হারানো শৈশব; কুড়ানো সেই সব!! (৪৭ তম পর্ব)

প্রকাশের সময় : 2019-01-19 11:46:43 | প্রকাশক : Admin
হারানো শৈশব; কুড়ানো সেই সব!! (৪৭ তম পর্ব)

ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীনঃ শিক্ষাগুরুদের নখের সমতুল্য কোনকালে হওয়া সম্ভবও না। গুরু তো গুরুই। কার কথা বলবো! জীবনে এমনই গুরু হিসেবে অনেকেই এসেছেন। সবাই অতুলনীয়। এবং পরম পূঁজনীয়। হয়ত লিখতে পারিনা সবার কথা। কিন্তু ভুলতে পারি না কারো কথাই। সবার কথা মনে পড়ে। একজন দু’জন নয়, যখন যাঁর কথা মনে পড়ে তাঁর জন্যেই মন হাহাকার করে ওঠে। হারানো শৈশব লিখতে যেয়ে সবাইকে হয়ত টেনে আনা হয় না। কিন্তু মনের গহীনে বাস করেন সবাই। খুব শক্ত করেই বাস করেন।

আমার হারিয়ে যাওয়া শৈশবকে কুড়াতে যেয়ে তাঁদের হাজারো গল্প মনের মাঝে উঁকি দেয়। সারাক্ষণই দেয়। হাঁটতে, চলতে সবখানে দেয়। সব সময় দেয়। কত কথা, কত স্মৃতিই যে মনে পড়ে তার ইয়ত্তা নেই। বেশী মনে পড়ে কিছু প্রিয়জনের মুখ; এবং আনন্দে মাখা ছোটছোট কিছু সুখ। তবে দুঃখও কম নেই। সেসব লিখবো না ভেবেও মাঝেমাঝে লিখে ফেলি। হাত পিড়পিড় করে তাই লিখি। কাজটা একেবারেই ঠিক করিনা। ব্যাড়াছেড়া লাগিয়ে ফেলি। লিখতে যেয়ে নিজেও যেমনি কাঁদি; পড়তে যেয়ে পাঠকরাও কাঁদে।

পাঠকগণ কাঁদে কিংবা কষ্ট পায় মা-বাবাকে নিয়ে আমার কষ্টের লেখা পড়ে। কিংবা আমার কষ্টমাখা ছেলেবেলার ছোট্ট ছোট্ট গল্প পড়ে। আমি নিজেও কাঁদি; লেখার সময় হুহু করে কাঁদি। কেউ দেখে না বলেই শান্তিমত কাঁদতে পারি। পরিবেশ পাই বলেই কাঁদি। আসলে কান্নারও একটা পরিবেশ লাগে। নির্জন নিরিবিলি পরিবেশ হলো কান্নার জন্যে পারফেক্ট পরিবেশ। আর কান্নায় একটা সুখ আছে। ঝামেলায় থাকলে কান্না করেও সুখ পাওয়া যায় না।

ক’দিন আগে এমনই একটি পর্ব সবাই মিলে পার করলাম। তবে সুখের নয়; ভারী কষ্টমাখা কান্নাকাটির পর্ব। পুরনো স্মৃতিকথা নিয়ে লেখালেখির পর্ব নয়, একেবারে বাস্তবের। অতীব শ্রদ্ধার খুব প্রিয় একজনকে চির বিদায়ের পর্ব। খবরটি যে শুনেছে সেই কেঁদেছে। তবে আমি সংগত কারণেই কাঁদতে পারিনি। তখন আমার তেমন অবস্থা ছিলও না। কিন্তু কষ্ট পেয়েছিলাম! আলম স্যারের মৃত্যু সংবাদে কষ্ট পেয়েছিলাম খুব!!

এই তো সেদিনের কথা! বড়জোড় মাস দেড়েক হবে। বারডেমের বেডে নিস্তেজ হয়ে শুয়ে থাকা মানুষটিকে চিনতে কষ্ট না হলেও মানতে কষ্ট হচ্ছিল আমার। ঘুমলাগা ঘোরে চোখ বন্ধ করে নিশ্চুপ পড়ে ছিলেন বিছানার উপর। বলা যায় পাতলা চাদরে ঢাকা নিরব নিথর দেহ। ছোটখাট দেহখানিকে আরো ছোট লাগছিল। কিডনী ডায়ালাইসিসের জন্যেই তাঁকে বারডেমে আনা। দুটো কিডনীই ডেমেজ। একটিও ঠিকভাবে কাজ করছে না। ময়মনসিংহে পুরো ট্রিটমেন্ট দেয়া মুশকিল হচ্ছিল বলেই এম্বুলেন্সে করে ঢাকায় নিয়ে আসা।

