হারানো শৈশব; কুড়ানো সেই সব!! (৪৮ তম পর্ব)
প্রকাশের সময় : 2019-01-31 13:08:52 | প্রকাশক : Admin
ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীনঃ আলম স্যারের মতই পরপারে অনেক স্যারই চলে গেছেন। কেউ গেছেন সময় করে, আবার কেউ বা অসময়ে। ক’দিন আগেই গেলেন জব্বার স্যার। ইংরেজীর জাহাজ ছিলেন। টকটকা লাল চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে গ্রামারের রূপ ব্যাখ্যা দিতেন। মনে হতো পুরো ডিকশনারী তাঁর মুখ থেকে উগরে পড়ছে। ইংরেজীর সেই মহাপন্ডিত মানুষটি বহুদিন রোগ ভোগের পর ইন্তেকাল করেন।
ইন্তেকালে গত হয়েছেন সালাম স্যারও। তবে অনেকটা অকালেই। রিটায়ারমেন্টের পর বেশীদিন দেরী করেননি। তাঁরও বেশ আগে গেছেন আব্দুল হাই স্যার। বাংলা এবং ইতিহাস পড়াতেন আমাদের। বলবান কিংবা শশাঙ্ক রাজবংশের ব্যাখ্যা যখন দিতেন, মনে হতো স্বয়ং স্যার সেই রাজসভার সভাসদ ছিলেন। ২০১০ এ স্যারের সাথে ধলা স্কুলে দেখা। বুঝতে পারিনি শেষ দেখা!
শেষ দেখাটা মোজাম্মেল স্যারের সাথে হয়নি। তিনি ইন্তেকাল করেছেন প্রায় দশ বছর আগে। জীবনে পাওয়া সবচেয়ে তুখোড় শিক্ষক। বিজ্ঞানের পন্ডিততুল্য শিক্ষক। একজন ছাত্রের জীবনে তাঁর মত বিশেষ শিক্ষক পেলে আর কিচ্ছু লাগে না। কী অংক, কী বিজ্ঞান! যেন পড়াতেন না; যাদু দেখাতেন। ম্যাজিক! স্যারের পড়ার ধরণটাই ছিল ম্যাজিক দেখানোর মত। শুরু করতেন হাসতে হাসতে। কিন্তু কখন যে শেষ করতেন, কখন যে সমাধানে পৌঁছাতেন টেরও পেতাম না।
স্যার আমাকে দিয়ে প্রায়ই ক্লাশ নেয়াতেন। নাইন-টেন এ পড়াকালীন স্যারের পরিবর্তে এই আমি ক্লাশ নিয়েছি বহুবার। বিশেষ করে এসএসসি কোচিং ক্লাশে। আমাকে ক্লাশ ধরিয়ে দিয়ে বাজারে যেয়ে চায়ের আড্ডায় বসতে পারতেন। চা ছিল মোজাম্মেল স্যারের ভীষন প্রিয়। ভাত না খেয়ে থাকতে পারতেন; কিন্তু চা না হলেই নয়। আমার ক্লাশ করানোর বিষয়টি মোজাম্মেল স্যার যেমনি এনজয় করতেন; হেডমাস্টার আ ন ম তৈয়ব স্যারও তেমনি এনজয় করতেন। দূরে থেকে দেখতেন আর মুচকী মুচকী হাসতেন। তিনিও চিরবিদায় নেন মোজাম্মেল স্যারের সমসাময়িক সময়ে। খুব বেশী আগেপরে হয়ত হবেনা। দু’দুটো উজ্জল নক্ষত্রের পতন হয় মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে।
এই নক্ষত্রের পতনের কথা বেশী বলতেন রহমান স্যার। মানে ফিজিক্যাল স্যার। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠানে এসব বেশী বলতেন। কান্নাকাটি করে একাকার করে ফেলতেন। হাঁউমাঁউ করে কাঁদতেন আর বলতেন, তোরা আবার আসিস্রে! আসিস্!! ভুলে যাস্নে মোদের। ক’দিন আর থাকবো মোরা! এই যে স্যারদের ফেলে যাচ্ছিস্, এরা তো স্যার নয়, একেকটা নক্ষত্র। তোরা না আসলে জানতেও পারবি না এসব নক্ষত্রের পতনের কথা! সময় যাবে আর একটা একটা নক্ষত্র পড়ে যাবে; ঝরে যাবে!!
