করোনা দিনের ডায়েরি...

প্রকাশের সময় : 2021-02-17 14:25:59 | প্রকাশক : Administration
করোনা দিনের ডায়েরি...

১৩তম পর্ব

অভাবী জীবনটাই ভাল। শরীর ভাল থাকে। করোনা দিনের শুরুর দিকে খাবার সংকটে একটানা দশদিন কম খেয়ে খেয়ে বেশ শুকিয়ে গিয়েছিলাম। সেটাই ভাল ছিল। এখন মোটা হয়ে গেছি। যেমনি রুচি বেড়েছে, তেমনি খাবারও। আয়নায় দাঁড়ালে পেটকু পেটকু লাগে। বেশি বিশ্রী লাগে চুলগুলো দেখতে। মাথা ভরে গেছে চুলে। পাটের আঁশের মত দেখতে চুলগুলোর না আছে শ্রী, না আছে সৌন্দর্য্য।

সৌন্দর্য্য কেবল আমার নয়, সবারই গেছে। পুরো পৃথিবীই তার সৌন্দর্য্য হারিয়েছে। অবশ্য সৌন্দর্য্য হারাবার ঘটনা এবারই প্রথম নয়। কেবল প্রকৃতির সৌন্দর্য্য নয়, বাংলাদেশে রাজনীতির সৌন্দর্য্যও নিঃশেষ হয়েছিল ৭৪ এ। বলা যায়, নোংরা আর প্রতিহিংসার রাজনীতির শুরু তখন থেকেই। যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধের নেশা থেকেই প্রতিহিংসার শুরু। পাকিস্তানের পরিকল্পনা আর আমেরিকার নেতৃত্বে বাঙালী জাতির কাছে বঙ্গ বন্ধু সরকারকে পঁচানোর নিমিত্তে একটা পরিকল্পিত দুর্ভিক্ষের আয়োজন করা হয়।

ভাগ্য খারাপ বঙ্গবন্ধুর। যুদ্ধোত্তর বাংলায় পরপর খরা আর বন্যায় এমনিতেই ফসলহানি হয়েছে ব্যাপক। চমৎকার সুযোগ পেয়ে গেল আমেরিকা। উচিত শিক্ষা দিতে হবে ৩য় বিশ্বের উদীয়মান বেত্তমিজ নেতাকে! চট্রগ্রামের কাছাকাছি চলে আসা আমেরিকার চালবাহী জাহাজ ফিরিয়ে নিল। শুরু হলো মানুষের বানানো দূর্ভিক্ষ। শুরু হলো প্রপোগান্ডা। তোলা হলো একটি নোংরা ছবি। ১০ টাকা দিয়ে শাড়ি না কিনে দিয়ে, ১৫ টাকা খরচ করে জাল কিনে চিলমারীর সেই বাকপ্রতিবন্ধী বাসন্তীর গায়ে জাল পড়িয়ে যে ছবিটি তোলা হয়েছিলো তা পুরো বিশ্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের ভাবমূর্তি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিলো।

ষড়যন্ত্র থেমে নেই আজও। এখনো চলছে সেই ষড়যন্ত্র। বেছে বেছে এবারও এক প্রতিবন্ধীকে নেয়া হয়েছে। গাজীপুরের শারীরিক প্রতিবন্ধী নুরুল ইসলামকে নিয়ে বানানো ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করে ষড়যন্ত্রকারীরা। ওই ভিডিওতে নুরুল ইসলাম নিজের সম্পর্কে মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য দেয়। অনেক তথ্য গোপনও করে সে। সে জানায়, তার বাড়িতে কোনো খাবার নেই। খাওয়ার জন্য সে হাহাকার করে।

কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে মাত্র দুইদিন আগে সে সরকারি অনুদান পেয়েছে। সে সারাবছরই প্রতিবন্ধী ভাতা পায় এবং ১০ টাকা কেজি দরে চাল পায়। সে আরও অতিরিক্ত ত্রাণ সহায়তা পাওয়ার লোভে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। এমন কাজে তাকে প্রলুব্ধ করেছে ষড়যন্ত্রকারীরা।

করোনার এই কঠিন দুর্দিনে প্রবাসে বসে দেশের ষড়যন্ত্রকারীদের এসব ভিডিও কর্ম দেখি আর ভাবি ওরা কত বড় বজ্জাতের হাড্ডি। সবাই করোনার ভয়ে অস্থির। আর বজ্জাতগুলোর করোনা ভীতিও নেই। ওরা অসভ্য। অসভ্যদের মরণভয় কোনকালেই থাকে না। ওদের মরণভয় নেই। সম্মানের ভয় নেই। ভয় নেই ইজ্জতেরও। এদের জীবন নিয়ে কোন দুশ্চিন্তাও নেই।

