সত্যি হয়নি। অনাহারে একটি লোকও মারা যায়নি। বিবিসির সেই খবর উদ্দ্যেশ্যমূলক ছিল। ছিল মিথ্যা। এমনি করেই আজকের অশুভ সকল আশঙ্কাও একদিন নিশ্চিত মিথ্যে হবে। মিথ্যে হবে আতেলদের সব জল্পনা, সব কল্পনা। আতেলরা সমাধান দিতে পারে না। পারে কেবল উস্কানি দিয়ে মরার আগেই মেরে ফেলতে।

আমরা মরব-এটা অনিবার্য। কিন্তু মরার আগেই প্রতিদিন ভয়ে মরব কেন! ধুকে ধুকে মরবো কেন! মৃত্যুকে জয় করার সংগ্রাম করব। সেই সংগ্রামে মরে গেলেও শতজনকে বাঁচিয়ে মরবো। কোনভাবেই মনের মধ্যে ভয় রাখবো না। শুধু মনে রাখবো, ‘আমি ভয় করবো না ভয় করবো না, দু’বেলা মরার আগে মরবো না ভাই মরবো না!!’ চলবে...

 

সম্পাদক ও প্রকাশক: সরদার মোঃ শাহীন
উপদেষ্টা সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম সুজন
বার্তা সম্পাদক: ফোয়ারা ইয়াছমিন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: আবু মুসা
সহ: সম্পাদক: মোঃ শামছুজ্জামান

প্রকাশক কর্তৃক সিমেক ফাউন্ডেশন এর পক্ষে
বিএস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড,
ওয়ারী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০ হতে প্রকাশিত।

বানিজ্যিক অফিস: ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
বার্তা বিভাগ: বাড়ি # ৩৩, রোড # ১৫, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
ফোন: ০১৮৯৬০৫৭৯৯৯
Email: simecnews@gmail.com