হারানো শৈশব; কুড়ানো সেই সব!! (৫২ তম পর্ব)
প্রকাশের সময় : 2019-03-27 18:33:53 | প্রকাশক : Administration
ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীনঃ জোড়াতালি দেয়া ইজ্জত নিয়ে কোন মতে ধলায় ফিরলেও রক্ষা হলো না। পড়লাম মহা ফাঁপরে। স্কুলে যেয়ে যা শুনলাম তাতে ফাঁপরে পড়া ছাড়া গতিও নেই। কোন বছরই স্কুল যা না করে এবার হঠাৎ তাই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অর্ধবার্ষিকী নয়, এবার ত্রৈমাসিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছে। আর রক্ষে নেই। চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম। গত কয়েক মাসে পড়াশুনার নামে যা করেছি তা নিয়ে নদীর পাড়ে বসা গেলেও পরীক্ষার হলে বসা যাবে না।
পরীক্ষা তো পরীক্ষাই। মাথা ঘোরতে লাগলো; বলা যায় চালগুদামের সব চাল মাথায় ভেঙে পড়েছে। সবকিছুই উল্টো দেখি। মাঠের শেষ প্রান্তে ব্রহ্মপুত্রের তীর ঘেষে থাকা বটবৃক্ষের গোড়া উপরে আর মাথা নীচে দেখি। সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে বই নিয়ে বসি। বাংলা, ইংরেজী, সাধারণ গণিত নিয়ে সমস্যা নেই। সমস্যা হলো বিজ্ঞানের বিষয়গুলো নিয়ে। ঐচ্ছিক গণিত, জীব বিজ্ঞান কিংবা পদার্থ; কিচ্ছু মাথায় ঢোকে না। বই নাড়াচাড়া করি। চেষ্টা করি বোঝার। কিন্তু কিছুই বুঝি না। মাথা ঝিমোয়। কুল কিনারা পাই না।
কুল কিনারা কি এতই সোজা! চার মাসের পড়া কি চার দিনে শেষ হয়! দূর ছাই! কিচ্ছু ভাল্লাগে না! অগত্যা বেরিয়ে পড়লাম। একপাক বাজারটা ঘুরে আসলে মাথা ঠিক হবে এই আশায় বেরিয়ে পড়া। কাজ হলো না। উল্টো বিপদে পড়লাম। মহা বিপদ। দুই গলি ঘুরে যেই আলাউদ্দিনের চায়ের স্টলের সামনে গিয়েছি, অমনি বাঘের মুখে। আরো দু’জন স্যারকে নিয়ে জব্বার স্যার বসে আছেন। আমাকে দেখেই হুংকার দিলেন তিনি; “আরে আসেন, আসেন স্যার। বসেন। আলাউদ্দিন মিয়া! কড়া চিনি দিয়া এককাপ চা দাও লিডারকে। কী সৌভাগ্য তোমার! অনেক বড়মাপের নেতা আসছেন তোমার স্টলে।”
নির্ঘুম একটা রাত কাটিয়ে সাত সকালেই আব্বার পত্র পেলাম। ডাকযোগে ঢাকা থেকে পাঠানো পত্র। পুরোটা পড়ে বুঝলাম আব্বা আমার নানান কর্মের কথা মোটামুটি জেনে গেছেন। সম্ভবত হেডমাস্টার তৈয়ব স্যার আব্বাকে জানিয়েছেন। না হলে লাইন ছেড়ে এতটা বেলাইনে চলার বিষয়টা এত তাড়াতাড়ি আব্বার জানার কথা না। পত্র তো নয়, যেন কষ্টলিপি। শুধুই আব্বার কষ্টের কথা। কষ্ট পাবারই কথা। কষ্ট করে আমাদের পড়াশুনা করান। পুরো জীবনটাই স্যাক্রিফাইস করেছেন আমাদের জন্যে। সেই বাবাকে ফাঁকি দেয়া খুবই বিশ্রী কাজ!