সুস্থ করে তোলার জন্যে চেষ্টার কোন কমতি রাখেনি স্যারের মেয়ে দু’টো; নাহিদ আর নাদিরা। স্যারের জন্যে অনেক করেছে ওরা দু’বোন মিলে। ভালবাসার আদর মাখিয়ে সাধ্যের সবটুকু করেছে। আলম স্যারের জামাই ভাগ্যও ভাল। মেয়েজামাই দু’টো অতন্দ্র প্রহরীর মত সর্বদা পাশে ছিল। ময়মনসিংহে সব কাজকর্ম ফেলে ঢাকায় এসে পরে থেকেছে। বারডেমের জনারণ্যের ভীড়ে আনাচে কানাচে কখনো দাঁড়িয়ে কিংবা বসে এবং খেয়ে না খেয়ে সারাক্ষণ ডিউটি দিয়েছে।

এর আগে আমার কখনোই বারডেমে যাওয়া হয়নি। প্রবাসে থাকলে এমনি হয়। ভেতরটা তেমন করে চিনিও না। তারপরও নাহিদের দেয়া তথ্যমত একেওকে জিজ্ঞেস করে সহজেই স্যারের কাছে পৌঁছে যাই। তবে যত সহজে যেতে পেরেছি তত  সহজে ফিরতে পারিনি। স্যারকে ওভাবে রেখে ফিরতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমার ছেলেবেলার হাজারো স্মৃতিমাখা শিক্ষাগুরুকে অসহায়ের মত রেখে আসতে একটুও ইচ্ছে করছিল না। ইচ্ছে হচ্ছিল আরো থাকি; সারাক্ষণ পায়ের পাশে বসে থাকি।

যতক্ষণ পাশে ছিলাম, স্যারের কপালে হাত রেখে বসে ছিলাম। বেডের পাশের ছোট্ট টুলে বসে কপাল এবং চুলে হাত বুলাচ্ছিলাম। ছোট্ট মাথায় অল্প কিছু চুল। আমার উপস্থিতি স্যার বুঝতে পারছিলেন। মাঝেমাঝে একআধটু কথাও বলেছেন। আমার খবরাখবর জানতে চেয়েছেন। বেশী জানতে চেয়েছেন আমার শোনিমের খবর। ওর জন্যে দোয়া করে আবার ঝিমিয়ে পড়েছেন। কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে আবার জেগেছেন। জেগেই বলেছেন, শাহীন আছো?

এভাবেই পুরো সময়টা কেটেছে। ফেরার পথে গাড়ীতে বসে আছি। মাথায় যত কাজের কথা ছিল সব ভুলেই বসে আছি। কিছুতেই মন থেকে স্যারকে সরাতে পারছি না। একের পর এক ছেলেবেলার সব স্মৃতি, সব কথা মনে পড়ছে। বছরখানেক আগেও স্যারের বাসায় বসে কত কথা স্যারের সাথে। স্যার খুব গুরুত্ব দিয়ে বলছিলেন নেক কাজ করার কথা। বলছিলেন, নামাজ রোজা তো করতেই হবে। কিন্তু নেক কাজ ছাড়া মুক্তি নাই, বাবা! কত চমৎকার কথা। আজীবন নেক কাজ করে যাওয়া মানুষটি তাঁর ছাত্রকে নেক কাজের উপদেশ দেবেন এটাই তো স্বাভাবিক।

কিডনি একেবারেই কাজ না করাতে স্যারের মৃত্যুও এমনি স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিত ছিল। ডাক্তারগণও আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। আমিও আতঙ্কে ছিলাম শুনতে না চাওয়া খারাপ সংবাদের। তবে স্যারের মৃত্যু সংবাদটি পেতে বেশী সময় লাগেনি। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের ঘন্টাখানেকের মধ্যেই পেয়ে যাই। নাহিদের কল দেখেই মনটা মোচড়ে উঠেছিল। আঁতকে উঠেছিলাম। সব সময় এই কলটির আতঙ্কেই থাকতাম। অবশেষে তাই হলো! তিনি চলেই গেলেন!! ১৮ই নভেম্বর বেলা প্রায় তিনটার দিকে তিনি না ফেরার দেশেই চলে গেলেন!!!

