থার্ড টার্মিনাল হবে; কিন্তু থার্ডক্লাশ সার্ভিস কি শেষ হবে?

প্রকাশের সময় : 2020-03-11 12:22:00 | প্রকাশক : Administration থার্ড টার্মিনাল হবে; কিন্তু থার্ডক্লাশ সার্ভিস কি শেষ হবে?

ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীনঃ সাধারণত এমনটা হয় না। কিন্তু গেল মাসে হয়েছিল। বেশ কয়েকবার এয়ারপোর্টে যেতে হয়েছিল। অনেকটা ঘন ঘনই যাওয়া যাকে বলে। কাউকে রিসিভ কিংবা বিদায় করতেই এতবার যাওয়া। তবে এবারের যাওয়া আসাটা কোনভাবেই সুখকর ছিল না। খুবই বিরক্তিকর ছিল। বিরক্তিকর ছিল এয়ারপোর্টের ভেতরকার নানা অভিজ্ঞতাও। নাতিদীর্ঘ অভিজ্ঞতা নয়; দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। নেগেটিভ অভিজ্ঞতাগুলো সাধারণত একটু দীর্ঘই হয়।

তবে দীর্ঘদিন আগের কথা নয়। মনে হয় এই তো সেদিনের কথা। এয়ারপোর্ট নিয়ে এত নেগেটিভ অভিজ্ঞতা তখন ছিল না। আমরা দরকার ছাড়াও ওখানে ঘুরতে যেতাম। এটাই স্বাভাবিক। তৃতীয় বিশ্বের সাধারণ মানুষ বেড়াবার জন্যে এয়ারপোর্টেও যায়। কাছেই আমার বাসা বলে এয়ারপোর্টকে সব সময় বাড়ীর উঠোন মনে হত। বেড়ানোর উপযুক্ত জায়গা মনে হতো। এবং মাঝেমধ্যেই হুটহাট বেড়িয়ে আসতাম। এখন সময় বদলেছে। এখন আর এমন মনে হয় না। মোটেও বেড়ানোর জায়গা মনে হয় না ।

মনে হয়, গঞ্জের বাজার। মানুষে গিজগিজ করে। আবার ঘরের পাশের উঠোনও মনে হয় না। বাড়ী থেকে বহু দূর দূর লাগে। অনেকটা দিল্লীর মত দূর। ছোট বেলায় দূর বললে দিল্লীকেই বুঝতাম। খুব কাছের এয়ারপোর্টও এখন সেই দিল্লীর মতই দূরের হয়ে গেছে। পারতপক্ষে যেতে মন চায় না। আবার চাইলেও যখন তখন যাওয়া যায় না। সময়ের কোন গ্যারান্টি নেই। পৌঁছতে কতক্ষণ লাগবে কেউ জানে না। ভাগ্য ভাল হলে ভিন্ন কথা।

সাধারণত ভাগ্য ভাল হয় না। যথেষ্ট সময় লাগে। সে রাতে লেগেছিল পৌনে দু’ঘন্টা। দুনিয়া ঘুরে ঘুরে সোজা রাস্তা বাঁকা রাস্তা পারিয়ে মাড়িয়ে এয়ারপোর্টের সীমানায় শেষমেষ পৌঁছতে পেরেছিলাম। তবে আসল আঁকাবাঁকা রাস্তার শুরু পৌঁছার পর। ঝিকঝাক ব্যারিকেডের রাস্তা। একবার ডানে, একবার বামে। মহাসড়ক দিয়ে এয়ারপোর্টের মুখে ঢুকতেই গতিরোধের পালা। এভাবে কিছুদূর এগিয়ে টার্মিনালের কাছাকাছি যেতেই গতি একেবারে শুণ্য করে শুরু করে জেরা।

জেরার ধরণও অনেকটা ক্রিমিনাল কেসের মত। অপরাধীর মত আচরণ করা হয় যাত্রী-দর্শনার্থীদের সাথে। জিজ্ঞাসাবাদে ভদ্রতার লেশমাত্র নেই। যেন চোর পুলিশের জেরা। তারা পুলিশ, আমরা চোর। কমান্ডো স্টাইলে চোরের প্রতি পুলিশের হুকুম; জানালা খোলেন, গাড়ীর ভিতরের বাতি জ্বালান, প্যাসেঞ্জার কয়জন, কোন দেশে যাবেন, পাসপোর্ট আর টিকিট দেখান, প্যাসেঞ্জার ছাড়া বাকীরা নামেন। কঠিন হুকুম। হুকুম তামিল না করে উপায় নেই।

