মাদার বখ্শ সবার অনুপ্রেরণা
প্রকাশের সময় : 2018-05-11 15:04:53 | প্রকাশক : Admin
ড: মোঃ তাজুল ইসলামঃ নাম মানুষকে বিখ্যাত করে না, মানুষ বিখ্যাত হলে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মাদার বখ্শ; রাজশাহীবাসীর কাছে স্মরণীয় ও বরণীয় একটি নাম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবক মাদার বখ্শ নাটোর জেলার সিংড়া থানার চলনবিল এলাকার স্থাপনদীঘি গ্রামে সাধারণ এক কৃষক পরিবারে ১৯০৫ সালের ১৪ ফেব্র“য়ারি জন্মগ্রহণ করেন। জানা যায়, তাঁর নামকরণের সঙ্গে তৎকালীন সামাজিক-সাংস্কৃতিক আচার জড়িয়ে আছে। কথিত আছে, পর পর কয়েকটি সন্তান মারা যাওয়ায় আরেকটি পুত্রসন্তান লাভের আকাঙ্খায় ব্যাকুল পিতা-মাতা সেই সন্তানকে অপমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষার আশায় চলনবিল এলাকার বিখ্যাত মাদার পীর বাবার দরগায় মানত করেন। এরপর সত্যি সত্যি একটি পুত্রসন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তার নাম পীরের নামানুসারে মাদার বখ্শ রাখা হয়।
১৯২২ সালে তিনি সিংড়ার চৌগ্রাম উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয় হতে প্রথম শ্রেণীতে মেট্রিক, রাজশাহী কলেজ হতে ১৯২৪ সালে আইএ এবং ১৯২৬ সালে একই কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রী অর্জন করেন। তিনি ১৯২৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এমএ পাস করেন এবং ১৯২৯ সালে রিপন কলেজ থেকে বিএল ডিগ্রী লাভ করেন। তাঁর শিক্ষা জীবনের ব্যয় তিনি নিজেই পরিশ্রম করে নির্বাহ করতেন।
মানুষ যেখানেই জন্মগ্রহণ করুক, সে সব সময় ভাল মানুষ হিসেবে স্মীকৃতি পায় তার কর্মের মাধ্যমে। প্রকৃত মানুষ হিসেবে যে কাজ করা দরকার তিনি তাই করেছেন মানুষের জন্য; একজন সংগঠক হিসেবে, একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে, একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে, একজন আইনজীবী হিসেবে, একজন সমাজসেবক হিসেবে এবং সামগ্রিক অগ্রগতির জনক হিসেবে।
মাদার বখ্শ বিশ্বাস করতেন, মানুষের শিক্ষার সেটুকুই যথার্থ যেটুকু সে অন্যকে বিতরণ করে। তাই শিক্ষা বিস্তারে অগ্রদূত মাদার বখ্শ শিক্ষকতা দিয়েই তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। নওগাঁ জেলার পোরশা হাই মাদ্রাসায় এবং মুর্শিদাবাদের সাল্লার উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনি দুই বছর শিক্ষকতা করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগ চালু হলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুরোধে সেখানে খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং আইন বিভাগ বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
প্রত্যেক মহৎ কাজের সূচনাতেই অসম্ভব এসে পথরোধ করে দাঁড়ায়। কিন্তু শিক্ষা বিস্তার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সকল প্রতিবন্ধকতাকে মাদার বখ্শ দূরে ঠেলে দিয়েছেন। তাই তো তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় সরকারকে বাধ্য করেছিলেন। ১৯৫৩ সালের ৬ ফেব্র“য়ারি ভুবন মোহন পার্কে এক জনসভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে মাদার বখ্শ সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, যদি রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা না হয়, তবে উত্তরবঙ্গকে একটি স্বতন্ত্র প্রদেশ দাবি করতে আমরা বাধ্য হব। তাঁর এ বক্তব্যে সরকারের টনক নড়ে। অবশেষে ১৯৫৩ সালের ৩১ মার্চে প্রাদেশিক আইন সভায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আইন পাস হয়। তাঁর প্রচেষ্টাতেই রাজশাহীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘রাজশাহী কোর্ট একাডেমি’‘লক্ষ্মীপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়’, ‘রাজশাহী মুসলিম হাই স্কুল’ এবং ‘রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ’। তাঁর নামে ১৯৮৬ সালে আরও স্থাপিত হয়েছে ‘মাদার বখ্শ আইডিয়াল স্কুল’ ও ‘মাদার বখ্শ গার্হস্থ্য অর্থনীতি মহিলা কলেজ।’ তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁর নামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আবাসিক হল এবং শহরের একটি সড়কেরও নামকরণ করা হয়।
