কবি আসাদ চৌধুরী; ঠোঁটের কোণে লেগে থাকে হাসিটি

প্রকাশের সময় : 2020-02-12 12:48:12 | প্রকাশক : Administration কবি আসাদ চৌধুরী; ঠোঁটের কোণে লেগে থাকে হাসিটি

সিমেক ডেস্ক: ‘কোনো অবস্থায়ই মনটাকে কয়লা করিস না’ কথাটা তাকে বলেছিলেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। সে কথা আজো অনুসরণ করে চলেছেন কবি আসাদ চৌধুরী। সুস্বাস্থ্যের জন্য নয়, ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসিটি নিজের ব্যক্তিত্বের সঙ্গেই মিশে গেছে তার। মন খারাপ হলেও মনটাকে কখনো পুড়তে দেন না। যে কোনো কাজ থেকেই সুখগুলোকে আলাদা করে খুঁজে নেয়ার চেষ্টা করেন। ভালো একটা বই কিংবা কবিতা পড়লে, সিনেমা দেখলে অথবা ক্রিকেট মাঠে সাকিব যদি একটা ছক্কা মারে, তাতেই তিনি অনেক আনন্দিত হন। সদা হাস্যোজ্জ্বল এ মানুষটির সঙ্গে এভাবেই কথা হয় ।

এখন বেশ ব্যস্ত সময় কাটছে আসাদ চৌধুরীর। কিছুদিন আগে বরিশাল ও চুয়াডাঙ্গা ঘুরে এসেছেন। কথায় কথায় নিজের ভালো লাগা, কষ্টের কিছু কাহিনী শেয়ার করেছেন তিনি। কষ্টের কথাই আগে বললেন, প্রাইমারী স্কুলে পড়ার সময় কাশেম নামে এক বন্ধু ছিল তার। যেমন মেধাবী, তেমনি ইংরেজী বলা কিংবা লেখার ক্ষেত্রে অসাধারণ দক্ষ ছিলেন তিনি। পড়াশোনা শেষে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে চাকুরী নেয়ার পর গ্রামের বাড়িতে বন্ধুর দেখা পান আসাদ চৌধুরী। তার কষ্টের জায়গাটি সেখানেই। তিনি যে নৌকায় উঠেছিলেন, সে নৌকাটি চালাচ্ছিলেন কাশেম অর্থাৎ তার বন্ধু। সেদিনই বুঝেছেন, মেধা ও প্রতিভার বিকাশে থাকতে হবে সুযোগও।

আবুল হাসান স্মৃতি পুরস্কার, জীবনানন্দ দাশ পদক, অতীশ দীপঙ্কর স্বর্ণপদক, জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার, একুশে পদকসহ নানা সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন আসাদ চৌধুরী। তার জন্ম ১৯৪৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারী বরিশালের মেহেদীগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া নামক স্থানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র ছিলেন তিনি। চাকরিজীবন শুরু করেছিলেন কলেজে অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে।

