মুক্তিযুদ্ধকালে বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন
প্রকাশের সময় : 2021-03-18 11:45:01 | প্রকাশক :
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে সামরিক জিপে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। সেই রাতে তাকে আটক রাখা হয় তৎকালীন আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল, বর্তমান শহীদ আনোয়ার উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে। পরদিন তাকে নেয়া হয় ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউজে, সেখান থেকে অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে বিমানে করাচি নেয়া হয়। করাচি বিমানবন্দরে পেছনে দাঁড়ানো দুই পুলিশ কর্মকর্তার সামনের আসনে বসা বঙ্গবন্ধুর ছবি পরদিন সব দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হয়। করাচি থেকে কঠোর গোপনীয়তায় বঙ্গবন্ধুকে নেয়া হয় লাহোরের ৮০ মাইল দূরের লায়ালপুর শহরের কারাগারে। বঙ্গবন্ধুকে আটক রাখা হয়েছিল নিঃসঙ্গ সেলে, গরমে তেতে উঠা সেই কারাকক্ষে কোন পাখাও ছিল না। পাকিস্তানি কারাগারে বঙ্গবন্ধুর আটক থাকার প্রথম স্বীকৃতি মেলে ১৯ জুলাই ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-এ প্রকাশিত ছোট্ট খবরে।
এরপর ৮ আগস্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান সানডে টাইমসকে জানান, পশ্চিম পাকিস্তানের সর্বোচ্চ শ্রেণীর কারাগারে আটক শেখ মুজিব জীবিত ও সুস্থ আছেন। জেনারেল ইয়াহিয়া আরও বলেন, আজকের পর শেখ মুজিবের জীবনে কী হবে, সে বিষয়ে তিনি ওয়াদা করে কিছু বলতে পারেন না।
বলা হয়, আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে দেশদ্রোহের অভিযোগে শেখ মুজিবের বিচার শুরু হবে। এতে সর্বোচ্চ শাস্তি ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদন্ড। সেই সময়ের কষ্টকর অভিজ্ঞতার সামান্য ছায়াপাত মেলে বঙ্গবন্ধুর কারাগারে লেখা ডায়েরিতে, কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থে তিনি লিখেছিলেন, ‘লেখাপড়া করতে ইচ্ছা হয় না। সময়ও কাটে না, জেলে রাতটাই বেশি কষ্টের। আবার যারা আমার মতো একাকী নির্জন স্থানে থাকতে বাধ্য হয় যাকে ইংরেজিতে বলে সলিটারি কনফাইনমেন্ট তাদের অবস্থা কল্পনা করা যায় না।’
বঙ্গবন্ধুর বিচারে সরকারের দিক থেকে প্রবীণ আইনজীবী একে ব্রোহিকে অভিযুক্তের (বঙ্গবন্ধু) পক্ষে মামলা পরিচালনায় নিয়োগ দেয়া হয়। আদালতের কার্যক্রমের শুরুতে ১২ দফা অভিযোগনামা পড়ে শোনানো হয়। এরমধ্যে ছিল রাষ্ট্রদ্রোহ, সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ইত্যাদি বিভিন্ন অভিযোগ। ছয়টি অপরাধের জন্য শাস্তি ছিল মৃত্যুদন্ড। আদালতে ইয়াহিয়া খানের ২৬ মার্চ প্রদত্ত ভাষণের টেপ বাজিয়ে শোনানো হয়। সেই বক্তব্য শোনার পর বঙ্গবন্ধু আদালতের কোন কার্যক্রমে অংশ নেয়া এবং তার পক্ষে কৌশলী নিয়োগে অস্বীকৃতি জানান।
ডেভিড ফ্রস্টকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘সরকারের তরফ থেকে গোড়ায় এক উকিল দিয়েছিল। কিন্তু আমি যখন দেখলাম, অবস্থাটা এমন যে, যুক্তির কোন দাম নেই, দেখলাম এ হচ্ছে বিচারের এক প্রহসন মাত্র। তখন আমি কোর্টে নিজে দাঁড়িয়ে বললাম, জনাব বিচারপতি, দয়া করে আমাকে সমর্থনকারী উকিল সাহেবদের যেতে বলুন। আপনারা বিলক্ষণ জানেন, এ হচ্ছে এক গোপন বিচার। আমি বেসামরিক লোক। আমি সামরিক লোক নই। আর এরা করছে আমার কোর্ট মার্শাল। ইয়াহিয়া খান কেবল যে প্রেসিডেন্ট তাই নয়, তিনি প্রধান সামরিক শাসকও। এ বিচারের রায় অনুমোদনের কর্তা তিনি। এই আদালত গঠন করেছেন তিনি।’
গোটা বিচারকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কার্যত আদালতের দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসে ছিলেন। আদালত কক্ষে যা কিছু ঘটেছে, তা তিনি নিস্পৃহতা দিয়ে বরণ করেছিলেন, বিচার প্রক্রিয়ায় আত্মপক্ষ সমর্থন তো দূরের কথা, কোন কার্যক্রমেই অংশ নেননি। এ ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতিবাদী প্রত্যাখ্যানের লড়াইয়ের আরেক প্রকাশ। পরদিন ৪ ডিসেম্বর সামরিক আদালত বিচারের রায় ঘোষণা করে, মৃত্যুদন্ডাদেশ দেয়া হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে। আদালতের কার্যক্রম শেষে তাকে নেয়া হয় মিয়ানওয়ালি জেলে। সেখানে দন্ডাদেশ কার্যকর করার ব্যবস্থা নেয়া হতে থাকে। যে সেলে তিনি ছিলেন, তার পাশে কবরও খোঁড়া হয়।
