করোনা দিনের ডায়েরি...
প্রকাশের সময় : 2021-04-15 12:14:07 | প্রকাশক : Administration
১৭তম পর্ব
ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীন
প্রতিদিন করোনা নিয়ে রোজকার নামচা বা ডায়েরী আর কী লিখবো! ঘুরেফিরে ডায়েরীতে সব একই কথা আসে। মিডিয়া, মিডিয়া আর মিডিয়া। আমার বিবেচনায় করোনা ততটা ক্ষতি করতে পারছে না আমাদের, যতটা ক্ষতি করছে মিডিয়া। হয়ত এজন্যে লিখতে বসলেই মিডিয়ার বিপক্ষে চলে যায় সব কথা। পক্ষে যাবার কথা থাকলে অবশ্যই পক্ষে যেত। নাই বলেই বিপক্ষে যায়। না যেয়ে উপায়ও নেই।
বর্তমানে মিডিয়া পাড়ায় একটা হাউকাউ শুরু হয়ে গেছে। যেনতেন হাউকাউ নয়, মহা হাউকাউ। হাউকাউয়ের মূল কথা একটাই; এবার দেশটা শেষ। লকডাউন শিথিল করে সরকার মহাঝুঁকি নিয়ে ফেলেছে। দেশের আঁতেল, পন্ডিত আর বুদ্ধিজীবি সমাজ এই ঝুঁকি নিয়ে মহাঅস্থির। যারা নিজেরা ঝুঁকি নিতে জানে না, তারা সরকারের ঝুঁকি নিয়ে অস্থির হবে এটাই স্বাভাবিক। কেবল অস্বাভাবিক হলো, যারা ব্যবসা বোঝে না, অর্থনীতি বোঝে না, শিল্প বোঝে না, এমনকি মহামারী করোনার ক’ও বোঝে না, তারাই এখন এসব বিষয়ে মহাপন্ডিতের মত কথা বলছে।
কথা বলা এদের মজ্জাগত স্বভাব। ঘটনা ঘটতে দেরী হয়, এদের মুখ খুলতে দেরী হয় না। মুখ খুলে পটর পটর করবেই। অবশ্য কথাজীবিদের সুবিধে আছে মেলা। নিজেদের কিছু করতে হয় না; জীবনের ঝুঁকিও নিতে হয় না। শুধু কথা বলেই খালাস। মাফি খালাস। জীবনভর কেবল কথা বলার চাকুরী করেছে; কাউকে একটা চাকুরী দেয়নি। কখনও সাহস করেনি; সাহসীও করেনি কাউকে। এরাই এখন বুলি আওড়ায়, চাপাবাজি করে।
স্বার্থপরের মত এরা সারাটি জীবন কেবল নিজের জীবন নিয়ে ভেবেছে; সমাজ তথা রাষ্ট্রের কথা ভাবেনি। তারাই এখন মহাপন্ডিত সেজে দেশের কথা ভাবে। ভাবে মানে, ভাবার ভাব দেখায়। জীবনে কোনদিন রৌদ্রে পোড়েনি, বৃষ্টিতে ভেজেনি। এমন কি শীতেও কাঁপেনি। শুধু চারদেয়ালে বন্দি থেকেছে। আজও সারাদিন শীততাপ নিয়ন্ত্রিত চারদেয়ালে বন্দি থেকে চুকচুক করে টেবিলভর্তি খাবার খায় আর পুকপুক করে হাগে।
ইংলিশ কমোডে হাগে। হাগে আর ভাবে। নিশ্চিন্তে ভাবে, দেশের সব মানুষের হালহকিকত হুবহু তাদের মতই। তাদের মতই স্বাচ্ছল্য আর চাকচিক্যে ভরা। ভাবে, আজও দেশবাসী তাদের মত করেই খেয়েদেয়ে অপেক্ষায় আছে ইংলিশ কমোডে হাগার। পেট এ একটু চাগান দিলেই আর অপেক্ষা নয়। ঢুকবে টয়লেট এ। আরাম করে কাপড় গুছিয়ে, হিপটা একটু এলিয়ে আসন ঠিক করে কমোডে বসবে। সত্যি বলতে তাদের কারোরই জীবিকা নিয়ে ভাবনা নেই। কেবলই জীবন নিয়ে ভাবনা। করোনার এই কঠিন সময়ে জীবন এবং জীবিকার বর্তমান যুদ্ধ তাদের কাছে মূল্যহীন।
রাতটাও এদের কাছে মূল্যহীন। মূল্যহীন রাতের মহিমা। এরা কখনোই রাতে ঘুমায় না। ঘুমায় দিনে। নাক ডেকে দিনভর ঘুমিয়ে ওঠে সন্ধ্যার আগে আগে। দিনভর দেশে কী হলো, তার কিচ্ছু জানে না। জানার চেষ্টাও করে না। আলু আলু চেহারা নিয়ে সাজুগুজু করে দৌঁড়ে টিভি চ্যানেলে যায়। ক্লান্তিহীন দৌঁড়। ভোর হওয়া পর্যন্ত একটার পর একটা চ্যানেলে দৌঁড়াতেই থাকে। হাজির হয় নেগেটিভ খবরের অন্যতম বিশ্লেষক হয়ে।
বিশ্লেষক সাজলেও মূলত জানে না কিচ্ছু। এমন কি ভাল করে বিশ্লেষণ করতেও জানে না। জানার ভান্ডারে তথ্য থাকে খুবই কম। যতটুকুই বা থাকে, সবটুকুই কেবল নেগেটিভ তথ্য। নেগেটিভ তথ্য পেলে পড়ার জন্যে হামলে পড়ে। পজেটিভ তথ্য সামনে পেলেও পড়ে না। পড়ার চেষ্টাও করে না। সারাদিন দেশে ভাল কিছু হলো কি না, কিচ্ছু জানে না। জানার চেষ্টাও করে না। করোনা নিয়ে সরকার কেন ঝুঁকি নিল সেটাও জানে না।