ধলা স্কুল এন্ড কলেজের প্রাঙ্গণ। বড় প্রিয় বিশাল প্রাঙ্গণ আমার আলম স্যারের। এখানে পরদিন ভোরের আলোতে জানাজার আয়োজন হয়েছে। একদিন যে আঙিনায় তিনি সবাইকে জ্ঞান বিলাতেন, আজ সেই আঙিনায় সবাই এসেছে তাঁকেই বিদায় দিতে। স্যারের শেষ ইচ্ছাটাও এমন ছিল। মৃত্যুর আগে বেশ ক’বার এমনটা বলেছেনও। কর্মজীবনের পুরোটা সময়ই কেটেছে এই প্রতিষ্ঠানে। নেহায়েত বিছানায় শয্যাশায়ী না হলে কোনদিন অনুপস্থিত থাকার রেকর্ড নেই স্যারের। কোনদিন এক মিনিট দেরী করেও আসেননি। এতটা নিয়ম মেনে চলা মানুষ আজকাল নেই বললেই চলে।

তাইতো জানাজায় আসা মানুষের মুখে মুখে ছিল স্যারের কথা। একজন প্রকৃত মানুষের প্রশংসা। কেউ বাড়িয়ে বলেনি। চাকুরীক্ষেত্রে স্যারের আদর্শ, সততা, নিষ্ঠা এবং নিয়মানুবর্তিতা সব মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে। বহু মানুষ হয়েছে জানাজায়। বলা যায় আশাতীত। যে শুনেছে সেই এসেছে। বহু দূর থেকেও এসেছে। চারিদিকে অল্পবিস্তর মাইকিং হয়েছে। কিন্তু বাদ থাকেনি কেউ। বিশাল মাঠ ভরে উঠেছিল। ভরে উঠেছিল জানাজার কাতারে কাতারে।

স্যারের আরো ইচ্ছে ছিল যেন একসাথে হজ্ব করে আসা গফরগাঁয়ের অতীব প্রিয় সেই মানুষটি তাঁর নামাজে জানাজায় ইমামতি করেন! স্যারের পছন্দের সেই মানুষটিই জানাজায় ইমামতি করেছেন। স্যারের জীবনের শেষ ইচ্ছেটা পূর্ণ করেছেন। স্যারের জন্যে হাত তুলে দোয়া করেছেন। দোয়া করেছেন সবাই। এমন মানুষটির জন্যে দোয়া না করে কেউ কি পারে! মন ভরে সবাই দোয়া করেছে। কাছে থেকে করেছে, দূরে থেকেও করেছে।

অভাবিত ভাবে অভাগা এই আমি কিছুই করতে পারিনি! প্রচন্ড শোকের সময় তাঁর শোকগ্রস্ত পরিবারের পাশে থাকতে পারিনি। থাকতে পারিনি জানাজায়। শবদেহের খাটিয়া কাঁধে নিয়ে কবরস্থানে যেতে পারিনি। পারিনি কবরে একদলা মাটিও দিতে। শেষবারের মত মনভরে দেখতে পারিনি আমার প্রচন্ড ভাললাগা, মায়ালাগা মায়াবী সেই মুখ। সাদা শুভ্র দাঁড়িতে পবিত্রতায় মাখা বড় পবিত্র সেই মুখ! হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ছটফট করেছি কেবল। অসহায়ের মতই করেছি।

এছাড়া আমার আর কোন ক্ষমতাও ছিলনা। বড়     অদ্ভুত এই পৃথিবীতে মানুষ বড়ই ক্ষমতাহীন। কে কখন কোথায় কেমন থাকবে কেউ বলতে পারে না। আমি কি জানতাম আলম স্যারের বিদায়ের সময়টা নিজেই শয্যাশায়ী থাকবো! কিংবা অপ্রত্যাশিত কোন রোগের সাথে আমাকেও যুদ্ধ করতে হবে! বেঁচে থাকার কঠিন যুদ্ধ! জানতাম না! কিছুই জানতাম না। শুধু আমি কেন; আমরা আসলে কেউই কিছুই জানি না! কোনভাবেই জানি না! শুধু জানি, আমরা সবাই অপেক্ষায় আছি!! স্যারের মতই পরপারের অপেক্ষায়!!! চলবে...

 

সম্পাদক ও প্রকাশক: সরদার মোঃ শাহীন
উপদেষ্টা সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম সুজন
বার্তা সম্পাদক: ফোয়ারা ইয়াছমিন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: আবু মুসা
সহ: সম্পাদক: মোঃ শামছুজ্জামান

প্রকাশক কর্তৃক সিমেক ফাউন্ডেশন এর পক্ষে
বিএস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড,
ওয়ারী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০ হতে প্রকাশিত।

বানিজ্যিক অফিস: ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
বার্তা বিভাগ: বাড়ি # ৩৩, রোড # ১৫, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
ফোন: ০১৮৯৬০৫৭৯৯৯
Email: simecnews@gmail.com