স্মৃতি তুমি বেদনা

প্রকাশের সময় : 2021-09-08 11:19:04 | প্রকাশক : Administration স্মৃতি তুমি বেদনা

অধ্যাপক ড: সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যেকোনো স্মৃতিচারণ করতে হলে হৃদয়ের গভীরে শুনতে হয়, স্মৃতি তুমি বেদনা। কিন্তু এ তো শুধু বেদনা নয়, বুকের ভেতর এক গভীর ক্ষত থেকে নিয়ত রক্তক্ষরণও বটে। বেদনা দৃশ্যমান কিছু নয়, তা অনুভবের ব্যাপার। তেমনিভাবে এ রক্তক্ষরণও দেখা যায় না; যার এমন রক্তক্ষরণ হয়, অনুভূতি শুধু তার বা তাদের। কাজেই বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি মানেই বেদনা আর রক্তক্ষরণ। বঙ্গবন্ধু তো বাঙ্গালীর ইতিহাসে এক বিয়োগান্তক মহানায়কের নাম।

আমার পেশাগত জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর একটি সিদ্ধান্ত, সে কথা বলি এখন। ’৭২-এর মার্চ মাসে কমনওয়েল্থ বৃত্তির জন্য বিশেষ বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছিল। বিশেষ এ কারণে যে, ’৭১-এ বিজ্ঞাপন দেয়া সম্ভব হয়নি। আমি যথারীতি আবেদন করলাম, কিন্তু ব্যর্থ হলাম; এবং তা সবরকম যোগ্যতা থাকলেও বা পূর্বশর্ত পূরণ করলেও। সে বছরই সেপ্টেম্বর মাসে আবার নিয়মিত বিজ্ঞাপন দেয়া হলো। আবারও আবেদন করলাম। তবে কর্তৃপক্ষের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আগে বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত আমার ভাগ্য খুলে দিয়েছিল।

কোনোভাবে বঙ্গবন্ধু জেনেছিলেন যে, আমি মার্চ মাসে কমনওয়েল্থ বৃত্তি পাইনি। তারপর যা ঘটেছিল তা শুনেছি বঙ্গবন্ধুর স্বজন প্রত্যক্ষদর্শীর মুখ থেকে। যা শুনেছি তা-ই এখন বলছি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব জনাব ওয়াজিউল্লাহকে (যিনি বিদেশি বৃত্তির বিষয় দেখভাল করতেন) মার্চ মাসের কমওয়েল্থ বৃত্তির ফাইলপত্র নিয়ে বঙ্গবন্ধু তার সঙ্গে দেখা করতে নির্দেশ দিলেন। তো উপসচিব মশায় পড়ি কী মরি নথিপত্র বগলদাবা করে হাজির হলেন বঙ্গবন্ধুর কাছে।

যারা মার্চ মাসে বৃত্তি পেয়েছিল তাদের সম্পর্কে তথ্য আছে এমন ফাইলগুলো আগে পড়লেন বঙ্গবন্ধু; পরে পড়লেন আমার ফাইল। বেশ উষ্মার সঙ্গে তিনি মন্তব্য করলেন, “এই ছেলেটির তো দেখছি সব যোগ্যতা আছে। আর যারা বৃত্তি পেয়েছে তাদের সবার তুলনায় ছেলেটি ভালো। ও বৃত্তি পেলো না কেন?” বলা বাহুল্য, সেদিন অপ্রস্তুত হওয়া ছাড়া উপসচিব মশায়ের আর কিছু করার বা বলার ছিল না। যাহোক তারপর ছিল বঙ্গবন্ধুর ভৎর্সনা ও নির্দেশ: “তোমরা দেশটারে ডুবাবা। খেয়াল রাখবা এ ছেলে যেন এবার বৃত্তি পায়।”