বাংলাদেশের এই একটা জায়গায় গেলে সব সময় নিজেকে রিয়েল চোর মনে হয়। ধরা খাওয়া চোরকে যেভাবে জেরা করে ঠিক সেভাবেই জেরা করে। অর্ডার দেয়। চুপচাপ মেনে নেই। মনে না নিলেও মেনে নেই। আর ইজ্জতের ভয়ে আল্লাহ্কে ডাকি এবং ভাগ্য ভাল হলে ছাড়া পাই। এরপর শুরু হয় ঢাল বেয়ে পাহাড়ে ওঠার কসরত। ডিপার্চার টার্মিনাল তো পাহাড়ের চুড়ায়। তবে গাড়ী চুড়ায় উঠতে পারে না। ঢালেই আটকে থাকে। গাড়ীর পরে গাড়ী আটকে আছে। চারলেনের ঢাল বেয়ে গাড়ী ওঠে একলেনে প্রবেশ করবে। আটকে না থেকে উপায় আছে!

উপায়ও নেই; দেখারও কেউ নেই। কেবল আল্লাহ ছাড়া দেশবাসীর এই দূর্ভোগ দেখার আসলেই কেউ নেই। তাই মনে মনে তাঁকেই ডাকি এবং ডাকতে ডাকতেই গাড়ী থেকে নামি। এখানেও পুলিশের দৌঁড়ানি। বেশী সময় নেয়া যাবে না। কোনমতে গাট্টিবোস্কা নামিয়ে গাড়ী ছেড়ে দিতে হবে। ল্যাগেজ চেক করারও সময় নেই। অনেকের ভুলভাল হয়। মালামাল না নামিয়েই গাড়ী ছেড়ে দেয়। পরে শুরু করে হুতাশ। ফোনে হাহুতাশ করে। এক কঠিন যন্ত্রণা। হুতাশীয় যন্ত্রণা। হুতাশীয় দেশের হুতাশীয় এয়ারপোর্ট। যন্ত্রণা তো হুতাশীয়ই হবে।

হুতাশীয় মনে পোটলাপাটলি কোনমতে এক জায়গায় করে ট্রলি খুঁজি। খালি ট্রলি পাওয়া কঠিন। সবই আগে থেকেই কোন না কোন দালালের হাতে থাকে। অগত্যা কোনমতে ট্রলি একটা ম্যানেজ করে লাইনে দাঁড়াই। টার্মিনালের ভেতরে ঢোকার আগেই ওয়াকওয়ে সদৃশ্য ফুটপাথে বিশাল লম্বা লাইন। লাইনের মাথা আছে; গোড়া নেই। আবার জায়গা খুবই সরু। এত এত লোকের জায়গা কোনভাবেই হবার নয়। ট্রলি হাতে একেকজন দাঁড়ালে পাশে অন্য কারো দাঁড়াবার মত সামান্য জায়গাও থাকে না। অথচ সেখানেই যাত্রীকে বিদায় দিতে আসা মানুষেরা গিজগিজ করে দাঁড়ায়। দেশী যাত্রীরাও দাঁড়ায়; দাঁড়ায় বিদেশীরাও। দাঁড়িয়েই থাকে। কেবল সামনে আগাবার সম্ভাবনা থাকে না।

একটুও সামনে আগায় না। একটা গ্রুপ আছে যাদের জন্যে আগাবার দরকার হয় না। গেটের লোকজন ম্যানেজ করে লাইনভেঙেই ঢুকে পড়ে। আর একটা গ্রুপ কাউকে ম্যানেজও করতে পারে না। আর ভেতরেও যেতে পারে না। তাই তারা অপেক্ষা করে আর বিরক্ত হয়। অনেকটা আমার শোনিমের মত। শোনিমও খুবই বিরক্ত হয়। কিন্তু মুখে কিছুই বলে না। অসহায়ের মত কেবল এদিক ওদিক তাকিয়ে থাকে। আমি শোনিমের মুখে অসহায় পুরো বাঙালী জাতিকে খুঁজে পাই। বড় অভাগা এই বাঙালী।

