যেভাবে পতন হয়েছিলো এরশাদের

প্রকাশের সময় : 2020-03-11 12:32:48 | প্রকাশক : Administration যেভাবে পতন হয়েছিলো এরশাদের

বিএম আলিফঃ সদ্য প্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পাকিস্তান থেকে দেশে ফেরার পর ১৯৭৩ সালে তাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ১২ ডিসেম্বর ১৯৭৩ সালে তিনি কর্নেল ও ১৯৭৫ সালের জুন মাসে সেনাবাহিনীতে ব্রিগেডিয়ার পদে পদোন্নতি পান। ১৯৭৫ সালের ২৪ অগাস্ট ভারতে প্রশিক্ষণরত অবস্থায় তিনি মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি পান ও উপসেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ পান।

১৫ আগস্ট সামরিক অভ্যুত্থানের পর এরশাদ বাংলাদেশের দিল্লী­ মিশনের মাধ্যমে দেশে ফেরার আকাঙ্খা জানিয়ে বার্তা পাঠান। ৩০ মে ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর এরশাদের রাজনৈতিক অভিলাষ প্রকাশ হয়ে পড়ে। ২৪ মার্চ ১৯৮২ সালে এরশাদ রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। ১১ ডিসেম্বর ১৯৮৩ সাল নাগাদ তিনি প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে দেশ শাসন করেন।

১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সালে বেশ কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে গড়ে উঠা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিছিলে সেনাবাহিনীর হামলায় জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দীপালী সাহাসহ অনেক ছাত্রছাত্রী নিহত হয়। তখন থেকে জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে একটি লাগাতার ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর স্বৈরাচারবিরোধী গণ-আন্দোলনের মিছিলে বুকে-পিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক/গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লিখে রাজপথে নেমেছিলেন যুবলীগ নেতা নূর হোসেন।

পরে জিপিওর  সামনে জিরো পয়েন্টের (বর্তমান শহীদ নূর হোসেন স্কয়ার) কাছে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন তিনি। এই হত্যাকান্ডের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ বিরোধীদলগুলো ১১ ও ১২ নভেম্বর সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ঘোষণা করে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়েন, ফলে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন আরও ত্বরান্বিত হয়।

নূর হোসেনের হত্যার পরও স্বৈরশাসন ব্যবস্থা চলমান থাকে আরও ৩ বছর। কিন্তু আন্দোলন অব্যাহত থাকে। ১৯৯০ সালের ১০ অক্টোবর জেহাদ নামে একজন ছাত্র পুলিশ কর্তৃক গুলিবিদ্ধ হলে সেই মৃত জেহাদের লাশকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে তৎকালীন ক্রিয়াশীল সব ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ সেখানে উপস্থিত হয়। ২৪টি ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে গড়ে উঠে ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য’।

সে সময় আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির নেতৃত্বে রাজনৈতিক জোট একইসঙ্গে আন্দোলন কর্মসূচি নিয়ে এগিয়েছে। জামায়াতে ইসলামীও মাঠে ছিলো। ১৯৯০ সালের অক্টোবর মাস থেকে ছাত্র সংগঠনগুলো ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের’ ব্যানারে আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলো। তবে ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর চিকিৎসক নেতা ডাঃ শামসুল আলম মিলনকে হত্যার পর আন্দোলনের মোড় ঘুরে গিয়েছিলো। ডাঃ মিলনকে হত্যার পর জেনারেল এরশাদ বিরোধী আন্দোলন আরও তুঙ্গে উঠে।

তখন জনগণের ক্ষোভের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে শুরু করেছিলো সেনাবাহিনী। একইসঙ্গে জেনারেল এরশাদের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের প্রক্রিয়াও শুরু করেছিলো তারা। এদিকে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের আন্দোলনের সঙ্গে দেশের জনগণ সম্পৃক্ত হলে তা গণ-আন্দোলন থেকে গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। সেই গণ-অভ্যুত্থানে জেনারেল এরশাদ ৪ ডিসেম্বর পদত্যাগের ঘোষণা দেন এবং ৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

পদত্যাগের ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও এরশাদ তার অনুগত নবম ডিভিশনের জিও মেজর জেনারেল রফিকুল ইসলামের উপর নির্ভর করে বাঁচতে চেয়েছিলেন। পরিস্থিতি আঁচ করে সেনাপ্রধান লে. জেনারেল নূরউদ্দীন রফিকের পুরো বাহিনী সাভারে পাঠিয়ে দেন। জেনারেল নূরউদ্দীন এবং সিজিএস মেজর জেনারেল আবদুস সালাম সারাদিন এরশাদের ফোন ধরেননি। সেনা কর্মকর্তাদের একটা বড় অংশ এরশাদের ‘অপকর্মের’ দায় আর বয়ে বেড়াতে চায়নি। ৬ ডিসেম্বর বেলা দুইটায় বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ উপরাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন। এরশাদ নবনিযুক্ত উপরাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। এভাবেই শেষ হয় নয় বছরের এরশাদ-জমানা।