ঝুঁকি তো সরকারকেই নিতে হবে। সরকার বুঝেশুনেই ঝুকি নিচ্ছে। পরিষ্কারভাবে সরকার মনে করছে, বাংলাদেশের করোনা সংক্রমণ খুব বড় ধরণের নয়। ইতালি-স্পেন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত তো নয়ই। এখানে এক লাফে অনেক বেশি বৃদ্ধিও হচ্ছে না। আবার প্রতি ২৪ ঘণ্টায় বিশাল সংখ্যক রোগী শনাক্তও হচ্ছে না। এ কারণে বাংলাদেশে মহামারির সংখ্যা কম এবং পরিস্থিতি যথেষ্ঠ রকমের নাগালের মধ্যে আছে।
চমৎকার লিখেছে এসব নিয়ে বাংলা ইনসাইডার। ইনসাইডার বলেছে, “দোকানপাট খুলে দেয়া এবং লক ডাউন শিথিলের সিদ্ধান্ত নিতে অনুপ্রাণিত করেছে আংশিক মৃত্যুর তথ্যটি। এখন পর্যন্ত করোনায় বাংলাদেশে মোট মারা গেছে ২০৬ জন। ১৩ হাজারের বেশি আক্রান্তের দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে মৃত্যুহার অনেক কম এবং মৃত্যুহারের লাগামটা টেনে এসেছে। সতর্কতার সাথে জীবন ও জীবিকার সমন্বয় সাধনে কোন গুরুতর সমস্যা হবে না।
বাংলাদেশে করোনার অধিকাংশ রোগীর চিকিৎসা হচ্ছে বাড়িতে এবং গুরুতর অসুস্থ বা কঠিন উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীর সংখ্যা অত্যন্ত কম। রোগীরা বাড়িতে থেকে চিকিৎসা করছে এবং নিজ দায়িত্বে নিয়মকানুন মেনে সুস্থ হয়ে উঠছে। এতে প্রমাণ হয়েছে, করোনা মরণঘাতী ব্যাধি; তবে মহামারী ব্যাধি নয়। করোনা যাকে ধরে, তাকেই শেষ করে দেয় না। কষ্ট দেয়; কিন্তু জীবনকে শেষ করে দেয় না। করোনা আক্রান্তদের মৃত্যুহার এখনো ১ দশমিক ৩ শতাংশ।
করোনায় পোশাক শিল্পের বাজার নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি শীতল যুদ্ধ চলছে বাংলাদেশ এবং ভিয়েতনামের সঙ্গে। বাংলাদেশ যদি বর্তমান অর্ডারগুলো সম্পূর্ণ করতে না পারতো, তাহলে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের বাজার ধ্বংস হয়ে যেত। বাজারটি ভিয়েতনামে চলে যেত। কারণ ভিয়েতনামে করোনার প্রকোপ কম এবং তারা ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক বাজার দখলে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এই জন্যেই বাংলাদেশকে ঝুঁকি সত্ত্বেও গার্মেন্টসগুলো খুলে দিতে হয়েছে।
এতেই আঁতে ঘা লেগেছে বাংলাদেশে থাকা ভিয়েতনামী দালালদের। এদের মাথায় বাজ পড়েছে। এরা সারা বছর দালালী ভাতা পায় বিভিন্ন বিদেশী এজেন্টদের কাছ থেকে। দেশে থাকা বিভিন্ন এনজিও এদেরকে পয়সা দিয়ে কিনে রাখে। এরা ওদের ভাড়ায় খাটে। যখন যার পক্ষে বলা লাগে বলে। যার বিপক্ষে বলা লাগে বলে। বিদেশী প্রভুরা এদেরকে কেনে কেবল ওদের স্বার্থ উদ্ধার করে দেশের বারোটা বাজাবার জন্যে। দেশের ক্ষতি হলে এদের কিচ্ছু আসে যায় না।
বাংলাদেশে করোনার কারণে সব থেকে বড় ক্ষতি হয়েছে বিদেশের চাকরী বাজারে। অভিবাসনে একটি বড় ধরণের ধ্বস নেমেছে। বিদেশ থেকে ফেরত আসা বাংলাদেশের শ্রমিকদের নতুন করে চাকরি পাওয়া এবং নতুন করে বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে একটি দীর্ঘসূত্রিতা শুরু হবে। বেশ কিছুদিন এই খারাপ অবস্থা চলবে। কাজেই বাংলাদেশে রেমিটেন্সের প্রধান দুটি অবলম্বনের একটি নিশ্চিতভাবেই শেষ হয়ে যাচ্ছে এবং দ্বিতীয়টি যদি শেষ হয়ে যায় তাহলে আমাদের অর্থনীতির অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হবে। একারণেই সরকার এই ঝুঁকি নিয়েছে।
সরকার ঝুঁকি নিতে বাধ্য। বাধ্য খুলতেও। সরকারকে সবকিছু বিবেচনায় রাখতে হয়। কখনো একপেশে চিন্তা করতে পারে না সরকার। মানুষের জীবনের চিন্তা যেমনি করতে হয়, জীবিকার চিন্তাও করতে হয়। তথাকথিত আঁতেলদের করতে হয় না। আঁতেলদের জন্ম হয়েছে কেবল আঁতলামি করার জন্যে। দেশের মানুষের পাশে দাঁড়াবার জন্যে নয়। না মানুষের জীবনের জন্যে, না জীবিকার জন্যে!!! চলবে...