করোনা দিনের ডায়েরি...

প্রকাশের সময় : 2021-03-03 13:42:02 | প্রকাশক : Administration
করোনা দিনের ডায়েরি...

১৪তম পর্ব

শোনিমের আম্মু আজ বেজায় ক্ষেপেছে আমার উপর। মায়াদয়াহীন করোনা দিনের দয়ামায়াহীন ক্ষেপা। এই রোগ আগে ছিল না। করোনায় হয়েছে। একটু ভুল পেলেই ক্ষেপে ব্যাড়াছেড়া লাগিয়ে দেয়। অন্যদিন যেমন তেমন, অন্তত আজকে একটু দয়া দেখাতে পারতো। দয়া পরম ধম। কথায় আছে দ্বীনে দয়া করে। আর আমি তো মনুষ। আমাকে একটু দয়া করতেই পারতে! পুরো বিকেলটা তার জন্যে কী না করলাম!

ইফতারির আয়োজনে সারাক্ষণই আমি তার পাশে। তার ছোটট রান্নাঘরে। চারটি চুলার রান্না ঘরের দুটোই জ্বালানো। ভয়ানক লাল টকটকা হয়ে চুলার কয়েল জ্বলছে। এর একটিতে পানি গরম করছি আর অন্যটিতে তেল। এভাবে ফ্রাইপেন এ তেল গরম করে ভাজাপোড়ার সবকিছু আমিই করে দিলাম। সবকিছু মানে, সব কিছু। সামনে যা ছিল সব কিছু।

কী না ভেজেছি! পিয়াজু ভাঁজলাম, স্যান্ডউইচের মাংশ ভাঁজলাম। ভাঁজাপোড়ায় সবচেয়ে রিস্ক হলো নিজের গায়ের কাপড়চোপড় রক্ষা করা। ভূনা করার সময় ছ্যাৎ ছ্যাৎ করে মশলার ছিঁটেফোটা কখন যে গাঁয়ে এসে পড়বে বলা মুশকিল। হাতে এসে পড়লে চামড়ায় ফোসকা পড়ে। ভাঁজাপোড়া কি চাট্টিখানি কথা! পিয়াজু বারবার উল্টেপাল্টে দাও। একবার জ্বাল বাড়াও; একবার কমাও। গরম তেলে কিছু করা বিশাল এক কৌশলী কর্ম। প্রকৌশলীদের চাইতেও কৌশলী। অথচ কোন কিছুর কোন মূল্য দিল না!

অবশ্য মূল্য আমার কোনকালেই ছিল না। সংসার জীবনে আজো আমি মূল্যহীনই রয়ে গেলাম। আর খেলাম ঝারি। ঠান্ডা ঝারি, গরম ঝারি। আজ খেয়েছি মহা ঝারি! ইফতারির সময় হয়ে এসেছে। তাড়াহুড়া করে টেবিলে সবকিছু সাজিয়ে রাখছি। রান্নাঘর থেকে এনে এনে রাখছি। এদিকে আযান দেবে দেবে করছে। মোবাইলের আযান। প্রবাসে তো মসজিদের আযান শোনার কপাল নেই। আগেও ছিল না। করোনা দিনেও নেই।

হঠাৎ আযান নয়, ঝারিতে সম্বিত ফিরে পেলাম। এবং বুঝলাম রাগটা কী নিয়ে। রাগটা বড় হলেও রাগের কারণটা আসলে অতীব ছোট। ছোট্ট একটা ভুল। আমার দ্বারা সাধিত ভেরী সিম্পল ভুল। ভুল করে সালাদের ড্রেসিং মনে করে সালাদে হ্যান্ডসোপ ঢেলে দিয়েছি। হ্যান্ডসোপ মানে হাত দোয়ার তরল সাবান। এটা একটা ভুল হলো! রংয়ে এবং গন্ধে দেখতে প্রায় একই রকম। একই জায়গায় পাশাপাশি রাখা। ব্যাস এতেই ঝারি! রমজানের প্রথম ঝারি!

