হারানো শৈশব; কুড়ানো সেই সব!! (৫৮ তম পর্ব)
প্রকাশের সময় : 2019-06-26 20:30:37 | প্রকাশক : Administration
ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীনঃ কার্তিক স্যারের অনুপ্রেরণাতেই সিনেমা দেখাটা বন্ধ করিনি। সুযোগ পেলেই দেখতাম। কিংবা সুযোগ করে নিতাম। তবে বেহিসাবীর মত দেখিনি; হিসেব করেই চালিয়ে গেছি। স্যার বলতেন, দেখবি না কেন? চলচ্চিত্র দেখবি। চলচ্চিত্র হলো সমাজকে বোঝার এবং বদলাবার মাধ্যম। এটা না দেখার তো কারণ দেখিনা। তবে যাই করবি, পড়াশুনাটা ঠিক রেখে করবি। ছাত্রছাত্রীরা পড়াশুনা ঠিক রেখে অন্য যাই করুক, কেউ তেমন আমলে নেয় না।
আমি অন্যের আমলের ধার ধারতাম না। ছবি দেখতে ভাল লাগতো তাই দেখতাম। তবে যত না ছবি দেখতে ভাল লাগতো, তার চেয়ে ঢের ভাল লাগতো পুরো ছবির পুরো কর্মকান্ড নিয়ে ভাবতে। সিনেমার শুটিং কিভাবে করা হয়, অভিনেতারা কিভাবে চলে, সিনেমা হলে কিভাবে ছবি প্রদর্শন করে, এক একটি হলে মেশিন ক’টা করে থাকে, বিজ্ঞাপন স্লাইড কিভাবে দেখায়, ইত্যাদি।
যারা সিনেমা হলে চাকুরী করতো তাদেরকে দেখে আমার খুব ঈর্ষা হতো। মনে হতো, ইশ! ওরা কত ভাগ্যবান; সব ছবি দেখার সুযোগ পায়! আমি যদি এমন সুযোগ পেতাম! বিশেষ করে সিনেমার প্রজেক্টর ম্যান হবার প্রবল আগ্রহ আমার এককালে ছিল। মোটামুটি নিয়ত করেই ফেলেছিলাম বিষয়টাকে প্রফেশন হিসেবেই নেবো। রাতদিন কেবল ছবিই দেখবো। ছবির পরে ছবি।
ক্লাশ টেন এ উঠার পর পরই ধলা বাজারে একটা বিশাল কান্ড ঘটে গেল। তখনকার সময়ে বাজারের সবচেয়ে ধনবান ব্যবসায়ী রুসমত চাচা সিদ্ধান্ত নিলেন, সিনেমা হল বানাবেন। বালিপাড়া আর গফরগাঁয়ের সিনেমা ব্যবসার জয়জয়কার দেখেই তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। চারিদিকে রব পড়ে গেল। শুরু হলো হল বানানোর কর্মযজ্ঞ। ইট-বালু আসলো, সিমেন্ট আসলো; আসলো রাজমিস্ত্রির দল। তারা একটি একটি ইট গাঁথে আর পাশে বসে বসে আমি দেখি। কাজ আর শেষ হয় না। সকালে স্কুলে যাবার আগে আর বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে আমার কাজই হলো হলের কন্সট্রাকশন সাইটে বসে থাকা।
বসে থাকলেই তো হবে না। কাজ তো আর আমার বসে থাকার উপর নির্ভর করে না। কাজ নির্ভর করে যারা করে তাদের উপর। তাদের অনেক হিসেব নিকেষ। আমার আর তর সহ্য হয় না। ধলায় আমি এসএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত। বড়জোর এক বছর। এরপর তো ঢাকায় ফিরে যাবো। চিরতরে ফিরে যাবো। এর আগে যদি হল চালুই না হয়, তাহলে এই সিনেমা হল দিয়ে আমার কী লাভ! এমনি ভাবনার অন্ত নেই আমার। সারাক্ষণ ভাবি, আর কন্সষ্ট্রাকশন সাইটে বসে থাকি।