বড় হৃদয় বিদারক হতো স্যারের প্রতিটি বক্তৃতা। সেই আবদুর রহমান স্যার নামক বিশাল নক্ষত্রের পতন হয় ২০১৩ সালে। কী যে ভালবাসতেন আমায়! কত যে দেনা আমার তাঁর কাছে! কয়টা বলবো? একবার পাড়াভূম হয়ে চারিপাড়া যাচ্ছি। উদ্দেশ্য পাকাটি, বীরবখুড়া ঘুরে আসা। ভীষন ব্যস্ত; ম্যানেজারি করি। টোটো কাম্পানীর ম্যানেজার। ধার করা সাইকেল নিয়ে যাচ্ছি। কিবরিয়ার সাইকেল। বীরবখুড়ার হাবিবুর রহমান চাচার ছেলে আমার সহপাঠী বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী গোলাম কিবরিয়া ওরফে বাচ্চু।
পাকারাস্তার পথ ধরে ধীরলয়ে এগুচ্ছি। রাস্তা ফাঁকা। তবে মাঝেমধ্যে দু’একটা রিকশা কিংবা কদাচিৎ ট্রাকের দেখা মেলে। সবই ঠিক ছিল। হঠাৎ সাহাবুদ্দিন স্যারের বাড়ীর সামনে এসে আর এগুতে পারলাম না। এগুনো দায়। সাইকেলের প্যাডেলে আমার পায়ের চাপ আর পড়ে না। অগত্যা নেমে পড়লাম। না নেমে উপায়ও নেই। যে সুস্বাদু ঘ্রাণ! প্রাণ জুড়িয়ে যায়। নাক টেনে টেনে ঘ্রাণ নিচ্ছি। ভূনা গরম মশল্লার এত চমৎকার ঘ্রাণ কোন্ বাড়ী থেকে আসছে সেটাই পরখ করছিলাম।
নিশ্চিত মুরগী ভূনা হচ্ছে স্যারের বাড়ীর পাকশালায়। যার ঘ্রাণে রাস্তা ঘ্রাণময় হয়ে একাকার। মনে করতে পারছিলাম না এর আগে ঠিক কবে মুরগীর মাংস খেয়েছিলাম। আহারে মুরগী! চোখের সামনে ভাসছে ঝোলে ভরা ছোট্ট একটা এলুমিনিয়ামের বাটি। মাঝে তিনপিস আলু আর একপিস মুরগীর মাংশ। জিহ্বায় পানি আসার জোগাড়। সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ঘ্রাণ টেনে খাচ্ছিলাম। তবে ঘ্রাণ নয়, মনে হচ্ছিল খোদ মুরগী ভূনাই খাচ্ছি।
হঠাৎ সাইকেলে করে রহমান স্যারের আগমন। তিনিও স্কুল থেকে বাড়ীর পথেই ফিরছিলেন। এভাবে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুদূর এগিয়ে আবার ফিরে “কিরে এখানে কী করিস্” বলেই স্বভাব সুলভ হুংকার দিলেন। আমি থতমত খেয়ে বললাম, কিছু না স্যার। টায়ার্ড লাগছিল, তাই রেস্ট নিচ্ছি। স্যার এদিক ওদিক তাকালেন। “ঠিক আছে, বেশীক্ষণ থাকিস না; সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরিস।” বলেই স্যার চলে গেলেন। আমিও মহা বাঁচা বেঁচে গেলাম।
দিন কয়েক পরে ক্লাশের ফাঁকে স্যার আমায় ডাকলেন। আমার কলিজায় কামড় পড়লো। দূরুদূরু মনে টিচার রুমে গেলাম। স্যার বললেন, তোর বিচার আছে। স্কুল শেষে যাবি না; অপেক্ষা করবি। আমার কাঁপুনি ধরে গেল। আর তো ক্লাশ ভাল লাগে না। ছুটির ঘন্টা শেষে মইজউদ্দিন ভাই হাজির। সরদার সাব চলেন; আইজকা খবর আছে তোমার! ওনার বেশ কয়েকটা দাঁত ছিল না। তবুও বাকী দাঁতগুলো বের করেই হাসছেন। আমি তাঁর দাঁত গোণার চেষ্টা করছি। এক, দুই, তিন গুনতে না গুনতেই মুখ বন্ধ করে ফেলেন। মহা মুশকিল। বিপদের সময় কোনকিছুই ঠিকমত করা যায় না।
টিচার রুমে সব স্যাররাই অপেক্ষা করছেন আমার জন্যে। আমাকে দেখেই রহমান স্যারের হুংকার। এই যে অতক্ষণে জামবুরার বাপ আইছে। লুংগী পইরা আইছে। আইচ্ছা, ওডেন সবাই! চলেন যাই। হাইঞ্জা বেলা গিয়া কি আর দূফরের দাওয়াত খাওন যায়! রহমান স্যারের তাড়ায় সব স্যারেরা চেয়ার ছেড়ে উঠতে লাগলেন। চেয়ারম্যান তোফাজ্জল সাহেবের বাড়ীতে স্কুলশুদ্ধ স্যারদের দাওয়াত। আমি আর মইজউদ্দিন ভাই সবার পিছে পিছে হাঁটছি।
সামনে রহমান স্যার। পেছনে না তাকিয়ে স্যার বলছেন, মইজউদ্দিন মিয়া! অহন থাইকক্যা স্যারদের জন্য এলাকায় যত দাওয়াত থাকবো বেকটিত এই ভুইত্তা কলার বাপেরেও নিয়া নিবা। মনে থাকবো?