রমজান আসেই ঝারির বার্তা নিয়ে। ছোটবেলায়, মানে পাঁচ-ছয় বছর বয়সে স্পেশাল ঝারি খেতাম রমজানে। আন্ডাবাচ্চা দলের বিশেষ সদস্য হিসেবে মসজিদের শেষ কাতারে জায়গা হতো। শেষ কাতার আবার এক দাঁড়ায় দাঁড়াতো না। হয়ত প্রথম রাকাতে দাঁড়িয়েছি ৩য় কাতারে; শেষ কাতার হিসেবে। কিন্তু নামাজ শুরুর পরও মুসুল্লী আসতে থাকতো। মুসুল্লী আসে আর আমাদের ধরে ধরে পেছনে পাঠায়। এভাবে পেছাতে পেছাতে আরো চার-পাঁচ কাতার পেছনে চলে যেতাম।

কিন্তু ভদ্র হতাম না। শিশুমনের জানা যত দুষ্টামী আর ইতরামী সব নামাজের জামাতেই করতাম। খতম তারাবিহর জামাত। লম্বা সুরার লম্বা জামাত। প্রতি দুরাকাত নামাজের প্রথম রাকাতের প্রায় পুরো সময় বসে থাকতাম। আর খেয়াল রাখতাম ইমাম সাহেব সুরা পড়তে পড়তে লম্বা টান কখন টানেন। লম্বা টান আসলেই নড়েচড়ে বসতাম। এই বুঝি রুকুতে যাবার সময় হলো।

তবে সব লম্বাটানে সব সময় রুকুতে যাওয়া হতো না। লম্বাটান শুনেই নিয়্যত করে হাতবেঁধে দাঁড়িয়ে যেতাম। ওমা! সুরা তো আর শেষ হয় না! হুজুরের রুকুতে যাবার নামগন্ধও নেই। অগত্যা মোচরামুচরি শুরু হতো। বেশী সমস্যা হতো ২য় রাকাত নিয়ে। ওখানে ফাঁকি মারার উপায় ছিল না। তবে ল্যাং মারতাম পাশের পিচ্চিকে। পিচ্চি হেসে উঠতো। হাসতে যেয়ে পু বের হয়ে যেত। সাংঘাতিক কান্ড। পু থামে; কিন্তু হাসি আর থামে না।

অগত্যা নামাজ শেষে ঝারি। বড়দের ঝারি!! আজ এই রমজানে ছোটবড় সব চুপ! কেউ আর কাউকে ঝারি দেয় না। কেউ আর মসজিদে খতম তারাবিহতে যায় না। সবাই ঘরে বসে নামাজ পড়ছে। যুদ্ধকালীন তারাবিহ নামাজ। আর যুদ্ধ ভাইরাসের বিরুদ্ধে। যে যুদ্ধ আমি শুরু করেছিলাম আরো দেড় বছর আগে। ভীষণ আতঙ্ক নিয়ে জটিল এক ভাইরাসের বিরুদ্ধে কঠিন এক যুদ্ধ। একা একা জীবন যুদ্ধ। বাঁচা মরার লড়াই।

এক সময় লড়তে লড়তে জয়ী হলাম। সুস্থ হলাম। কিন্তু আমিও সুস্থ হলাম আর ঠিক তখনই পুরো পৃথিবী অসুস্থ হলো। শান্ত পৃথিবী অশান্ত হলো। এক ভাইরাস থেকে মুক্তি না মিলতেই পড়লাম আর এক ভাইরাসের হাতে। মরণ ভাইরাস আমার পিছুই ছাড়ছে না। যদিও আজ আমি একা নই। সমগ্র পৃথিবীর সমস্ত মানুষ আমার সাথে। আমার মতই এ যুদ্ধে সামিল হয়েছে। একদিন আমার একার কষ্ট কেউ বুঝতো না। বোঝার কথাও না। আজ আমি সবার কষ্ট বুঝি। বোঝার মত সামান্য অভিজ্ঞতা হয়েছে বলেই হয়ত বুঝি!!!

হয়ত সবাই আমার কষ্টও বোঝে। শুধু বুঝলো না বড় ধর্নাঢ্য ব্যবসায়ী, এনজিও আর মোবাইল অপারেটররা। ওরা নেই দুর্দিনের মানুষের পাশে। এইসব মানুষদের কাজ নেই, আয় নেই; ফুরিয়েছে সঞ্চয়ও। ঘর বন্দি জীবন, চুলায় পাতিল চড়ে না। ফলে ক্ষুধার্ত মানুষ প্রাণনাশী করোনার প্রতিরোধ ভেঙে, সামাজিক দুরত্বকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নেমে এসেছেন রাস্তায়।

ওদের রাজনৈতিক কোন দাবী নেই। অভিলাশও নেই। দাবী শুধু একটাই; দুবেলা দুমুঠো খাবার। সংকটকালে এসব নিরন্ন মানুষের পাশে যাদের থাকার কথা ছিল, বাস্তবে তারা কেউ পাশে নেই। তাদের কারো দেখা নেই। দেখা হবার সম্ভাবনাও নেই। আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব না পেলেও, ঢাকার নবনির্বাচিত দুই মেয়র কদিন আগে নগরীর অলি গলিতে হাঁক ডাক দিলেও, এখন তাদের সাড়াশব্দ নেই।