এদিকে ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান বিমানবাহিনী ভারতের কয়েকটি সামরিক বিমানঘাঁটি আক্রমণ করলে শুরু হয় সর্বাত্মক যুদ্ধ। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকার রেসকোর্সে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সর্বাত্মক পরাজয়ের পর ২৪ ডিসেম্বর একটি হেলিকপ্টারে বঙ্গবন্ধুকে রাওয়ালপিন্ডির অদূরে শিহালা পুলিশ একাডেমিতে নিয়ে যাওয়া হয়।
সেখানে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো। বঙ্গবন্ধু তাকে প্রশ্ন করেন, তাকেও বন্দী করা হয়েছে কিনা। জবাবে ভুট্টো বলেন, তিনি এখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। কিভাবে তুমি প্রেসিডেন্ট হও, যেখানে তোমার চেয়ে নির্বাচনে আমি দ্বিগুণ আসন পেয়েছি, হেসে জানতে চান বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুকে ভুট্টো উত্তর দেন, তুমি যদি চাও তাহলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারো। দৃঢ়কণ্ঠে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু জবাব দিয়েছিলেন, ‘না, আমি চাই না। তবে যত দ্রুত সম্ভব আমি বাংলাদেশে ফিরে যেতে চাই।’
বঙ্গবন্ধুকে ভুট্টো জানান, এজন্য যাবতীয় ব্যবস্থা তিনি নেবেন, তবে তার জন্য কয়েকদিন সময় লাগবে। সে সময় বঙ্গবন্ধু বলেন, কয়েক মাস আগে তার বিচারে যেসব আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন তাদের কথোপকথনে তিনি জানতে পেরেছেন ডঃ কামাল হোসেনও বিচারের অপেক্ষায় কারাগারে বন্দী। এরপর বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে ড. কামাল হোসেনকেও শিহালাতে নিয়ে যাওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু ও ডঃ কামালকে বলা হয়েছিল, পরবর্তী কয়েকদিনের মধ্যে তারা লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন। আরও জানানো হয়, লন্ডনে যাওয়ার আগে তাদের সৌজন্যে প্রেসিডেন্টের অতিথি ভবনে ভুট্টো নৈশভোজের আয়োজন করতে চান। ভুট্টো আসেন এবং কুশলাদি বিনিময়ের পর বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেন, তিনি যেন পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখেন। বঙ্গবন্ধু উত্তর দেন, ‘তুমি যদি আমাদের কথা শুনতে তবে রক্তপাত এড়ানো যেতো এবং পরবর্তীতে যা কিছু ঘটেছে তাও। কিন্তু তুমি নির্মম সশস্ত্র হামলা চালিয়েছ। দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের মধ্যে যে সম্পর্ক তাছাড়া আর কিভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে পারে তা আমি জানি না।’ ভুট্টো বারবার বঙ্গবন্ধুকে তার অনুরোধ পুনর্বিবেচনার কথা জানালে বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার পর তিনি এর উত্তর দেবেন।
তারপরই ভুট্টো এক অনাকাক্সিক্ষত প্রস্তাব রাখেন। তিনি জানান, ইরানের শাহ পাকিস্তান সফরে আসছেন এবং তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে চান। আর এ কারণে বঙ্গবন্ধুর যাত্রা পরদিন সকাল পর্যন্ত পেছাতে পারে। এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বঙ্গবন্ধু ভুট্টোকে বলেন, রাতেই তাদের যাত্রার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে এবং জানান ইরানের শাহের সঙ্গে দেখা করার কোন ইচ্ছা তার নেই। বঙ্গবন্ধুর ক্ষোভ বুঝতে পেরে ভুট্টো জানান, নৈশভোজের পরেই করাচি থেকে তাদের যাত্রার নির্দেশ দেয়া হবে।
বঙ্গবন্ধু ও ডঃ কামাল হোসেনকে এরপর বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুকে উড়োজাহাজ পর্যন্ত এগিয়ে দেন ভুট্টো। তাদের বলা হয়, যাত্রা সম্পর্কে এখনই কিছু জানানো হবে না, যখন লন্ডন থেকে ঘণ্টাখানেকের দূরত্বে থাকবে উড়োজাহাজ তখন ঘোষণা দেয়া হবে। যখন তারা লন্ডনের কাছাকাছি পৌঁছাবেন, তখন ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে একটি বার্তা পাঠানো হবে, যাতে থাকবে বঙ্গবন্ধু সকাল সাতটার দিকে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছাবেন।
৯ জানুয়ারি ১৯৭২, ভোর ছয়টায় লন্ডন হিথ্রো বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে পৌঁছালেন বঙ্গবন্ধু। তাকে স্বাগত জানালেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ বিভাগের কর্মকর্তা ইয়ান সাদারল্যান্ড ও লন্ডনে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার আপা বি পন্থ। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে শেখ মুজিবের বৈঠকের ব্যবস্থা করে দিলেন ইয়ান। আর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তার যোগাযোগ করিয়ে দেন আপা বি পন্থ। লন্ডন থেকে দিল্লী হয়ে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন। - সূত্র: অনলাইন