দুশ্চিন্তা যা আছে সব কৃষকের। আগাম বন্যার দুশ্চিন্তায় কৃষক। শ্রমিক সংকটে কৃষকের কপালে চিন্তার ভাঁজ। পানি উঠে আসার আগেই পাকা ধান সব কেটে ঘরে তুলতে হবে। এদিকে করোনার ভয়ে মাঠে শ্রমিক নেই। কৃষকের হাহাকার শুরু হয় হয় করছে। ষড়যন্ত্রকারী তথাকথিত দেশপ্রেমিকদের এ নিয়ে সামান্য মাথা ব্যথাও নেই। যথারীতি এগিয়ে এলেন প্রধানমন্ত্রী। কৃষকদের পাশে দাঁড়ালেন। জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে ডাক দিলেন সর্বস্তরের জনতাকে কৃষকের পাশে দাঁড়াতে।

ষড়যন্ত্রকারীরা না পড়লেও ঝাপিয়ে পড়লো সবাই। ঝাঁপিয়ে পড়লো এলাকার শিক্ষক, শিক্ষার্থী, পুলিশ, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যসহ প্রশাসনের সকল শ্রেণি পেশার মানুষ। তারা ধান কাটার কাজে নিয়োজিত হলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক ছাত্র সংগঠনের সদস্যরা স্বেচ্ছাশ্রমে কাস্তে হাতে ধান কাটছেন। ৭৪ এ ষড়যন্ত্রকারীদের রোখা যায়নি। ২০২০ এ গেল। মানুষ মানুষে এক হয়ে গেল। মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এ ঘটনা সত্যি বিরল।

বিরল এ ঘটনাই মহামারী করোনার সর্বোচ্চ অর্জন আর জীবনের পরম শিক্ষা। যে শিক্ষা হবে বাকী জীবনের চলার পথের পাথেয়। করোনায় কী এক অদ্ভুত জীবন হয়ে গেল আমাদের। তাই না! কোনো কাজ নেই, বাইরের আড্ডা নেই, সন্ধ্যার চা খাওয়া নেই। পরিচিত মানুষগুলোর হৈ চৈ নেই। চার দেয়ালের মধ্যেই পায়চারি। আর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে খুনসুটি।

প্রবাসে পরিবার বলতে আমার ছোট্ট পরিবার। আমি, আমার শোনিম আর শোনিমের মা। মা হলো শোনিমের এক পৃথিবী। পনেরো অতিক্রান্ত শোনিমের পুরো জীবনে মাকে ছাড়া থেকেছে মাত্র দুটো রাত। মা ছাড়া একদমই তার চলে না। দিনেও মাকে লাগে; রাতেও লাগে। তবে দিনে যেমন তেমন, রাতের বিছানায় মাকে চাইই চাই। হয়তো কোন কারণে মায়ের সাথে কথা বন্ধ। পুরোপুরি বন্ধ। মাকে ধরবেও না। কিন্তু বিছানার এক মাথায় শুয়ে থেকে হলেও অন্য মাথায় থাকা মায়ের গায়ের সাথে হাত লাগিয়ে রাখবে।

এটা করোনা রাতের চিত্র। দিনের চিত্র ভিন্ন। সারাদিন মায়ের সঙ্গে এটাসেটা নিয়ে লেগেই আছে। খুনসুটির অভাব নেই। মায়ের কোন কাজই ওর পছন্দ না। ওর বিচারে মা কোন কাজেরই না। একটা কঠিন রকমের বিরক্তিকর প্রাণী মাত্র। সারাক্ষণ কেবলই বিরক্ত। সব কাজে কেবলই বাঁধা। আর কিছুক্ষণ পরপর এটাওটা খাওয়া নিয়ে তাগাদা। একবার দুধ খাও, তো একবার ডিম। উফ্! অসহ্য! কাহাতক সহ্য করা যায়!

শোনিমের মায়ের মত আমার মাও হয়ত এমনই ছিলেন! অসহ্যকরই ছিলেন। আজ নেই বলে হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করি, মা কী জিনিস! পুরো জীবনটা মা কাটিয়ে দেন পরিবারের সবার জন্যে। এক বাড়ীর একঘরেই কাটিয়ে দেন। আজ আমরা দেড় মাসের লকডাউনে মরি মরি করছি। আর মায়েদের জীবন পুরোটাই কাটে লকডাউনে। শুধু আমার মা নয়, উপমহাদেশের প্রতিটা পরিবারের মায়েদের সময় কাটে লকডাউনের মধ্যে।