বাবা আমার! পৃথিবীর শেষ্ঠ বাবা। প্রথম জীবনে পোষাকে কিংবা চলাফেরায় খুবই স্মার্ট ছিলেন। বিয়ের আগে কিংবা তাঁর সংসার যখন ছোট ছিল তখন অনেক সুখ ভোগ করেছেন। কিন্তু আমরাও বড় হওয়া শুরু করলাম, সংসারও বড় হতে লাগলো, আর আব্বাও সুখ ভোগ ছাড়তে লাগলেন। একটা সময় আমাদের জন্যে আব্বা তাঁর নিজের জীবনের সখ আহ্লাদ সব বিসর্জন দিলেন। সব সময় স্যুট টাই পড়া মানুষটি দু’টো পাজামা পাঞ্জাবী ছাড়া আর কিছুই রাখলেন না। ঘরে ফিরে ধুয়ে পরিস্কার করে এই দিয়েই চালাতেন। পুরানো হলেও চালিয়ে নিতেন। নতুন লুংগী কখনোই পড়তে দেখিনি। আমাদেরকে নতুনটা কিনে দিয়ে আমাদেরই পুরানোটা পড়তেন।
যেন এটাই পার্থিব রীতি। সবচেয়ে হিসেব করতেন একা একা বাইরে কিছু খাবার সময়। কী সকাল, কী দূপুর; ক্ষুধা সামলাতেন রেস্টুরেন্টে বসে টাকায় চারপিস পুরি খেয়ে। সবচেয়ে ছোট পুরি। সাথে এককাপ চা। খুব মজা করেই খেতেন। খাওয়া দাওয়া আব্বার খুব প্রিয় ছিল। অনেক কিছুই খেতে মন চাইতো নিশ্চয়ই। কিন্তু খেতেন না। খেতে পারতেন না। মাথায় যাঁর বড় সংসারের ঘানি, তিনি অনেক কিছুই খেতে পারেন না!
কিন্তু লিখতে পারতেন। চমৎকার করে লিখতে পারতেন। গোটা গোটা কিন্তু খুবই পেচানো অক্ষরে তাঁর লেখা অনেকেই পড়তে পারতো না। আমি পারতাম। ছোটবেলা থেকে পড়তে পড়তে আমি খুবই অভ্যস্ত ছিলাম। কষ্টলিপিতে আব্বা লিখেছেন; “স্নেহের বাবা আমার! কয়দিন ধরেই মনটা আমার কেন যেন ভাল যাইতেছে না। কোন কিছুতেই স্বস্তি পাই না। ভয় করিতেছে এই ভাবিয়া যে তোমার খারাপ কিছু হয় নাই তো! আমি তো বাবা! তাই কিছু একটা ঘটলেই খারাপটাই আগে ভাবিয়া বসি।”
আমি আর পড়তে পারছিলাম না। র্থর্থ করে কাঁপছিলাম। এ পর্যন্ত পড়ে আর না এগিয়ে চুপ করে বিছানায় বসে পড়লাম। না জানি পরে আরো কী লিখেছেন এই ভেবেই আমার কাঁপুনী। শরীর কাঁপে; সাথে কলিজাও। তারপরও কিছুক্ষণ চুপ থেকে স্বস্তি না পেয়ে আবার পড়া শুরু করলাম। লম্বা পত্র; মোটামুটি বড় সাইজের। পুরো এক পৃষ্ঠা। “আজকাল তোমাকে স্বপ্নেও দেখিতে পাই না। নিত্যরাতে ঘুমুতে যাই এই আশায় যে আমার ছোট্ট বাবাকে স্বপ্নে পাইবো। কিন্তু পাই না! মনে আমার খুব মোচড় পড়ে। মন উস্খুশ্ করে। আমার এই মধ্য জীবনে যে কয়টা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়াছি তাহার মধ্যে অন্যতম বড় ভুল তোমাকে এই ছোট্ট বয়সে একা একা ধলায় রাখিয়া আসা। বাবা আমার; লক্ষ্মী বাবা! অযোগ্য বাবার মত বড়ই ভুল করিয়াছি আমি। কিন্তু পড়াশুনা ছাড়িয়া বাজে ছেলেদের মত জীবন বাছিয়া নিয়া তুমিও একটা ভুল করো আমি তাহা কিছুতেই চাই না। তুমি তো অনেক মেধাবী। মেধাহীনরা ভুল করিলেও মানা যায়। মেধাবীরা ভুল করিলে কোনভাবেই মানা যায় না।”