মাঝে মাঝে ঢাকা থেকে হল বিশেষজ্ঞরা এসে কাজ তদারক করে যেতেন। ইট-বালুর কাজ শেষে এবার ভেতরের ডেকোরেশনের কাজ শুরু হলো। দর্শকদের বসার সিট বানানোর জন্যে ময়মনসিংহ থেকে বিশেষ টিম আসলো। তারা ওয়েলডিং মেশিন দিয়ে একটি একটি সিট বানিয়ে হলের ভেতর বসালো। হলের পর্দা হচ্ছে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় এবং আকর্ষনীয় জিনিস। একদিন সেটাও আনা হলো।
মুশকিল হলো পর্দা টানাতে যেয়ে। পর পর কয়েকদিন চেষ্টা করেও টানাতে পারলো না। আমি পড়াশুনা আর পরীক্ষার চিন্তা বাদ দিয়ে মহা চিন্তায় পড়ে গেলাম পর্দা নিয়ে। অবশেষে কারা যেন এসে টানিয়ে ফেলল। কী খুশী হলাম আমরা সবাই। যেন বিশ্ব জয় করে ফেলেছি। কিন্তু রুসমত চাচা ধলা জয় করতে পারলেন না; সময়মত হলের সম্পূর্ণ কাজ আমার প্রত্যাশা মত শেষ করতে পারলেন না। শেষ করতে করতে আমার এসএসসি পরীক্ষাও শেষ হয়ে গেল। এবং একদিন আমার এসএসসি পরীক্ষার পরপরই চালু হলো স্বপ্নের হল। চাচা নাম রাখলেন “ঝর্না”! রাজ্জাক-শাবানার সুপার হিট “সানাই” ছবিটি দিয়ে বিকেল তিনটায় ঝর্নার উদ্বোধন হলো।
এতো গেল হলের গল্প। শ্যুটিং এর গল্পও আছে। ঢাকার মগবাজারে আমাদের বাসা থেকে এফডিসি বেশ কাছে। জীবনে একবারই ভিতরে ঢুকেছিলাম। ঘুরে ঘুরে এফডিসি দেখা শেষ। বাইরে খোলা জায়গায় একটা জটলা দেখে এগিয়ে গেলাম। দু’টো ছবির সেট ফেলা হয়েছে সেখানে। একটি “এখনই সময়” আর অন্যটি “হুর এ আরব” ছবির। দীর্ঘক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে “হুর এ আরব” ছবির শুটিং দেখলাম। জসিম, রোজী, আনোয়ার হোসেন, শওকত আকবরসহ আরো অনেকে শুটিং করছিলেন। সহজে টেক হয় না। একই দৃশ্য বার বার টেক করেছেন পরিচালক। কিন্তু হচ্ছিলই না। কড়া রৌদ্রতে সবাই ঘেমে নেয়ে একাকার। অভিনেতারা সবাই ক্লান্ত। তাদের বিশ্রাম দরকার, টিফিন দরকার। আমার মত টোকাই মার্কা দু’একজনের গরমও লাগে না; ক্ষুধাও লাগে না। তবে আমার সামনে বসে বসে জসিম যখন মুখ বড় করে সিংগারায় কামড় দিচ্ছিলেন, ইচ্ছে হচ্ছিল তার সামনে থাকা প্লেট থেকে থাবা মেরে সিংগারা নিয়ে পালাই।
পাশের সেটে আব্দুল্লাহ আল মামুনের “এখনই সময়” ছবির শুটিংও চলছে। মামুন নিজে সহ টেলিসামাদ, এটিএম শামছুজ্জামানরা শুটিং করছিলেন। মজার বিষয় হলো ওই শুটিং এ আমার মত মেলা লোক ওদের দরকার ছিল। তাই হঠাৎ দেখলাম আমাদের কদর বেড়ে গেল। শুটিংয়ের জন্যে আমরা তৈরী। লুঙ্গি কাছা দেয়া খালি গায়ের আমার হাতে ছোট সাইজের একটি বাঁশ ধরিয়ে দিল! আমি সাংঘাতিক রকমের উত্তেজিত। এ কি ভাবা যায়? খোদ এফডিসির ভিতরে আমি সিনেমার শুটিং করছি!