একসময় প্রচুর উপন্যাস পড়েছেন। ইন্টারমিডিয়েট থেকে শুরু করে অনার্স থার্ড ইয়ার পর্যন্ত ত্রিশ থেকে পঞ্চাশের দশকের শ্রেষ্ঠ লেখকদের লেখা প্রায় সবগুলো বইয়েই হাত বুলিয়েছেন। এর পরের সময়টায় বন্ধুবান্ধবদের লেখা উপন্যাস ছাড়া অন্য কারো বই পড়া হয়নি তার। গবেষণাধর্মী বই তার খুব পছন্দ। কবিতার বই অসম্ভব ভালোবাসেন। আটপৌরে কাব্যে নিজেকে বেঁধে রাখতে চান না। এ প্রজন্মের তরুণ লেখকদের কবিতা কখনই মিস করেন না তিনি। খোলা মনে বললেন তাদের সম্ভাবনার কথা। তরুণদের চিন্তার সঙ্গে থাকার দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি। তরুণরা সোজা কথা অনেক বলিষ্ঠতার সঙ্গে বলতে পারেন। ওদের প্রকাশ ভঙ্গি অনেক বলিষ্ঠ। নিজেদের অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, ‘লোকলজ্জার ভয়ে আমরা অনেক কিছুই করতে পারিনি। কিন্তু এখনকার তরুণরা সেই বলয় থেকে বেরিয়ে এসেছেন।’ দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও তাকে ভীষণ কষ্ট দেয়। আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমাদের সংসদ ভালোভাবে কাজ করছে না। অথচ এ দেশের গণতন্ত্রের জন্য লাখো মানুষ প্রাণ দিয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা বারবার হুমকির মুখে পড়ছে। চোখের সামনে এ অবস্থা দেখে বিচলিত হই।’ আসাদ চৌধুরী পরিবারের সঙ্গে সময়টা বেশ উপভোগ করেন। স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, বউ, মেয়ের জামাই, নাতনিদের নিয়ে একসঙ্গে টিভি দেখতে, বেড়াতে যেতে খুব ভালোবাসেন।

খেলাধুলার প্রতি বেশ আগ্রহ আছে তার। পছন্দ করেন ক্রিকেট, ফুটবল, টেনিস। সেবারের বিশ্বকাপ ফুটবলে প্রতিটি ম্যাচ দেখেছেন তিনি। আর প্রিয় দল জার্মানী কাপ জেতায় ভীষণ আনন্দ পেয়েছেন তিনি। কথায় কথায় বললেন, ‘এ দেশের ফুটবলের অবস্থা নিয়ে। আমাদের দেশে বড় বড় প্রেক্ষাগৃহ, ইনস্টিটিউট তৈরি হলেও হচ্ছে না ফুটবল খেলার মাঠ। এ দেশের ফুটবলারদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে একটা ভালো জায়গায় পৌঁছে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। প্রান্তিক পর্যায় থেকে ফুটবল প্রতিভা বের করে আনার উদ্যোগের অভাব রয়েছে। অথচ বাঙালী যদি পরিশ্রম করে, তাহলে অনেক দূর যেতে পারে বলে বিশ্বাস করি।’

নিজের লেখা বইগুলোর মধ্যে কোনটা তার কাছে সেরা, জানতে চাইলো; উত্তরে কোনো প্রবন্ধ, উপন্যাস বা গল্পের নাম বলেননি তিনি। নিজের অনূদিত ‘আমি ছোট রাজপুত্র’ বইয়ের কথা বললেন। আরো একটা গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে যারা মারা গিয়েছেন তাদের নিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য একটা বই লিখেছিলেন। যার নাম ‘মৃত্যুহীন গান’। এ বইয়ের প্রথম পর্ব লিখেছিলেন প্রিয় ছাত্র ফারুকের স্মরণে।

গত বছর একুশে পদক পেয়েছেন এ কবি। তবে নিজের কাছে সবচেয়ে বড় পুরস্কার কোনটা, তা বলতে গিয়ে একটা ঘটনার উলে−খ করেন তিনি। এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন আসাদ চৌধুরী। পরদিন পাড়ার এক রিক্সাওয়ালা তাকে বাংলা একাডেমি পৌঁছে দেয়ার সময় বলেছিলেন, কবিতা শুনে ভীষণ মুগ্ধ হয়েছেন তিনি। কবি আসাদ চৌধুরীর কাছে রিক্সাওয়ালার এ ভালো লাগাটাই সবচেয়ে বড় পুরস্কার।

‘তোমায় শুধু জড়াতে চাই নগ্ন বাহু দিয়ে/ তোমার সুরে মেলাতে চাই গলা/ একটু কথা হয়নি আমার বলা’ পয়সার বিনিময়ে বন্ধুদের এমন অনেক প্রেমপত্র লিখে দিয়েছেন আসাদ চৌধুরী।  - বণিকবার্তা