বাবার অনুপ্রেরণায় আজ তিনি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
প্রকাশের সময় : 2019-08-07 15:21:09 | প্রকাশক : Administration
আবদুল্লাহ আল মোহনঃ এ যুগে জ্ঞানের আলো ফেরি করা একজনের কথাই আমাদের চোখে ভাসে, তিনিই আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। পরম শ্রদ্ধার মানুষ, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর এই মানুষটি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি একজন শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক।
ষাটের দশকের একজন প্রতিশ্রুতিময় কবি, লেখক হিসেবেও পরিচিত। সে সময় সমালোচক এবং সাহিত্য সম্পাদক হিসেবেও তিনি অনবদ্য অবদান রেখেছিলেন। তিনি একজন সুবক্তা। তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, যা বাংলাদেশে আলোকিত মানুষ তৈরির কাজে নিয়োজিত রয়েছে। অসম্ভব সফল এই মানুষটির আজকের অবস্থায় আসার পেছনের মূল কারিগর শিক্ষক পিতা। পিতার অনুপ্রেরণাতেই বই চিনেছিলেন। আর সেই থেকেই নানান ভাবনার খোলনলচে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে আজকের অবস্থায় নিয়ে এসেছে।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ আনন্দে বিশ্বাসী, আস্থাবান মানুষ। আর সেই সঙ্গে অসম্ভব স্বাপ্নিক। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের অনেক প্রজ্ঞান অনুভব, ভাবনার কথামালা সমাজকে আলোড়িত, আলোকিত করে। এ যুগে জ্ঞানের আলো ফেরি করা একজনের কথাই আমাদের চোখে ভাসে, তিনিই অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। ‘জীবনের সমস্ত জায়গায় মাধুর্য খোঁজা’ মানুষ, চরম নৈরাশ্যের মধ্যেও প্রবল আশার উজ্জ্বল আলো দেখা সংশপ্তক মানুষ, জনপ্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের মুখচ্ছবি মনে ভাসলেই মনে পড়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রকে। যে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আজ শুধু প্রতিষ্ঠান নয়, একটি আন্দোলনের নাম। এই আন্দোলন আলোকিত মানুষ গড়ার আন্দোলন।
স্বাধীন দেশকে গড়তে উচ্চ মূল্যবোধসম্পন্ন, আলোকিত উদার শক্তিমান মানুষ তৈরির স্বপ্ন নিয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের যাত্রা শুরু করেছিলেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। সেই কেন্দ্র এখন দেশের হাজারো ছাত্রছাত্রী, তরুণ-তরুণীদের প্রাণের প্রতিষ্ঠান। লাখ লাখ শিক্ষার্থী এর সঙ্গে যুক্ত। পাঠ্য বইয়ের গৎবাঁধা পড়াশোনার বাইরে নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তিকে শাণিত করার জন্য বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই পড়ে তারা। অংশ নেয় বিভিন্ন পাঠচক্রে। দেশি-বিদেশি চিরায়ত নানা ধরনের বই পড়ে তাঁরা হয়ে উঠছে আলোকিত মানুষ।
আলোহীন, বিচ্ছুরণহীন ও অকর্ষিত শিক্ষা ব্যবস্থার অন্ধকারে সুপ্ত ও সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। আলোকের ঝরনা ধারায় কঁচি প্রাণ, অসীম সম্ভাবনাকে জাগিয়ে দিতে, ভরিয়ে দিতে, তাদের ভেতরকার কলুষতাকে ধুইয়ে দিতে চেয়েছেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। আর তাই পুরোপুরি অর্থহীন, শুধুমাত্র বেতনভোগী একজন শিক্ষক হিসেবে ব্যর্থ জীবন কাটাতে চাননি বলেই এই নিঃস্ব পরিবেশের ভেতর বাস করে একটা সৃজনশীল, কল্পনাসমৃদ্ধ অনাবিল আনন্দভুবনে আমাদের ছেলেমেয়েদের গড়ে তোলার, সুপ্ত প্রতিভাকে বিকশিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
আজকের অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ হয়ে ওঠার পেছনে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করেছেন তার পিতা অধ্যক্ষ আযীমউদ্দিন আহমদ। সায়ীদ স্যার বলেন, ‘আব্বা ছিলেন আমার কাছে জীবনের বড় আদর্শ। আব্বার মর্যাদা আর সম্ভ্রমের অবস্থা আমাকে শিক্ষক হতে উদ্বুদ্ধ করে। সারা অস্তিত্ব শিক্ষক হওয়ার নেশায় মরিয়া হয়ে ওঠে। মনে হয় পৃথিবীতে শিক্ষকের চেয়ে বড়কিছু কোথাও নেই। বৈষয়িক লিপ্সা তার মধ্যে একেবারেই ছিল না। তার প্রধান আনন্দ ছিল শিক্ষার জন্য জীবন উৎসর্গ করায়, বিদ্যায়তনের পর বিদ্যায়তন গড়ে তোলায়। ঘর সংসারের কোনো অস্তিত্বই যেন আব্বার কাছে নেই।
