সবচেয়ে সযত্নে সংরক্ষিত জমিদার বাড়ি
প্রকাশের সময় : 2019-01-19 11:54:46 | প্রকাশক : Admin
মাদিহা মৌঃ মহেড়া জমিদার বাড়ি টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত। টাঙ্গাইল ভ্রমণের দ্বিতীয় দিন গেলাম মহেড়া জমিদার বাড়ি দেখতে। কালীচরণ সাহা ও আনন্দ সাহা নামক দুই ভাই কলকাতায় লবণ ও ডালের ব্যবসা করে প্রচুর টাকা-পয়সা রোজগার করে চলে আসেন মহেড়া গ্রামে। মহেড়া গ্রামে এসেই তারা এ সুবিশাল বাড়িটি নির্মাণ করেন। বাড়ি নির্মাণ করার পর মহেড়া গ্রামের গরিব মানুষের কাছে টাকা দাদন খাটাতে থাকেন এবং প্রচুর উন্নতি করেন।
পরে ব্রিটিশ সরকার জমিদার প্রথা চালু করলে কালীচরণ সাহা ও আনন্দ সাহার ছেলেরা করটিয়ার ২৪ পরগনার জমিদারদের কাছ থেকে একটি অংশ বিপুল অর্থের বিনিময়ে কিনে নেয়। শুরু হয় জমিদারি। ১৮৯০ দশকের পূর্বে স্পেনের করডোভা নগরীর আদলে টাঙ্গাইলের মহেড়া জমিদার বাড়িটি প্রতিষ্ঠিত হয়। কালীচরণ সাহা ও আনন্দ মোহন সাহার উত্তরাধিকারী রাজেন্দ্র রায় চৌধুরী পর্যায়ক্রমে জমিদারি পরিচালনা করেন। এই শাসকরা এলাকায় বিদ্যালয়, রাস্তাঘাট, পানির ব্যবস্থাসহ অনেক জনকল্যাণমূলক কাজও করেছিলেন।
তিন বছর আগে আমরা যখন মহেড়ায় গিয়েছিলাম, তখন এখানে দর্শনার্থীদের আনাগোনা ছিল না। ভিতরে ঢোকার জন্য ছিল না টিকিট সিস্টেম। এখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন কেয়ারটেকার পরিচিত ছিল, তার সুপারিশে আমরা ভিতরে ঢুকতে পেরেছিলাম। প্রায় ১,১৭৪ শতাংশ জমির উপর অবস্থিত মহেড়া জমিদার বাড়ি। প্রাসাদ কমপ্লেক্সে প্রবেশ করার জন্য কালীচরণ লজ আর চৌধুরী লজের সামনে রয়েছে দুটি সিংহ দরজা। এর মধ্যে চৌধুরী লজের সিংহ দরজার সামনে বিশাখা সাগরের পাড়ে উঁচু ছয়টি স্বতন্ত্র কোরিন্থিয়ান ধাঁচের স্তম্ভ সারি।
প্রথমে চোখে পড়লো একতলা কালীচরণ ভবন, এরপর পর্যায়ক্রমে চৌধুরী লজ, আনন্দ লজ এবং মহারাজা লজ। কিন্তু তখন কোনটি মহারাজ লজ আর কোনটি আনন্দ লজ বুঝিনি। কারণ বাড়ি দুটির সংস্কার চলছিল। তাই ওই দুটি বাড়ির নাম লেখা হরফগুলো তুলে নেওয়া হয়েছিল। রাণী মহল নামে একটা বাড়িও দেখেছি। সবগুলো বাড়ির এই ধরনের ব্রিটিশ রীতির নাম দেখে আমি ভেবেছিলাম, এসব নাম হয়তো পরে বসানো হয়েছে। বাংলার রাজমহলগুলোর এরকম নাম যেন ঠিক মানানসই নয়। কিন্তু পরে জানলাম, এগুলো আগে থেকেই ছিল।
কালীচরণ ভবন ছাড়া বাকি সবগুলো প্রাসাদই দ্বিতল, যাদের সামনের দিকে রয়েছে কোরান্থিয়ান স্তম্ভের সারি। চুন সুরকি আর ইটের সমন্বয়ে তৈরি ভবনগুলোর কার্নিশ, প্যানেলের কারুকাজ চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। এদের দোতলায় ওঠার সিঁড়ির রেলিং আর বারান্দায় আছে কাস্ট আয়রনের কারুকাজ করা রেলিং। আনন্দ লজ এবং মহারাজা লজের দু’পাশে একতলা কাচারি ভবন আর সামনে বড় লনে ফুলের বাগান।
অলংকরণের দিক থেকে আনন্দ লজটিকে সবচেয়ে সুন্দর মনে হয়। প্রাসাদের সম্মুখভাগে দোতলা পর্যন্ত লম্বা ছয়টি কোরান্থিয় স্তম্ভ, সামনের দিকে দুপাশে কারুকাজ করা দুটি ভ্যানিসিয় ঝুল বারান্দা, ছাদের রেলিং এবং কার্নিশে ফুলের মালা, পাখি আর জ্যামিতিক অলংকরণ প্রাসাদটিতে আলাদা সৌন্দর্য যোগ করেছে।
ওদিকে মহারাজা লজের ছাদের চূড়ায় রয়েছে ফুল, লতা-পাতায় অলংকৃত অপূর্ব সুন্দর একটা ত্রিকোণাকার পেডিমেন্ট। এছাড়া এই প্রাসাদের সামনের দিকে ছয়টি কোরান্থিয়ান ধাঁচের স্তম্ভ এবং প্রতিটি জানালার উপরে ত্রিফয়েল আর্চের ব্যবহার সৃষ্টি করেছে একটি চমৎকার ফিউশনের।
মহারাজা লজের পেছনে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গার পরে একতলা আরেকটি ভবন। ভবনটির সামনের দিকে অনুচ্চ স্তম্ভের উপরে নির্মিত ত্রিফয়েল আর্চ যুক্ত প্রবেশদ্বার আছে। এর পেছনের অংশে অলংকৃত কাঠের দরজা, সম্ভবত এটি আধুনিককালের সংযোজন।
লজগুলো ছাড়াও এখানে আরোও আছে আত্মীয়স্বজন, কর্মচারীদের থাকার বাড়ি, নায়েব সাহেবের ঘর, গোমস্তাদের ঘর এবং প্রার্থনার জন্য মন্দির। ভবনগুলোতে রয়েছে সুউচ্চ প্রাচীর। বাড়ির সামনেই আছে বিশাল এক দীঘি, নাম বিশাখা সাগর। ভবনগুলোর পিছনে আছে পাসরা পুকুর এবং রানী পুকুর নামে দুটি পুকুর। সামনে সুন্দর ফুলের বাগান।
কালীচরণ লজঃ
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনী মহেড়া জমিদার বাড়িসহ পুরো গ্রামে হামলা চালায়। এক নির্মম গণহত্যার সাক্ষী হয় মহেড়া জমিদার বাড়ি। সেদিন ছিল ১৪ মে, সকাল দশটা। জমিদার বাড়ির ‘চৌধুরী লজের’ সামনের লনে দাঁড় করিয়ে জমিদার বাড়ির কুলবধু যোগমায়া চৌধুরানীসহ আরও পাঁচ জনকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদারেরা।
বিধ্বস্ত হয় জমিদার বাড়ি। পরবর্তীতে তারা লৌহজং নদীর মাধ্যমে নৌপথে এ দেশ ত্যাগ করে। এখানেই তখন মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মান্নান পরিত্যক্ত এই জমিদার বাড়িটিতে পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার স্কুল স্থাপন করেন। ১৯৯০ সালে যা ‘পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশ বিভাগ বাড়িটি নিয়ন্ত্রণ ও রক্ষনাবেক্ষণ করছে। সুরম্য এ বাড়িতে পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার থাকায় পুরো জমিদারবাড়ি খুবই ভালো অবস্থায় সংরক্ষিত আছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা এবং মহেরা জমিদার বাড়ির ইতিহাস নিয়ে সম্প্রতি একটি জাদুঘর তৈরি করা হয়েছে। মিউজিয়ামে মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহার করা কিছু দুর্লভ অস্ত্র, মোঘল আমল থেকে পুলিশের পোশাক বিবর্তন, মহেড়া জমিদার বাড়ির ইতিহাস এবং জমিদারদের ব্যবহার করা তৈজসপত্র আছে। এখানে প্রবেশের জন্য আলাদা কোনো ফি রাখা হয় না।
সম্প্রতি খুব সুন্দর একটা পিকনিক স্পট তৈরী করা হয়েছে । জমিদার বাড়ির পিছনের পাসরা পুকুরের পাশে খুব সুন্দর একটা পার্ক তৈরি করা হয়েছে। বর্ণিল ফুলের বাগান, দেখার মতো নানা ধরনের বেশ কিছু চেয়ার, টেবিল, চিলেকোঠার মতো ছাউনি, ঘাসের লন, পাথুরে ঝর্ণা, বিশাল অ্যাকুরিয়াম ইত্যাদি দিয়ে চমৎকার করে সাজিয়েছে।
মহারাজা লজ এবং এই ভবনের মাঝখানের জায়গাটায় পুলিশ প্রশাসন সিমেন্ট বালু দিয়ে তৈরি বাঘ, হরিণ, সারস, ঘোড়া, দোয়েল ইত্যাদি দিয়ে সাজানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু সমান আকারের ঘোড়া এবং দোয়েল, বিশাল হরিণ, বিড়ালের মতো বাঘ পুরো বিষয়টাকে কেমন যেন হাস্যকর করে তুলেছে। খাবারের জন্য চেয়ার টেবিলেরও সুব্যবস্থা আছে এবং এর জন্য কোনো টাকা লাগে না। ভেতরে ছোট্ট শিশুপার্ক আছে। ছোটদের সাথে বড়রাও দোল খেতে পারবে। এটাও কিন্তু একদম ফ্রি।