জাতীয় সঙ্গীত বদলাতে চেয়েছিলেন যারা
প্রকাশের সময় : 2019-08-28 17:51:24 | প্রকাশক : Administration
সিমেক ডেস্কঃ কিছুদিন আগেই জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে দুই বাংলায় তোপের মুখে পড়েছেন সঙ্গীত শিল্পী নোবেল। প্রিন্স মাহমুদের লেখা ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে তিনি রবীন্দ্রনাথের লেখা জাতীয় সঙ্গীতের চেয়েও বেশি আবেগময় বলেছেন। তার এই মন্তব্য জাতীয় সঙ্গীতকে অমর্যাদা করার শামিল বলে মনে করছেন অনেকে। অনেকেই আবার বলছেন, নোবেল তো শুধুমাত্র একটা মন্তব্যই করেছেন। কিন্তু দেশের বহু জ্ঞানী গুণী ব্যক্তিই জাতীয় সঙ্গীত বদলে ফেলতে সরব হয়েছিলেন। কিন্তু তাদের নিয়ে এতটা সমালোচনা হয়নি।
জাতীয় সঙ্গীত প্রথম পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয় খুনি মোশতাক সরকার। ৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে স্বপরিবারে হত্যার পর জিয়া-ফারুক-ডালিম চক্র রাষ্ট্রপতির আসনে বসায় খন্দকার মোশতাক আহমেদকে। ক্ষমতায় বসেই মোশতাক জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের লক্ষ্যে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করে। কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ডঃ দ্বীন মুহাম্মদকে। কমিটিকে ‘এক মাসের মধ্যে পরিবর্তিত জাতীয় সঙ্গীত’ প্রস্তাব করতে বলা হয়। দ্বীন মুহাম্মদ কমিটি তিনটি বৈঠক করে। তারা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’ এবং ফররুখ আহমেদের ‘পাঞ্জেরী’ থেকে যেকোনো একটি জাতীয় সঙ্গীত করার প্রস্তাব করে প্রতিবেদন জমা দেয়। কিন্তু ক্যু পাল্টা ক্যুতে ওই প্রস্তাবের মৃত্যু ঘটে।
মোশতাকের পর ক্ষমতায় আসেন জিয়াউর রহমান। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৯৭৯ সালের ৩০ এপ্রিল, জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের দ্বিতীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান এক গোপন চিঠিতে বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি গান ভারতীয় জাতীয় সঙ্গীত। তিনি বাংলাদেশের নাগরিকও নন। হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন কবির লেখা গান জাতীয় সঙ্গীত হওয়ায় মুসলিম উম্মাহ উদ্বিগ্ন। এই গান আমাদের সংস্কৃতির চেতনার পরিপন্থী বিধায় জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন আবশ্যক।’ প্রধানমন্ত্রীর ওই চিঠিতে ‘আমার সোনার বাংলা’র পরিবর্তে ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’কে জাতীয় সঙ্গীত করার প্রস্তাব করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর এই চিঠি পেয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ রেডিও, টেলিভিশন এবং সব সরকারি অনুষ্ঠানে প্রথম বাংলাদেশ গানটি প্রচারের নির্দেশনা জারি করে। এ সময় রাষ্ট্রপতির অনুষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীতের পাশাপাশি প্রথম বাংলাদেশ গাওয়া শুরু হয়। কিন্তু ১৯৮১ সালে জিয়ার মৃত্যুর পর সেই উদ্যোগ থমকে যায়।
এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর ইসলামপন্থীদের কাছে টানতে বহু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এরই অংশ হিসেবে তিনি রবীন্দ্রনাথের লেখা জাতীয় সঙ্গীতকে পাল্টে ফেলতে উদ্যোগী হয়েছিলেন বলে শোনা যায়। তবে এর তেমন কোনো দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের চতুর্থ দফা উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি-জামাত জোট সরকারের সময়।
২০০২ সালে তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রী আলী আহসান মুজাহিদ জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের লক্ষ্যে একটি যৌথ সুপারিশপত্র প্রধামন্ত্রীর কাছে জমা দেন। ২০০২ সালের ১৯ মার্চ স্বাক্ষরিত এই চিঠিতে দুজন যৌথভাবে বলেন, ’সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে আমাদের ইসলামি মূল্যবোধ ও চেতনার আলোকে জাতীয় সংগীত সংশোধিত হওয়া প্রয়োজন।‘ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এই অনুরোধপত্রটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠান। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী খুরশীদ জাহান হক বিষয়টি ‘অতি গুরত্বপূর্ণ’ বলে সচিবের কাছে প্রেরণ করেন। সচিব জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার বহির্ভূত বিষয় বলে তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রেরণ করে। ২০০২ সালের ১৯ আগস্ট এটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এরপর এ সম্পর্কে আর কোনো তৎপরতা নথিতে পাওয়া যায়নি।
এছাড়াও গোলাম আজম, মুহিবুল্লাহ খানসহ অনেকেই বিভিন্ন সময় জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের বিষয়ে সরব হয়েছিলেন। কিন্তু তাদের কাউকে এতটা সমালোচনার মুখে পড়তে হয়নি, যেটা নোবেলের ক্ষেত্রে হচ্ছে।