কমনওয়েল্থ বৃত্তি আমি পেয়েছিলাম; তবে একটি নয়, দুটি। ব্রিটিশ কমনওয়েল্থ বৃত্তির জন্য আবেদন করেছিলাম, সাক্ষাৎকারও দিয়েছিলাম ব্রিটিশ কাউন্সিলে; এবং পেলাম। কিন্তু ক্যানাডিয়ান কমনওয়েল্থ বৃত্তির জন্য কোন আবেদন করিনি; সেটাও আমাকে দেয়া হলো। অর্থাৎ আমি একই সঙ্গে দুটো কমনওয়েল্থ বৃত্তি পেলাম। এমন দৃষ্টান্ত বোধহয় বাংলাদেশে দ্বিতীয়টি নেই। শেষমেশ, আমার পছন্দ অনুযায়ী ব্রিটিশ কমনওয়েল্থ বৃত্তি বেছে নিতে হয়েছিল। এমন বিস্ময়কর ব্যাপারটি ঘটেছিল বঙ্গবন্ধুর কারণে। বঙ্গবন্ধুর নজরে পড়া প্রার্থী আমি; কাজেই আমাকে তো আমলাতন্ত্র বিশেষ সুবিধা দেবে। বলা বাহুল্য, বঙ্গবন্ধু আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন না; কিন্তু আমার সম্পর্কে খোঁজখবর করেছেন আমার কাগজপত্র পড়ে। নেতাকে এমনি হতে হয়; দেশ গড়তে হলে যোগ্যতাকে মূল্যায়ন করতে হয়।

৭৩-এ কমনওয়েল্থ বৃত্তি নিয়ে স্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি নিয়ে আমার এক আত্মগর্বী অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন শাখার প্রধান মিসেস মরিসন বিভিন্ন ঠিকানায় ফোন করছিলেন খালি এ্যাপার্টমেন্টের জন্য। এক পর্যায়ে পাওয়া গেল; এবং ল্যান্ডলেডীকে বলা হল, আমরা বাংলাদেশ থেকে গিয়েছি। তো ল্যান্ডলেডী ফোনেই জিজ্ঞেস করলেন, “হোয়াট ইজ বালাদেশ?” (তিনি বলেননি, “হোয়্যার ইজ বাংলাদেশ?”)। অর্থাৎ বাংলাদেশ যে একটি দেশের নাম, তা তিনি জানতেন না। মিসেস মরিসন আমার কাছে জানতে চাইলেন, তিনি কী উত্তর দেবেন। আমি বললাম, “টেল হার দিস ইজ শেখ মুজিব’স বাংলাদেশ (তুমি তাকে বলো এটা শেখ মুজিবের বাংলাদেশ)।”মিসেস মরিসন তা-ই বললেন; বাড়িও পেলাম। দেশ চেনে না, কিন্তু নেতাকে চেনে-জানে বিদেশের সাধারণ মানুষ। সেদিন আমার বুকটা যেন অনেক বড় হয়েছিল।

আমার বড় বুক ভেঙে খানখান হয়েছিল ’৭৫-এর ১৬ আগস্ট। সেদিন এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগের আমার প্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক কীয়েরনান আমাকে বঙ্গবন্ধু হত্যার খবরটি দিয়েছিলেন। তিনি প্রথমেই আবেগী কণ্ঠে বলেছিলেন, “ইউ হ্যাভ কিল্ড ইওর ফাদার ( তোমরা তোমাদের পিতাকে হত্যা করেছ)।”আমি একটু হতভম্ব হয়েছিলাম। সুতরাং পরের বাক্যে খোলাসা করে বলেছিলেন, “মুজিব হ্যাজ বিন কিল্ড বাই দ্য মিলিটারী (মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে সামরিক বাহিনী দ্বারা)।”কীয়েরনান বলেননি “মিলিটারী কিল্ড”; বলেছিলেন “কিল্ড বাই দ্য মিলিটারী (সামরিক বাহিনী হত্যা করেছে তা না বলে বলেছিলেন সামরিক বাহিনী দ্বারা হত্যা করা হয়েছে)।”অনেক পরে অনুভব করেছি কীয়েরনান-এর ইতিহাসবিদসুলভ বাক্যবিন্যাসের তাৎপর্য। বাংলাদেশ সম্পর্কে তিনি ভালো খোঁজখবর রাখতেন। কারণ তিনি ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ছিলেন।

বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি, তার কথা শুনেছি। আলোড়িত-আন্দোলিত হয়ে স্বাধীনতার স্বপ্নে উন্মাতাল হয়েছি। কিন্তু তার সঙ্গে কথা হয়নি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমার স্মৃতির এটুকু অপূর্ণতা। এ অপূর্ণতা আমার যাপিত জীবনকেই যেন অপূর্ণ করে দিয়েছে। তবে আমার জীবনে বড় সার্থকতা, আমার বর্তমান পদনামের সঙ্গে ‘বঙ্গবন্ধু’ অভিধাটির জড়িয়ে থাকা আমি তো বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক। - (সংকলিত) লেখক: বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনাল্স (বিইউপি)