এরপর থেকে আর কোনদিন আমাকে ছাড়া রহমান স্যার কোন বাড়ীতে দাওয়াত খাননি। রহমান স্যার যাবেন, আর আমাকে নেবেন না এমনটা হতো না। দাওয়াত একটা থাকলেই হলো; কোন বাচবিচার নেই। সকালেই এসেম্বলীর পরপরই কানে কানে আমাকে বলে রাখতেন, সরদার! আইজকা খবর আছে। ভালো খবর; খাওনের খবর। দেহা না কইরা যাইস্না! টিক মাইরা আইয়া পরিস্! আমি স্যারের কথা মত চুপচাপ এসে স্যারদের দলে মিশে যেতাম।
লুংগী পড়া এই আমি পেছন পেছন হাঁটতাম। স্যারেরা দু’একজন প্যান্টশার্ট পড়লেও অধিকাংশই পাজামা পাঞ্জাবী পড়ে আসতেন। আমি প্যান্ট পড়তাম না। প্যান্ট পড়লে সহপাঠীরা টিটকারী মারতো। বলতো দুইচুংগা শাহীন। তাই লুংগীই ভরসা। তবে দামী লুংগী কপালে জুটতো না। জুটতো কমদামের চেকের লুংগী। একটু ভাল কোয়ালিটির লুংগীর খুব শখ ছিল। কেবল কেনার ক্ষমতা ছিল না। হাটের দিন ধলা বাজারে অনেক লুংগীর দোকান বসতো। কেনার ক্ষমতা না থাকলেও ঘুরে ঘুরে লুংগী দেখতাম। চোখের দেখায়ও শান্তি ছিল। মজা ছিল।
একবার মহামজা করার একটা সুযোগ এলো। এক লুংগী বিক্রেতা তার সুবিধার্তে হাটের রাতে দোকান শেষ করে দোকানের সব লুংগী ভাঁজ করে বেঁধে আমার ঘরে রেখে যেতেন। পরদিন সকালে এসে অন্য হাটে নিয়ে যাবেন বলেই এমনটি করতে লাগলেন। সুযোগটি আমি নিলাম। মধ্যরাতে বাজার ঝিমিয়ে পড়ার পরে আমি মালের বাঁধন খুলে বেছে বেছে পছন্দের লুংগী বের করে পড়তে লাগলাম। আহ্ কী শান্তি! নতুন লুংগী পড়ে সারা ঘরে হাঁটছি। এক অদ্ভুত আনন্দের অনুভূতি। মনের আনন্দে লুংগী পড়েই শুয়ে থাকতাম। একটা ভাব এসে যেত মনে। এরপর আবার লুংগী খুলে ভাঁজ করে বেঁধে রেখে দিতাম।
একদিন লুংগী পড়ে সেই যে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি আর জাগতে পারিনি। এদিকে রাত পার হয়ে ভোর। হঠাৎ দরজা ধাক্কানোর শব্দে ধড়মড় করে লাফিয়ে উঠলাম। চোখ ডলতে ডলতে দরজা খুলেই আমি শেষ! স্বয়ং সেই লোক! লুংগীর মালিক। আমাকে দেখে আঁৎকে উঠলেন। যেন ভূত দেখছেন। আমিও কিংকর্তব্যবিমুঢ়। চোখে পলক পড়ছে না; পালাবারও পথ নেই। খালি গায়ের অপরাধী এই আমি যমদূতের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। পড়নে সেলাই ছাড়া নরসিংদীর রুহিতপুরী লুংগী পড়েই দাঁড়িয়ে আছি। চলবে ....