জনগণের সেবা করাকেই তিনি জীবনের ব্রত হিসেবে অগ্রাধিকার দেন। তাই তো গ্রামের অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত জনগণ দারিদ্র্য ও ঋণের দায়ে সুদখোর মহাজন ও অত্যাচারী জমিদারদের খপ্পরে পড়ে মামলায় নাজেহাল অবস্থার সম্মুখীন হলে মাদার বখ্শ তাদের পাশে এসে দাঁড়ান। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি ওকালতি পেশায় অত্যন্ত খ্যাতি ও সুনাম অর্জন করেন। আইনজীবী হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু।
জনগণের সেবক হিসেবে ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৫০ থেকে ২২ জুন ১৯৫৪ পর্যন্ত তিনি রাজশাহী পৌরসভার নির্বাচিত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সে সময় ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে রাজশাহী নিউমার্কেট নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ১৯৫১ সালে তিনি রাজশাহী শহরে রিক্সা চালু করেন। তিনিই প্রথম সুইপারদের রেশন প্রদান করেন, তাদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করেন।
আঞ্চলিক পর্যায়ে ভাষা আন্দোলনে মাদার বখ্শের অবদান একুশের মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলেছিল। তিনি মনে করতেন পূর্ব পাকিস্তানবাসী উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেবে না। কারণ এটা হলে তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক মৃত্যু অনিবার্য। তাই তিনি ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ আইন সভার সদস্য থাকাকালীন সরকারের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন- বাংলা ভাষাকে যদি রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া না হয়, তবে তিনি আইন পরিষদের সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করবেন।
মৃত্যুর পরও লোকে যাকে স্মরণ রাখে তিনিই তো দীর্ঘজীবী। ২০ জানুয়ারি- ২০১৮ মাদার বখ্শের ৫১তম মৃত্যুবার্ষিকী। আজও আমরা তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। দুনিয়ার অর্ধেক মানুষ জানে না, বাকি অর্ধেক মানুষ কেমন করে জীবনযাপন করে। এই মহান মানুষটির জীবনকালব্যাপী মহৎ অর্জন ও মানবতার প্রতি তাঁর সুবিশাল অবদানের কথা আমাদের তরুণ প্রজন্মের অনেকেই জানে না। পরিতাপের বিষয় প্রতি বছর এই দিনটিতে পত্রিকার পাতাতেও মাদার বখ্শের অবদান খুব বেশি জায়গা পায় না। দেশের প্রায় অর্ধেক পত্রিকাতেই তাঁর কোন অবদানের কথা স্থান পায় না। তাতে কি? মানুষ বেঁচে থাকে তার কর্মের মধ্যে। মাদার বখ্শ আমাদের মধ্যে বেঁচে আছেন তাঁর কীর্তির মাধ্যমে।
সমুদ্র যত বৃহৎই হোক, তাকে যেমন মাটির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয় তেমনি সমুদ্রের মতো বিশাল প্রতিভার এই মানুষটিও দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৬৭ সালের ২০ জানুয়ারি, শুক্রবার বিকেল ৩টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলে তাঁকে রাজশাহীর কাদিরগঞ্জ গোরস্তানে সমাহিত করা হয়। তাঁর মতো একজন আপোসহীন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, জননেতা, দয়ালু আইনজীবী, সমাজসেবক, বিদ্যানুরাগী, মানবতাবাদী মহৎপ্রাণ মানুষ চিরদিন আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন, বেঁচে থাকবে তাঁর কীর্তি।