পরিস্কার ইঙ্গিত। মেধাকে কাজে লাগানোর জন্যে দুঃখমাখা হৃদয়ের কষ্টমাখা পরিস্কার বার্তা। টানা হেচ্রার সংসারের একমাত্র কর্তার সব কথাতেই কষ্ট থাকবে। অথচ আব্বার প্রথম জীবনটা এমন ছিল না। সংসারের ঘানি টানার জীবন ছিল না। বৃটিশ আমলে দাদা এবং আব্বা দু’জনেই সরকারী চাকুরী করতেন কোলকাতায়। অথচ সংসারে দাদু আর চাচাসহ মোটে চারজন মানুষ। দু’জনের আয়ে চার জনের সংসার। খুবই স্বচ্ছল ছিলেন।
আয় বেশী, খরচ কম। আয়ের বড় অংশই থেকে যেত। আর তাই সংসার জীবনের শুরুতেই (আমার জন্মের আগেই) ঢাকা এবং এর আশেপাশে বেশ কিছু সম্পদ করতে পেরেছিলেন। যা পরবর্তীতে অনেক মুল্যবান সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে এবং আমাদের পরিবারের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করেছে। পরবর্তীতে সংসারের টানাপোড়ানের সময় নিজে কষ্ট করলেও সেসব সম্পদে আব্বা হাত দেননি কোনদিন। সব সম্পদ রেখে দিয়েছেন এই আমাদের ভবিষ্যতের জন্যেই। আমাদের সুখের জন্যেই।
আজ অকৃতজ্ঞের মত সেইসব সম্পদ আমরা খুবই স্বচ্ছলতার সাথে মহা আনন্দে ভোগ করছি। অথচ এই আমরাই সেই সম্পদ থেকে বাবার জন্যে সামান্য খরচ করতেও মহা কৃপণ। বাবার বিদেহী আত্মার শান্তির জন্যে দু’টো টাকা ব্যয় করতেও আমাদের কলিজায় বাঁধে। কত নিষ্ঠুর আর নির্মমতা এই পৃথিবীর বুকে! আর কত বিশ্রী রকমের খারাপ আমরা এই সন্তানেরা। বাবার মৃত্যুর দিনটাও মনে রাখতে পারিনা। অথচ এদের জন্যেই বাবাদের জনমভর আত্মত্যাগ। জানিনা বাবাদের কী লাভ এমন সন্তান জন্ম দিয়ে তাদের জন্যে পুরা জীবনটাই স্যাক্রিফাইজ করে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার!
হৃদরোগে পর্যুদস্তু আমার বাবা চতুর্থবারের স্ট্রোকে আর টিকতে পারেননি। চির বিদায় নেন ৯৫ সালে। আমার কষ্ট, আমি পাশে থাকতে পারিনি। আর সবচেয়ে বড় কষ্ট আব্বার জন্যে এই জীবনে আমি কিছুই করতে পারিনি। কেবল তাঁর কাছ থেকে নিয়েছি, দিতে পারিনি কিছুই। আমার কর্মজীবন শুরু হবার আগেই আব্বা ইন্তেকাল করেন। আজকে আমার শোনিমকে পাশে বসিয়ে খাওয়ার সময় আব্বার কথা খুব মনে হয়। প্রতিবার মনে হয়। মনে হয়, পাশাপাশি দু’টো চেয়ারে বসে আমার দু’টো বাবা খাবার খাচ্ছেন। মুখ চুকচুক করে ঠোঁট নাড়িয়ে চাড়িয়ে খুব মজা করে খাচ্ছেন!
আমি জানি, এভাবে দাদাভাইকে পাশে বসিয়ে আমার শোনিমের কোনদিনই খাওয়া হবে না! আর আমারও সেই দৃশ্য দেখা হবে না। সবই আমার কষ্টমাখা স্বপ্নের ঘোর। শোনিমের জন্মের অনেক আগেই তাঁর চির প্রস্থান হয়। তাই শোনিমকে দেখেননি আব্বা। কিন্তু সারাটিক্ষণ শোনিমের চোখেমুখে আমি তাঁকে দেখি, আমার জন্মদাতা বাবাকে দেখি! খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি! দেখাদেখির এই কাজটি হয়ত জীবনভর চলবে। যদিও জানি, সত্যি সত্যি তিনি নেই! অনন্ত অসীমের যাত্রায় তিনি অদৃশ্যমান। আসমান জমিনের কোথায়ও আর তাঁকে দেখতে পারবো না!! জনম জনমভর খুঁজলেও পাবো না!!! চলবে....