বর্ণাঢ্য জীবনের খণ্ডাংশ; মুর্তজা বশীর

প্রকাশের সময় : 2020-01-01 12:35:28 | প্রকাশক : Administration বর্ণাঢ্য জীবনের খণ্ডাংশ; মুর্তজা বশীর

সিমেক ডেস্কঃ জন্মের পরপরই পিতা ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ নাম রাখাসহ পৃথিবীতে আগমনের ক্ষণ, সন তারিখ লিখে রাখেন এভাবে- ১৭ই আগস্ট হিঃ ১৩৫১। ১৪ রবিউস সানি। বুধবার বেলা ১২:২৫ মিনিট, কৃষ্ণপক্ষ দ্বিতীয়া; আবুল খায়ের মুর্তজা বশীরুল্লাহ বকুল।  ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতো পন্ডিতের জ্ঞান ও পান্ডিত্য যখন এ উপমহাদেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বৈশ্বিক আলো ছড়াচ্ছে, স্বীয় নবম সন্তান তাঁর রাখা নামকে ছেঁটে ফেলবেন এ আশা তো দ্রোহের শামিল।

একদিন ডাক পিয়ন চিঠি দিতে এসে মুর্তজা বশীর নামে এ ঠিকানায় কেউ নেই জানতে পারেন পিতা ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কাছে। বশীর তখন বাবাকে বলেন, এ চিঠি তার। পিতা অবাক হন। তুমি মুর্তজা বশীর! মুর্তজা তখন লিখতেন ম-এর নীচে দীর্ঘ উকার দিয়ে। পিতা বললেন, মূর্খতে ম-এর নীচে দীর্ঘ উকার হয়। তুমি নিশ্চয়ই মূর্খ নও। পিতা হয়তো বুঝেছিলেন এই দ্রোহী সন্তানই একদিন হবে নন্দনের খেয়ালি সাধক। সেই থেকে আবুল খায়ের মুর্তজা বশীরুল্লাহ্ বকুল হয়ে গেলেন মুর্তজা বশীর। বকুল তাঁর ডাকনাম।

দুর্বিনীত ও ক্ষ্যাপাটে স্বভাবের কারণে তাঁর মনে হলো পরিবারে তিনি অনাহূত। প্রায়ই পিতার কাছে অভিযোগ আসে তাঁর বিরুদ্ধে। একদিন তাই ঘর ছেড়ে পালিয়ে গেলেন। একা একা লক্ষৌ পর্যন্ত গিয়ে শেষে ফিরে আসেন। পিতা আফসোস করে বলেছিলেন, লক্ষৌ পর্যন্ত গিয়েছ আরেকটু এগিয়ে আগ্রা গেলে না কেন?- ১৯৫০ সাল। চারদিকে কমিউনিস্ট পার্টির আহ্বানে শুরু হয়েছে গণ জাগরণ। ছাত্র ফেডারেশনের কর্মী বশীর পোস্টার লিখে তা সাঁটছেন বিভিন্ন জায়গায়। ময়মনসিংহে চলছে হাজং বিদ্রোহ। ময়মনসিংহের মানচিত্রের মাঝে কাস্তে-হাতুড়ি সংবলিত পোস্টারটি ঠিকই লাগিয়েছিলেন দেয়ালে। কিন্তু খুলে গেল। পুনরায় লাগাতে গিয়েই ধরা পড়েন পুলিশের হাতে। দিনটি ৭ জুন। গ্রেফতার হয়ে প্রায় ৪ মাস পর ছাড়া পান। জেলখানায় স্নেহ পান আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিনের। তখনকার কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ম ছিল ২০ বছরের নীচে কেউ পার্টির সদস্যপদ লাভ করত না। মুর্তজা বশীর পেয়েছিলেন ১৮ বছর বয়সেই।

১৯৬৭ সাল। ঢাকা প্রেসক্লাবে হচ্ছে প্রদর্শনী। সমাজের উঁচুস্তরের নামীদামী মানুষ এসেছে। শিল্পী তাঁর শারীরিক গঠনের জন্য সাধারণত সামাজিক কোনো বড় অনুষ্ঠানে প্রকাশ্য হন না। ওই অনুষ্ঠানে ধনীরা এসেছেন। শিল্পীর মনে হলো তাঁর সৃষ্টিকর্মকে উপলক্ষ্য করে এরা এসেছেন নিজেদের জৌলুস দেখাতে, কার কত শানশওকত আছে জাহির করতে। সমাজতান্ত্রিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ যুবক মুর্তজা বশীরের মাথায় রক্ত চড়ে গেল। মুখে ছুটল অকহতব্য, অশ্লীল শব্দ। আর প্রকাশ্যেই নারী-পুরুষের সামনেই ত্যাগ করলেন শরীরের জলীয় বর্জ্য।

ইতালিতে শিক্ষা গ্রহণকালীন সম্পর্ক গড়ে ওঠে এ্যাকাডেমির সহপাঠিনী মারিয়া বা মিরার সঙ্গে। তার ভাষা ছিল ইতালি, ইংরেজি বুঝতেন না। পক্ষান্তরে বশীর ইংরেজি জানলেও ইতালির ভাষা জানতেন না। মুখের ভাষা কেউ না বুঝলেও মনের ভাষা ঠিকই বুঝেছিলেন দুজনে। এসেছিলেন হৃদয়ের কাছাকাছি। বেশ গভীর ছিল সম্পর্ক। বিচ্ছেদও ঘটে সিনেমাটিক কায়দায়। বাসর রাতে বৌকে দেখিয়েছিলেন মারিয়ার ছবি। খেয়ালিপনা আর কাকে বলে!

হৃদয়ঘটিত ব্যাপার স্যাপার আরেকটি ঘটেছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। শিল্পী তখন থাকেন লাহোরে। পাঞ্জাবী অপূর্ব সুন্দরী আকিলা। চিত্রশিল্পের শিক্ষার্থী হাবভাবে কৌশলে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন বশীরকে ভালোবাসেন তিনি। কিন্তু বশীর খর্বকায় বলে নিজেকে তার অযোগ্য মনে করতেন। বশীরের বিয়ের খবর শুনে আকিলা বেশ মুষড়ে পড়েছিলেন।

সর্বশেষ ঘটনাটি হৃদয়ঘটিত ব্যাপার স্যাপার বলা যাবে কিনা পাঠকের ওপর ছেড়ে দেওয়া যায়। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তখন জুলফিকার আলী ভুট্টো। ‘মৃত টিকটিকি’ নামে একটি ছবি ভুট্টো কিনেছিলেন ৬০০ টাকা দিয়ে। স্থান দেন সে ছবি নিজের বেডরুমে। ভুট্টোর স্ত্রী নুসরাতকে শিল্পী আগে থেকেই চিনতেন। একদিন বাসায় আলাপচারিতার সময় ভুট্টো জানতে পারেন ওই ছবির শিল্পী বশীর এবং তিনি বাঙালী। তা শুনে স্ত্রীর সঙ্গে রাগারাগি করেন। রাগে গজরাতে গজরাতে বেরিয়ে যান। যদিও চিত্রকর্মটি ভুট্টোর প্রিয় ছিল। নিয়মিত প্রায় যাতায়াত ঘটে তার বাড়িতে। একদিন বশীরের এক বিচারক আত্মীয় তাঁকে ভুট্টোর বাড়িতে যাওয়া কমিয়ে দিতে সতর্ক করে বলেন, মিয়াবিবির সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে।