নাট্য আন্দোলনের পথিকৃত মমতাজউদ্দীন
প্রকাশের সময় : 2019-08-28 16:55:09 | প্রকাশক : Administration
সিমেক ডেস্কঃ অধ্যাপক মমতাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতা ও ভাষাসৈনিক। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। টেলিভিশন থেকে মঞ্চনাটক- সবখানেই দর্শক দেখেছেন তার অনবদ্য অভিনয়। সেলুলয়েডেও আপন চরিত্র রূপায়নে দাগ কেটেছেন দর্শক মনে।
নাটককে ঘিরেই ছিল যেন তার জীবনের পথচলা। নাট্যপ্রাণ বহুমাত্রিক প্রতিভার মানুষটি অভিনয়ের পাশাপাশি নাটক রচনা থেকে নির্দেশনায় রেখেছেন সাফল্যের স্বাক্ষর। এক অঙ্কের নাটক লেখায় বিশেষ পারদর্শিতার স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। শিক্ষক ও লেখক হিসেবে পরিচিতি পেলেও মঞ্চ নাটকের মাধ্যমে তার কর্মজীবনকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। নাটক রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় দিয়ে মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছেন।
১৯৩৫ সালের ১৮ জানুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার হাবিবপুর থানার আইহো গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মমতাজউদ্দীন আহমদ। দেশ বিভাগের পর তার পরিবার তদানিন্তন পূর্ববঙ্গে চলে আসে। তার বাবা কলিমুদ্দিন আহমদ ও মা সখিনা বেগম। তিনি মালদহ আইহো জুনিয়র স্কুলে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে ১৯৫১ সালে ভোলাহাট রামেশ্বর পাইলট মডেল ইনস্টিটিউশন থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে রাজশাহী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় বিএ (অনার্স) ও এমএ ডিগ্রী লাভ করেন।
ছাত্রাবস্থায় তিনি বাম রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫২ সালে গোলাম আরিফ টিপুর সঙ্গে তিনি রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা পালন করেন। সেই সময় রাজশাহী কলেজে বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণেও ভূমিকা রাখেন। রাজনীতিতে সম্পৃক্ততার কারণে চার বার কারাবরণ করেন। সংস্কৃতি অঙ্গনের কর্মী হিসেবে সক্রিয়ভাবে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আন্দোলনেও তিনি সক্রিয় ছিলেন।
শিক্ষকতায়ও তিনি দেখিয়েছেন সমান পারদর্শিতা। মমতাজউদ্দীন আহমদ ৩২ বছরের বেশি বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী কলেজে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও ইউরোপীয় নাট্যকলায় শিক্ষকতা করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগের খন্ডকালীন অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি ১৯৭৬-৭৮ সালে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচী প্রণয়নে একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭-৮০ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের পরিচালক ছিলেন।
নাটকে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ১৯৭৬ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও ১৯৯৭ সালে একুশে পদক অর্জন করেন। শিল্প ও সাহিত্যে অনন্য অবদানের জন্য তিনি জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন। যার মধ্যে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৬), একুশে পদক (১৯৯৭), নাট্যকলায় অবদানের জন্য ২০০৮ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃক বিশেষ সম্মাননা, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও আলাউল সাহিত্য পুরস্কার অন্যতম।
তিনি বাংলাদেশের টেলিভিশন এবং মঞ্চ নাটকের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব। ওনার সময়ে উনি তারকার চেয়েও বড় তারকা ছিলেন। একজন ক্রিয়েটিভ মানুষ ও ব্যক্তি দুই দিক দিয়ে ওনার সাতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল। ওনার লেখনী ও অভিনয় যারা দেখেছে তারাই বুঝতে পারবে, অন্য কারো সঙ্গে মেলানো যায় না। ব্যক্তিগতভাবে একজন শিশুর মত মানুষ ছিলেন।
অধ্যাপক মমতাজউদ্দীন আহমদ ৮৪ বছর বয়সে চিরবিদায় নিলেন ২ জুন, ২০১৯ বিকেল তিনটা ৪৮ মিনিটে। এই গুণী ব্যক্তির শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলার বজরারটেক গ্রামে বাবার কবরের পাশে দাফন করা হয়।