মেট্রোরেল যুগের সূচনা
প্রকাশের সময় : 2023-01-04 16:51:06 | প্রকাশক : Administration
প্রায় দুই কোটি মানুষের নগরীতে মেট্রোরেল ছিল স্বপ্নের মতো। সেই স্বপ্ন আজ সত্যি হলো। নগরীর বুকে গড়ালো মেট্রোরেলের চাকা। সূচনা ঘটল মেট্রোরেল যুগের। সবুজ পতাকা নাড়িয়ে যোগাযোগব্যবস্থার এই নতুন অধ্যায়ের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মেট্রোরেলের প্রথম যাত্রী হিসেবে ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে টিকিট কাটেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর উত্তরার দিয়াবাড়ি স্টেশন থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ভ্রমণ করেন তাঁরা। প্রথম যাত্রায় প্রধানমন্ত্রীর ভ্রমণসঙ্গী হয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থী, মসজিদের ইমাম, পোশাককর্মী, রিক্সাচালক, সবজি বিক্রেতা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধি, ব্যবসায়ী আর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা।
এ সময় উত্তরা-মিরপুর এলাকার রেলপথ, সুদৃশ্য স্টেশন এবং ঝকঝকে রাস্তা তাক লাগিয়ে দিয়েছে চোখে। প্রকল্প বাস্তবায়নকালীন দুর্বিষহ দিন পেছনে ফেলে উচ্ছ্বসিত ছিলেন মানুষ। এদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকেও অনেকে মেট্রোরেল দেখতে এসেছিলেন। সরকারের এ সাফল্যে তাদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা গেছে। বুধবার সকালে মেট্রোরেলের উদ্বোধনের পর সুধী সমাবেশ শেষে দুপুর দেড়টায় মেট্রোরেলের উত্তরা উত্তর স্টেশনে গিয়ে ফটোসেশনে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী। পরে সেখানে বৃক্ষরোপণ করেন এবং দোয়া ও মোনাজাতে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী ১টা ৩৪ মিনিটে টিকিট কাটেন। নিজে অর্থ পরিশোধ করেন।
ওই সময় শেখ রেহানাও তাঁর টিকিট কাটেন। ওই সময় তাঁদের হাতে মেট্রোরেলের কার্ড দেয়া হয়। সেটি তুলে ধরে ছবি তোলেন তাঁরা। এরপর ১টা ৪০ মিনিটের দিকে সবুজ পতাকা নাড়িয়ে যোগাযোগব্যবস্থার এই নতুন অধ্যায়ের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে ট্রেনটি ১টা ৫৪ মিনিটে যাত্রা শুরু করে।
প্রধানমন্ত্রী ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে সব বগি ঘুরে দেখেন। ট্রেনটি ২টা ১১ মিনিটে আগারগাঁও স্টেশনে পৌঁছায়। আগারগাঁও স্টেশনে নেমে গাড়িতে নিজ বাসভবন গণভবনের উদ্দেশ্যে রওনা হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মেট্রোরেলের প্রথম যাত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পেয়ে গর্ববোধ করেন রেলের প্রথম নারীচালক মরিয়ম আফিজা। বুধবার বাংলাদেশের মেট্রোরেল উদ্বোধনের পর রেল চালিয়ে আগারগাঁও আসার পর সাংবাদিকদের কাছে তার এই অনুভূতির কথা প্রকাশ করেন। মরিয়ম আফিজা বলেন, দেশবাসী স্বপ্নপূরণের জন্য যেমন অপেক্ষায় ছিল তেমনই আমাদেরও অনেক প্রস্তুতি ছিল। সবকিছু সফল হয়েছে আজকের মেট্রোরেল উদ্বোধনের পর। প্রধানমন্ত্রী এই যাত্রায় সঙ্গী ছিলেন, পুরো দেশবাসীর মতো আমিও অনেক গর্ববোধ করছি।
নারীরা এখন আর কোথাও পিছিয়ে নেই মন্তব্য করে মেট্রোরেলের প্রথম এই নারীচালক বলেন, আজ প্লেনের পাইলট থেকে শুরু করে জাহাজের ক্যাপ্টেন সবক্ষেত্রেই নারীরা তাদের অবদান রাখছেন। নারীরা দেশ চালাচ্ছে, ঘর চালাচ্ছে। করপোরেট সেক্টরও নারীরা চালাচ্ছে। তাই আমি মনে করি না নারীরা এখন আর পিছিয়ে আছে। সব সেক্টরে নারীরা সমানভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। মরিয়ম আফিজা বলেন, আমাদের যে স্বপ্ন ছিল আমরা একটা ডিজিটাল ট্রান্সপোর্টের দিকে যাব, তার একটি অংশ হতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত।
উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে মেট্রোরেলের যাত্রা শুরুর অনুষ্ঠানে সর্বসাধারণের ঢোকার সুযোগ ছিল না, তারপরও স্টেশনের বাইরে উপস্থিত হয়ে ঢাকায় এই নতুনের শুরুর সাক্ষী হলেন অনেকে। উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে প্রধানমন্ত্রী এবং নির্বাচিত নাগরিকদের নিয়ে মেট্রোরেলের প্রথম যাত্রা আগারগাঁও স্টেশনে এসে শেষ হয়। তবে উদ্বোধন অনুষ্ঠানের স্থান দিয়াবাড়ি প্রান্তের উত্তরা নর্থ স্টেশনের বাইরে যেমন জড়ো হয়েছিলেন অনেকে, একই চিত্র ছিল আগারগাঁওয়ে। ব্যানার-ফেস্টুন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সচকিত উপস্থিতি এবং গণমাধ্যমকর্মীদের ব্যস্ততায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কিছুটা আমেজ আগারগাঁওয়ে এসে পড়েছিল।
আগারগাঁওয়ে দেখা মিলল দেশের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের জেলা নওগাঁর জেসমিন আরার। এক সপ্তাহ ধরে তিনি ঢাকায় অবস্থান করছেন শুধু এই অনুষ্ঠানটি সচক্ষে দেখার জন্য। উচ্ছ্বসিত জেসমিন বলেন, ‘আমাদের জন্য এত বড় আনন্দ আর দ্বিতীয়টি নেই। বাংলাদেশের এত বড় অর্জনের সাক্ষী হতে এক সপ্তাহ ধরে আমি ঢাকায় অবস্থান করছি। সময়ের অভাবে উত্তরার দিয়াবাড়ি যেতে পারিনি। তাই এখানে দাঁড়িয়েছি যদি প্রধানমন্ত্রী যাওয়ার সময় তাঁকে এক নজর দেখা যায়।’
মেট্রোরেলের প্রতিটি কোচ তৈরি হয়েছে স্টেইনলেস স্টিল দিয়ে। জাপানের বিখ্যাত কাওয়াসাকি হেভি ইন্ডাস্ট্রি কোম্পানি বাংলাদেশের এমআরটি-৬ এর জন্য ২৪টি ট্রেন তৈরি করছে। এগুলোর প্রতিটিতে থাকবে ছয়টি করে কোচ। এর মধ্যে নভেম্বর পর্যন্ত দেশে এসেছে ১৯টি ট্রেন। বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ লাল-সবুজের রঙের ছোঁয়া রয়েছে ট্রেনের কোচগুলোতে। ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) কর্তৃপক্ষ জানায়, যাত্রীর চাপ বাড়লে আগামীতে প্রতিটি ট্রেনে আরও দুটি করে কোচ যোগ করা হতে পারে, সে ক্ষেত্রে প্রতিটি ক্রেনে কোচ সংখ্যা হবে আট।
বিষয়টি মাথায় রেখেই মেট্রোরেলের প্ল্যাটফর্মের নক্সা করা হয়েছে। ট্রেনের দুই প্রান্তের দুটি কোচকে বলা হয় ট্রেইলর কার, যেখানে থাকবেন চালক। এ দুটি কোচের প্রতিটিতে ৪৮ জনের বসে এবং ৩২৬ জনের দাঁড়িয়ে যাতায়াতের ব্যবস্থা রয়েছে। আর মাঝখানের চারটি কোচের প্রতিটিতে ৫৪ জন বসে এবং ৩৩৬ জন দাঁড়িয়ে ভ্রমণ করতে পারবেন।
সব মিলিয়ে ছয় কোচের একটি ট্রেনে বসে এবং দাঁড়িয়ে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৩০৮ জন যাত্রী যাতায়াত করতে পারবেন। এর মধ্যে সব মিলিয়ে বসার সুযোগ পাবেন ৩১২ জন। স্বপ্নের মেট্রোরেলে সাধারণ মানুষের চলাচল শুরু হবে আজ বৃহস্পতিবার। শুরুতে উত্তরা প্রান্ত থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অনেকগুলো স্টেশন থাকলেও কোথাও দাঁড়াবে না ঢাকা শহরের নতুন এই গণপরিবহন।
শুরুর দিকে ট্রেনের সংখ্যাও থাকবে বেশ কম। ২০২৩ সালের ২৬ মার্চ পূর্ণাঙ্গরূপে শুরু হবে এ সেবা। তখন আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুসরণ করে প্রতিটি স্টেশনে ৪৫ সেকেন্ড ট্রেন থামানোর পরিকল্পনা রয়েছে কর্তৃপক্ষের, তবে মানুষের অভ্যস্ততা তৈরির সুযোগ দিতে এ সময় এক মিনিটের মতো করা হতে পারে। আপাতত উত্তরা থেকে আগারগাঁও বা আগারগাঁও থেকে উত্তরা পর্যন্ত বিরতিহীন যাত্রী সেবা পেতে গুনতে হবে ৬০ টাকা। ১০ মিনিট পরপর ট্রেন আসবে। - সূত্র: অনলাইন