মা আমার মধ্যেও আব্বার ঐ একই চরিত্র দেখতে পেয়ে দুঃখ করেন। টাকাপয়সার ব্যাপারে ঐ একই অনাগ্রহ। দিনরাত কেবল ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। পুরনো দুঃখটা চাগিয়ে ওঠে তার। বলেন; ‘সেই বাপের ধারা পাইছে গো। নিজেগো জন্যে একটু মায়াদয়া নাই।’
আমি সেই বাবাকে পেয়েছিলাম। সেই শিল্পী, শিক্ষক, আদর্শবান, প্রজ্বলিত পিতাকে। আমার প্রথম জীবনের স্বপ্নকে তিনি জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। এ ছিল আমার এক বিরাট পাওয়া। আমার দুরন্ত শৈশব যে বিপথগামী হয়ে নৈরাজ্যের মধ্যে নষ্ট হয়নি, সে হয়তো তারই কারণে। আব্বার ব্যক্তিগত নৈতিকতা, উঁচুমাপের আদর্শ, সামাজিক মর্যাদা আমাদের সামনে এক উচ্চতর জীবনের আদর্শ দাঁড় করিয়ে রেখেছিল, যে আদর্শ থেকে নিচে নামা সম্ভব ছিল না।
১৯৪০ সালের ২৫শে জুলাই কলকাতার পার্ক সার্কাসে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস বাগেরহাট জেলার কচুয়া থানার অন্তর্গত কামারগাতি গ্রামে। তার পিতা আযীমউদ্দিন আহমদ ছিলেন একজন স্বনামধন্য শিক্ষক। পিতার শিক্ষক হিসেবে অসামান্য সাফল্য ও জনপ্রিয়তা শৈশবেই তাকে শিক্ষকতা পেশার প্রতি আকৃষ্ট করে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ১৯৫৫ সালে পাবনা জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক, ১৯৫৭ সালে বাগেরহাটের প্রফুল্লচন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬০ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৬১ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
শিক্ষক হিসেবে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের খ্যাতি কিংবদন্তিতুল্য। তিনি শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন ১৯৬১ সালে, মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজে খন্ডকালীন প্রভাষক হিসেবে। পরে তিনি সিলেট মহিলা কলেজে শিক্ষকতা করেন। তিনি ১৯৬২ সালের পহেলা এপ্রিল রাজশাহী কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে সরকারি চাকরিজীবন শুরু করেন। রাজশাহী কলেজে পাঁচ মাস শিক্ষকতা করার পর তিনি ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট টেকনিক্যাল কলেজে (বর্তমানে ঢাকা বিজ্ঞান কলেজ) যোগ দেন। এই কলেজে তিনি দু’বছর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন।
এরপর তিনি ঢাকা কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ জালালউদ্দিন আহমেদের আমন্ত্রণে ঢাকা কলেজে যোগদান করেন। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ঢাকা কলেজেই তার শিক্ষকতা জীবনের স্বর্ণযুগ অতিবাহিত করেন। সে সময় ঢাকা কলেজ ছিল দেশসেরা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মিলনস্থল। তিনি যখন ঢাকা কলেজে যোগ দেন তখন কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান কথাসাহিত্যিক ও গদ্য লেখক শওকত ওসমান।
ষাটের দশকে বাংলাদেশে যে নতুন ধারার সাহিত্য আন্দোলন হয়, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ছিলেন তার নেতৃত্বে। সাহিত্য পত্রিকা ‘কণ্ঠস্বর’ সম্পাদনার মাধ্যমে সেকালের নবীন সাহিত্যযাত্রাকে তিনি নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনা দিয়ে সংহত ও বেগবান করে রেখেছিলেন এক দশক ধরে। বাংলাদেশে টেলিভিশনের সূচনালগ্ন থেকেই রুচিমান ও বিনোদন-সক্ষম ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভূত হন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। টেলিভিশনের বিনোদন ও শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানের উপস্থাপনায় তিনি পথিকৃৎ ও অন্যতম সফল ব্যক্তিত্ব।