বিভিন্ন সময় পরামর্শের নামে বিভিন্ন উদ্ভট প্রেসক্রিপশন নিয়ে হাজির হলেও এই বৈশ্বিক দুর্যোগে মুখে কলুপ এটে নিশ্চুপ বেশিরভাগ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। সামর্থ্য থাকলেও সহযোগিতার হাত বাড়াচ্ছেন না তারা। ঘরে ছিটকানী টেনে থিতু হয়েছেন। সমাজের ধনী বড় ব্যবসায়ীরাও বসে নেই। তারাও হাত গুটিয়ে শুয়ে আছেন।

তবে এগিয়ে এসেছে পুলিশ। সারা বছর তাদের নিয়ে মিডিয়ায় যত সমালোচনাই হোক, এবার পুলিশ বাহিনী দেখিয়ে দিয়েছে তারাই সেরা। করোনা নিয়ন্ত্রণে সারাদেশে পুলিশের আন্তরিক চেষ্টা আসলেই আমাকে বিমোহিত করেছে। প্রথমদিকে আমার ধারণা ছিল ভিন্ন। ভেবেছিলাম পুলিশের কিছু লোক এই সুযোগে মানুষকে হয়রানি করা শুরু করবে। কিন্তু মাঠে ময়দানের যে খবর পাচ্ছি, তাতে আমার ধারণা পালটে গেছে। পুলিশ অপ্রত্যাশিত আন্তরিকতায় মহামারি বিস্তার রোধে কাজ করছে। কাজের মত কাজ বীরের মত করছে।

করোনা মহামারিতে বাংলাদেশ পুলিশের পারফরমেন্স দেশবাসীর নজর কেড়েছে। অসাধারণ ভালো হচ্ছে তাদের সকল কর্মকান্ড। পুলিশ বাহিনী যে এতো ভালো করবে সেটা কল্পনাও করিনি। আমি করিনি। আমরাত্ত করিনি। কেউই করিনি। এ জন্যেই পুলিশ বাহিনীর প্রশংসায় ভাসছে সারা দেশ। ভাসাবার মত কাজ তারা করছে বলেই কিছুটা হলেও নিন্দুকের জাতি হিসেবে নিজেদের অবস্থান পাল্টাতে পারছে বাঙালী।

পুলিশ সদস্যরা ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা একটানা কাজ করছেন। আক্রান্তদের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন। যারা মারা গেছেন তাদের অনেকের সৎকার করেছেন। বাড়িতে বাড়িতে খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দেয়া, পাড়া-মহল্লায় সচেতনতা সৃষ্টির পরও তারা বিভিন্ন স্থানে জীবানুনাশক স্প্রে করছেন। আর এসব আমাদের আমজনতাকে করছে সাহসী। বাড়ছে বেঁচে থাকার আত্মবিশ্বাস আর অমিত সম্ভাবনা।

করোনা থেকে মুক্তির সমভাবনার আশা এই রমজানে করতেই পারি। রমজান তো মাগফেরাতের মাস। নাজাত প্রাপ্তির মাস। রহমতের মাস। এবারের রমজানও নিশ্চয়ই এসেছে রহমতের বাতা নিয়ে। পবিএ এই রমজানের উসিলায় বিশ্ববাসী নাজাত লাভ করুক; মুক্তিলাভ করুক মরণকামড় দেয়া এই মহামারী থেকে। সারাক্ষণ শুধু এই কামনা করি। এই প্রার্থনা করি। আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা ছাড়া আর যে কোন ক্ষমতা নেই আমার!!! চলবে...

 

সম্পাদক ও প্রকাশক: সরদার মোঃ শাহীন
উপদেষ্টা সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম সুজন
বার্তা সম্পাদক: ফোয়ারা ইয়াছমিন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: আবু মুসা
সহ: সম্পাদক: মোঃ শামছুজ্জামান

প্রকাশক কর্তৃক সিমেক ফাউন্ডেশন এর পক্ষে
বিএস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড,
ওয়ারী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০ হতে প্রকাশিত।

বানিজ্যিক অফিস: ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
বার্তা বিভাগ: বাড়ি # ৩৩, রোড # ১৫, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
ফোন: ০১৮৯৬০৫৭৯৯৯
Email: simecnews@gmail.com