হিপোক্রেসীতে ভরে গেছে সমাজের একটা বড় অংশ!!

প্রকাশের সময় : 2019-05-09 19:25:54 | প্রকাশক : Administration
হিপোক্রেসীতে ভরে গেছে সমাজের একটা বড় অংশ!!

ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীনঃ ছোট মামা আর থাকবেন না! বেশ তাড়াতাড়িই চলে যাবেন!! সবাইকে ছেড়ে অনন্ত অসীমের পানেই চলে যাবেন!!! যাবার দিনক্ষণ ঠিক না হলেও ঠিক হতে খুব বেশী সময়ও পাবেন না। বিষয়টি মোটামোটি খোলাসা করেই বলেছেন ডাক্তার। আর বলেছেন সবাইকে দোয়া করতে। আল্লাহ পাকের দরবারে দোয়া। সর্বশক্তিমান একমাত্র তিনিই পারেন এহেন পরিস্থিতি পাল্টে দিতে। পরিস্থিতি বড়ই জটিল। গেল দশ বছরে শরীরে রোগ বেঁধেছে বেশ কয়েকটা। যেনতেন  রোগ নয়। খানদানী রোগ। উপশমের জোঁ নেই। একটার চিকিৎসা দিলে অন্যটা ঝামেলায় পড়ে। ডাক্তার বড় অসহায়। অসহায় বলেই আর তেমন কিচ্ছু করার নেই ডাক্তারদের।

ডাক্তার যখন রোগীর লোকদের দোয়া করতে বলেন তখন ধরেই নিতে হয় তাদের করার ক্ষমতা সত্যি সত্যি কমে এসেছে। তাই সংবাদটি শুনে প্রথমে ধাক্কা খেলেও সামাল দিতে পেরেছি নিজেকে। এবং মানিয়েও নিয়েছি। গেল দশ বছরে মামার পুরো চিকিৎসার সংগে ওৎপ্রোতভাবে এতটাই জড়িয়ে ছিলাম যে মানিয়ে নেয়ার বিষয়টিও খুব স্বাভাবিকভাবেই হয়েছে। তবে কষ্ট হয়েছে খবরটি সবাইকে জানাতে। বিশেষ করে আমার শোনিমকে। মৃত্যুর বিষয়টি সবাই সহজে মেনে নিলেও, শোনিম মেনে নিতে পারেনি। ছোট বলেই হয়ত বেশী কষ্টের কথা মেনে নিতে পারে না।

মামার মৃত্যুটা আমাদের কাছে কষ্টের হলেও তাঁর নিজের কাছে হয়ত ততটা কষ্টের ছিল না। হয়ত বলছি, তাঁর মৃত্যুক্ষণটা বিবেচনা করে। বাবুল মামা মারা যান গত ২৬ শে মার্চ। পুরো দেশবাসী যখন স্বাধীনতা দিবসের উৎসবে বিভোর, ঠিক তখনই তিনি চলে যান। খুব স্বাভাবিক মৃত্যু। দূপুরের খাবারের আগে আগে নিজের বড়ভাই, মানে আমার বড়মামার সাথে ফোনে কথা হয়। ফোনে বড়ভাইকেই উল্টো সুস্থ থাকার চেষ্টা করতে পরামর্শ দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেন খানিকটা ঘুমুবেন বলে।

ঘুমিয়েছিলেন ঠিকই! বড় শান্তির গভীর ঘুম! কিন্তু কেউ জানতো না সেটাই শেষ ঘুম। ঘুম আর ভাঙলো না! ঘুমুতে যাবার দশ মিনিটের মাঝেই চিরনিদ্রায় চলে গেলেন। কেউ টের পেলো না; বুঝতেও পারলো না। কারো কিছু বুঝে ওঠার আগেই চলে গেলেন। যেন বালিশে মাথা রেখে চোখ বুঝলেন আর গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেলেন। এক পরম স্বাচ্ছন্দের ঘুম; পরম তৃপ্তির মৃত্যু। নিষ্ঠুর নিয়তির কাছে ধরা দেবার এক চরম অথচ বড়ই সহজ এবং সাবলীল প্রক্রিয়া।

খবরটা চাউড় হতে সময় লাগলো না। সর্বোচ্চ আধাঘন্টা সময়ের মাঝে নিকটজনদের কাছে ছড়িয়ে পড়লো। যে যার জায়গা থেকে দৌঁড়ে পৌঁছালাম তাঁর বাসায়।