দুই দল গ্রামবাসীর মধ্যে মারামারির রেকর্ডিং হবে। আমরা দুইপক্ষের দুই লাঠিয়াল বাহিনী দূর থেকে বাঁশ উঁচিয়ে চিৎকার করতে করতে মুখোমুখি হয়ে মারামারি শুরু করি। তিনচার বারের চেষ্টায় ওকে হলো। মারামারির সময় দু’চারটি বাঁশের আঘাত আমার পিঠেও পড়ে। তবে মাইন্ড করিনি; আফটার অল জীবনের প্রথম শুটিং।
মাইন্ড আমি সহজে কোনকিছুতে করতাম না। কী শুটিং দেখা অথবা সিনেমা দেখা। একদিন ঢাকার শ্যামলী সিনেমায় খালাতো ভাই মিন্টুকে নিয়ে টিকেট কেটে ঢুকেছি। মিন্টু আমার পেয়ারের দোস্ত; আমার সকল অপকর্মের গুরু। ক্ষুদ্র এই জীবনে করা অর্ধেক আকামকুকামের গুরু। গুরু কেটেছেন থার্ড ক্লাশের টিকেট। তাই দু’জনকে বসতে দিয়েছে একেবারে সামনের সিটে। পকেটে পয়সা যা থাকতো তা দিয়ে ফার্ষ্ট ক্লাশ তো ভাল, সেকেন্ড ক্লাশের টিকেট চাইলেও কাটতে পারতাম না।
ছবি শুরু হলো। মুশকিল হলো একেবারে সামনের সিটে বসাতে সব ছবিই বাঁকা বাঁকা দেখাচ্ছিল। ছবির নাম ‘গাঁয়ের ছেলে’। এতদিনকার অতি চেনা রাজ্জাক সুচরিতাকে চেনাই যাচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল তাদের মাথা চিকনা চাকনা বাঁকা বাঁকা। মিন্টু বললো, চিন্তা করিস্ না। আমি ব্যবস্থা করতাছি। ছবি শুরুর কিছুক্ষণ পরই এদিক ওদিক তাকিয়ে আমাকে নিয়ে সিট টপকিয়ে পেছনের ফার্ষ্ট ক্লাশে গিয়ে বসলো। মিন্টুর বুদ্ধিমত্তায় ওকে গুরু হিসেবে মেনে নিলাম।
মনের সুখে ছবি দেখছি। আর ভাবছি এখন থেকে ভুলেও দাম দিয়ে পেছনের টিকিট কিনবো না। ঢুকবো থার্ড ক্লাশে আর বসবো ফার্ষ্ট ক্লাশে। মিন্টুকে সেদিন আরো বেশী আপন মনে হলো। ছবি চলছে; রাজ্জাক গাঁয়ের ছেলে; জমিতে চাষ করছে। শহর থেকে এসেছে সুচরিতা। গাড়ী থামিয়ে রাজ্জাকের কাছে গ্রামের নাম জানতে চাইলো। রাজ্জাক ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতে যাবে। তখনই টের পেলাম আমার ঘাড়ে কে যেন ধরেছে। আর বলছে, হোউরের পোলা! এইবার পাইছি তোরে; ওঠ্, তাড়াতাড়ি ওঠ্!! থার্ড কেলাশের টিকেট কাইট্যা ফাস্ট কেলাশে আইছ্স্!!! তগো দুইডারে আইজ্কা গামছা দিয়া বান্মু!!! চলবে...