অভাগা এই বাঙালী বেশী হেনস্তার স্বীকার হয় চেকইন এ যাবার পর। এখানে আরেক তেলেস্মাতি। প্রত্যেকটা কাউন্টারে বিশাল লম্বা লাইন। কিন্তু কাউন্টারের অফিসার ব্যস্ত অন্য কারো পাসপোর্টের চেকইন নিয়ে। যার পাসপোর্টের কাজ তিনি লাইনের সামনে নেই। আছে তার জানাশুনা লোক। এরা কেবল জানাশুনা লোক নয়, লাইনঘাট জানাশুনা লোক। এখানে কেবলই লাইনঘাট জানাশুনা লোকদের রাজত্ব। লাইনের লোকদের দাঁড় করিয়ে পেছনে থাকা চেনাজানা লোকদের চেকইন আগেভাগে করে। এসব দেখেও কিছু বলার উপায় নেই। জানতে চাইবার জোঁ নেই। জানতে চাইলেই খ্যাঁচ করে ওঠে; মানে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে।

কথায় কথায় খ্যাঁচ করা হয়ত আমাদের স্বভাবগত। গা সওয়া হয়ে গেছে। তাই কিছু মনে করিনা। চুপচাপ ইমিগ্রেশানে ঢুকে পড়ি। সারাবিশ্বেই ইমিগ্রেশান একটি ওজনওয়ালা শব্দ। শব্দটি শুনলেই কলিজা কেচাং করে ওঠে। যদিও বাংলাদেশের ইমিগ্রেশানে কেউ খ্যাচ্চাতও করে না; তেলে বেগুনেও জ্বলে না। এখানকার তরিকা ভিন্ন। সবাই কৌশলী আচরণ করে। কৌশলে সময় ক্ষেপণ করে যাত্রীর কাগজপত্রের দূর্বল জায়গা খোঁজে। ইচ্ছেকৃতভাবে অফিসাররা এখানে পাসপোর্ট হাতে নিয়ে দেরী করে।

দেরী করার ধরণও দারুণ। প্রথমে আঙুল দিয়ে একটি একটি অক্ষর চাপে আর এন্ট্রি দেয়। তারপর এদিক ওদিক তাকায়। রেস্ট নেয়। পরে আবার অক্ষর চাপে। শুধুমাত্র একটি অক্ষর। এসব দেখেও চুপ করে থাকতে হবে। কোন কথা বলা যাবে না। বললে উল্টাপাল্টা জবাব দেয়। দেয় সফটওয়ারের দোষ। যত দোষ কম্পিউটার ঘোষ। সাথে থাকে হালকা ফোস ফোস। ফোসফোসের কারণে মানুষ কথা আগাতে পারে না। বেশী কথা বলার প্রশ্নই আসে না। ভিসা এবং কাগজপত্র যতই ঠিক থাকুক; কথা বেশী বললেই সমস্যা। আবার দূর্বল থাকলেও সমস্যা। একজন যাত্রী কথাবার্তায় যত দূর্বল, তার সাথে ইমিগ্রেশন তত কঠিন আচরণ করে। কথামালার প্যাঁচে ফেলে। কড়ায় গন্ডায় বিদেশ যাত্রার ব্যাখ্যা চায়।

এ যেন ইমিগ্রেশান নয়; রোজ কেয়ামতের মাঠ। পুরো জীবনের সকল কর্মকান্ডের আমলনামা পর্যালোচনা করার মাঠ। আবালবৃদ্ধবনিতা সকলের দুনিয়াদারীর তাবৎ হিসেব নেয়া হচ্ছে এই মাঠে। আর সবাই লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে পুলসিরাত পাড়ি দেবার জন্যে। ঢাকায় এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশান পাড়ি দেয়া মানে কেয়ামতের মাঠের পুলসিরাত পাড়ি দেয়া। অপেক্ষমানদের বুক ধুকধুক করছে পার হতে পারবে কি পারবে না, এই ভাবনায়। কঠিন দূর্ভাবনা।

নিত্যদিন এভাবেই এইসব ভাবনাময় দূর্ভাবনা নিয়ে দুনিয়াবির পুলসিরাত পাড়ি দিচ্ছে দেশের আমজনতা। আর মাঝেমাঝে জলাঞ্জলী দিচ্ছে স্বীয় ঝুলিতে থাকা যৎসামান্য ইজ্জতও। এতেও দুঃখ থাকে না। কেবল ভাবনা থাকে। প্রত্যেকের একটাই ভাবনা; ইজ্জত যায় যাক, ভিসার মেয়াদ যেন না যায়। প্লেন যেন না নিয়ে চলে না যায়। আর প্রশ্ন; এয়ারপোর্টে নতুন থার্ড টার্মিনাল হবে। কিন্তু যত আধুনিকই হোক; সার্ভিস কি আধুনিক হবে? দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা থার্ডক্লাশ সার্ভিস কি আদৌ কোনদিন শেষ হবে?