তবে খুব যে লোকজন পেলাম তাও নয়। হাতে গোণা কয়েকজন মোটে। যত না লোকজন পেলাম, তার চেয়ে ঢের বেশী পেলাম ফোন। ফোনের পর ফোন। মামাকে দেখতে যতনা লোকজনের বাসায় আসার আগ্রহ, তার চেয়ে ঢের বেশী আগ্রহ ফোনেই খবরটুকু নিয়ে দায়িত্ব শেষ করা। গুটি কয়েকজনাকে পেলাম জানাজায়ও অংশ নেয়ার আগ্রহে। তবে ব্যাপারটি এমন যেন, জাষ্ট জানাজায় অংশ নেয়া ছাড়া কাছের লোকজনের আর কোন দায়িত্ব এবং কর্তব্য নেই মৃত আপনজন কিংবা তার পরিবারবর্গকে নিয়ে।

আগে তো এমন ছিলনা। আমরা এমন কাঠখোট্টা ছিলাম না। আগেকার দিনে মৃত্যু মানেই শোক; মৃত্যু মানেই বিমর্ষতা। শুধুমাত্র একজনের মৃত্যুতেও পুরো গ্রাম বিষন্ন হতো। নিকটজনসহ সবার মাঝে কঠিন বিষন্নতায় মাখা একটা গুমোট বিমর্ষতা ছড়িয়ে পড়তো। মোটামুটি থেমে যেত চারিদিকের সব কোলাহল, থেমে যেত সকলের সব ব্যস্ততা আর কর্মস্পন্দন। শোকের চাঁদরে ঢেকে যেত মৃতব্যক্তি কেন্দ্রিক পুরো সমাজ। দিনগুলি মনে হয় আর আগের মত নেই। এখন সময় বদলেছে। হয়ত এজন্যেই বদলেছে মানুষের অনুভূতি। আর কমেছে দায়িত্ব কিংবা সামাজিকতা বোধ।

বিষয়টি মামাকে দিয়ে হাঁড়ে হাঁড়ে বুঝেছি। মৃত্যুর ১১ মাস আগেই মামার মৃত্যুঘন্টা বেজেছিল। দু’টো কিডনিই পুরোপুরি ড্যামেজ হয়েছিল। খবরটা আমিও কাউকে গোপন করিনি। জনে জনে সর্বজনাকে জানিয়েছি। জানিয়েছি অবস্থার ভয়াবহতা। শহর কিংবা গ্রামের নিকটজনেরা একজনও বাদ থাকেনি জানার এই করুণ অবস্থা থেকে। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্যি এরপরও মৃত্যুর সাথে পাঞ্জালড়া অসহায় এই মানুষটিকে সামান্য মুখদেখা দেখার জন্যে অতি নিকটজনাদের অধিকাংশই আসেনি।

এটা শহরের মনুষদের অবস্থা। গ্রামের নিকটজনদের অবস্থাও ভিন্ন নয়। তাদের অনুভূতি শুনলে আক্কেলগুড়ুম হতো। মনে হতো কী আর করা! অপেক্ষা করা ছাড়া তাদের যেন আর কিচ্ছু করার নেই। অপেক্ষাটি জীবিত মানুষটির জন্যে নয়; তাদের অপেক্ষা শুধুমাত্র মানুষটির মৃত্যুর। বলা যায় মৃত মানুষটির মুখটি দেখার অপেক্ষা। শারিরীক বা অর্থনৈতিকভাবে অক্ষমদের কথা বাদ দিলাম। সক্ষমরাও ১১টি মাস গ্রামে বসে ছিলেন মৃত লাশ রিসিভ করার জন্যে। একটিবারও তাদের ইচ্ছে হয়নি অন্তত জীবিত প্রিয় মানুষটিকে শেষবারের মত দেখার।

না তারা ১১টি মাসের এই সুযোগটি নিয়েছেন, না নিয়েছেন গেল দশ বছরের সুযোগ। জীবিত মানুষটিকে নিয়ে গেল দশ বছরে একটিবারও দায়িত্ব পালন তথা মায়া দেখাতে দেখিনি কাউকে। দূর থেকে কথার ছলে শুনেছেন, গল্প বলায় জেনেছেন আর করেছেন সামান্য হাপিত্যেস। কিন্তু যেই না ওনার মৃত্যু সংবাদটি শুনেছেন অমনি দায়িত্ববোধ উতলে ওঠতে শুরু করলো। আপনজনের মৃত লাশটির উপর দেখলাম কঠিন দায়িত্ববোধ। এখানে আর কারো মাতব্বরী কিংবা খবরদারী সহ্য হচ্ছে না কারোরই। সবাই যারযার জায়গায় মাতব্বর সেজে বসেছেন। কবরে না শুইয়ে দেয়া পর্যন্ত এই মাতব্বরী শেষ হবে বলে মনে হলো না।