কি করোনা দিনের আগের জীবন, কি লকডাউনের জীবন! কী করেন না মায়েরা! একটু কাজ, আবার একটু কাজ; তারপর আরও একটু কাজ। এরপর হয়তো একটু বিশ্রাম। মুক্ত আকাশ মায়েরা দেখতে পারেন না। বাড়ির বারান্দা আর আঙিনায় তাদের সর্বোচ্চ পরিসর। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সময় কাটানো আর খুনসুটি। কখনো ছেলে অভিমান করলো, তো কখনো মেয়ে মুখের উপর দরজা বন্ধ করলো। এভাবেই কেটে যায় মায়েদের জীবন।

আমার মায়ের মেয়ে ছিল না। মুখের উপর অভিমান করে দরজা বন্ধ করেনি কোন মেয়ে। কিন্তু ভাই ছিলাম পাঁচজন। বদের বদ। সবাই ক্ষোভ ঝারতাম মায়ের উপর। বাড়ির বাইরের আকামকুকাম কিংবা অন্যায়কর্ম ধরা খেয়ে আব্বার পেদানী খেয়েছি। দম বেরুনো পেদানী। এটাও মায়ের দোষ। মা কেন আব্বার হাত থেকে বাঁচাতে পারলো না; এ জন্যে মাকে ঝারি। এমন খারাপ মা দুনিয়াতে নেই বলে আহাজারি। মা আদর করে ব্যথার জায়গা মালিশ করে দিচ্ছেন। এতেও দোষ। ব্যথার জায়গা এত ব্যথা লাগে কেন, এজন্যে আবার ঝারি। সারাটা জনম কেবল ঝারি আর ঝারি।

ক্লাশ ফোরে পড়ি। বৈশাখের কোন এক রাতে হঠাৎ করে নানু মারা গেলেন। সবাই নানুবাড়ী গেলাম। মা নানুর বড় মেয়ে। বংশেরও বড়। তাঁর অবস্থা বড়ই করুণ। কোনভাবেই নিজেকে সামলাতে পারছেন না। নানাকে ধরে কেবলই কান্না। শোকে পাথর নানা মাকে বুঝান। কে নেয় কার বুঝ! মা নাওয়া খাওয়াও এক রকম ছেড়ে দিলেন। ভুলে গেলেন আমাকেও। তাঁর বড় আদরের ছোট সন্তানকে।

সমস্যা বাঁধালো বসন্ত। বৈশাখী ভ্যাপসা গরমের জলবসন্ত। আমার পিঠে অন্তত দুটো গোটা দেখা দিয়েছে। আবিস্কার করেছেন নানা। হাউমাউ করে কেঁদে দিলেন। মাকে ডাকলেন। ডেকে ডেকে মাকে দেখালেন। মা স্তব্দ বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ এমনি করে থেকে আমাকে জড়ায়ে ধরলেন। বুকের মধ্যে মিশে ধরলেন। যেন কতদিন আমায় দেখেন না। কতদিন আদর করেন না তাঁর বুকের মানিককে।

মা হারানোর কষ্ট ভুলে মা আমার নেমে পড়লেন আমারই সেবায়। নানাবাড়ির উত্তরের বারান্দা লকডাউন করে ফেললেন। বারান্দার একপাশে বিছানায় মশারী খাটিয়ে আমাকে নিয়ে ঢুকলেন। দরজায় খিল দিয়ে ঢুকলেন। ছোটমামাকে দিয়ে নিমপাতা আনালেন। নানাকে পাঠালেন গঞ্জের বাজার থেকে মাখন আনতে। শুরু হলো আমার আদর; মমতাময়ী মায়ের মমতামাখা আদর।  

আদর করতে শুধু আমাকে নয়; মা নিজেও পুরোপুরি লকডাউনে চলে গেলেন। মায়েরা এমনই হয়। এবং মায়েদের এমন জীবনকথা কেউই বুঝতে পারে না। কিংবা বুঝেও না বোঝার ভান করে। কেউ উপলব্ধি করে না। জন্ম জন্মান্তরে মায়েদের এই লকডাউন কখনোই কেউ উপলব্ধি করে না। কেউ বোঝে না; যে লকডাউন আজ আমরা করোনায় ভোগ করছি, তা আমাদের মায়েরা ভোগ করে চলেছেন মৃত্যুর দিন পর্যন্ত!!! চলবে...

 

সম্পাদক ও প্রকাশক: সরদার মোঃ শাহীন
উপদেষ্টা সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম সুজন
বার্তা সম্পাদক: ফোয়ারা ইয়াছমিন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: আবু মুসা
সহ: সম্পাদক: মোঃ শামছুজ্জামান

প্রকাশক কর্তৃক সিমেক ফাউন্ডেশন এর পক্ষে
বিএস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড,
ওয়ারী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০ হতে প্রকাশিত।

বানিজ্যিক অফিস: ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
বার্তা বিভাগ: বাড়ি # ৩৩, রোড # ১৫, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
ফোন: ০১৮৯৬০৫৭৯৯৯
Email: simecnews@gmail.com