সারা বছর যাকে এক ওয়াক্ত নামাজ পড়তে দেখিনা তাকেও দেখলাম বিশিষ্ট বুজুর্গের ভূমিকায়। তরিকত আর হুকুমতের ডালা খুলে বসেছেন। কথায় কথায় মিথ্যে বলা মানুষটিও আজকে পুরো সত্যবাদী ধার্মিক সেজে বসেছেন। মাস্লা মাসায়ালের উপর নসিহত দিচ্ছেন। সব নসিহত কেবলই সদ্য মরে যাওয়া মানুষটির লাশের দাফন কাফন নিয়ে। সবারই মোটামুটি একটিই কথা। দেরী করা যাবে না।

পারতপক্ষে কাউকে মুখটিও দেখানো যাবে না। নিজেরা মরলে কবরে কী আজাব হবে, সারা বছর তার ভাবনা নেই; এখন সবাই ভেবে অস্থির সদ্য মুরদার আজাব নিয়ে।

মুরদার জন্যে কী মায়া! অথচ জীবিত এই মানুষটির জন্যে কস্মিনকালেও মায়া করতে দেখিনি। এমনকি এখনো মৃত ব্যক্তির পরিবারে যারা বেঁচে আছে তাদের জন্যেও কোন মায়া দেখছি না। এক বোতল পানি কিনে কান্নারত কাউকে খাওয়াতেও দেখি না। দায়িত্ব তো পরের কথা। দায়িত্ব পালন কেবলই মুখের চাপায় সীমাবদ্ধ। কেউ কাজ করে না। সবাই কেবল বুদ্ধি দেয় আর কথা বলে। কারো কথাই কেউ মাটিতে ফেলতে দেয় না। সবাই সবার কথার উপর হাত দেয়। অথচ কেউ মুরদার কাজে কোথায়ও দু’টো টাকা লাগলেও নিজের পকেটে হাত দেয় না।

হাত দেয় মোবাইলের বাটনে। একটু পর পর বের করে আর স্ট্যাটাস দেয়। আহাজারির স্ট্যাটাস। অনলাইন তথা ফেসবুক ফাটিয়ে ফেলছে আহাজারি করে। এটা বাংলার সমাজে হালের প্রচলিত ভার্চুয়াল আহাজারি। একেবারেই সহজে দুঃখ এবং সহমর্মিতা প্রকাশের চমৎকার মাধ্যম। মৃত্যু সংবাদ কেউ একজন দিলেই হলো। যে যেখানেই থাকুক; আনন্দ কিংবা ফূর্তিতে। আহাজারি জানাতে সমস্যা নেই। মৃত্যু সংবাদটি আপডেট দিয়ে সে কী আহজারি! আহারে, উঁহুরে, কেমনে কী হইলো, ঘটনা কী, চলে গেল, এ্যাঁ  আল্লাহ এ কী শুনলাম, আর পাবো না তারে, সইতে পারছি না, বড় ভাল লোক ছিল, জান্নাত নসিব হোক, ইন্নালিল্লাহ আর আমিন, আমিন!! ভার্চুয়াল জমিনের ভার্চুয়াল আমিন।

আমার মায়ের মৃত্যুর পর গেল কয়েক বছরে ছোটমামা সহ খুব কাছের দু’জন আপনজন বিদায় নিয়েছেন। বেশী কাছের আপনজনের বিদায় মেনে নেয়া বড় কষ্টের। ভীষণ কষ্ট হয় তাঁদের বিদায় দেখতে! হয়ত সময় ঘনিয়েছে। হয়ত আস্তে আস্তে অন্যজনের বিদায়ও দেখতে হবে। তারাও চলে যাবেন। চলে যাবো আমরাও। কে আগে যায়, কেউ জানি না। কেবল এটুকু জানি, কেউ থাকবো না এই ধরায়। কেউ না! কিন্তু একবারও কেউ ভাবছি না, কী রেখে যাচ্ছি এই সমাজে আমরা! ভন্ডামী ছাড়া আর কিছু কি! আমাদেরই অবহেলায় বড় বিশ্রী আর অসামাজিক হচ্ছে এই সমাজ। ভন্ডামী তথা হিপোক্রেসীতে ভরে যাচ্ছে পুরো সমাজ!!

 

সম্পাদক ও প্রকাশক: সরদার মোঃ শাহীন
উপদেষ্টা সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম সুজন
বার্তা সম্পাদক: ফোয়ারা ইয়াছমিন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: আবু মুসা
সহ: সম্পাদক: মোঃ শামছুজ্জামান

প্রকাশক কর্তৃক সিমেক ফাউন্ডেশন এর পক্ষে
বিএস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড,
ওয়ারী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০ হতে প্রকাশিত।

বানিজ্যিক অফিস: ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
বার্তা বিভাগ: বাড়ি # ৩৩, রোড # ১৫, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
ফোন: ০১৮৯৬০৫৭৯৯৯
Email: simecnews@gmail.com