ব্যারিস্টার রফিক-উল হক

প্রকাশের সময় : 2018-10-10 22:32:47 | প্রকাশক : Admin ব্যারিস্টার রফিক-উল হক

সিমেক ডেস্কঃ ৪৭/১ পুরানা পল্টন। ‘সুবর্ণা’-ছায়াঘেরা, শীতল, ছিমছাম একটি বাড়ি। এ বাড়ির সঙ্গে রাজধানীর খুব বেশি বাড়িকে মেলানো যাবে না। যেমন মেলানো যাবে না এখানে বাস করা মানুষটাকেও। এ বাড়িতেই বাস করেন খ্যাতিমান আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। প্রখ্যাত এ আইনজীবী এক সময় প্রতিনিয়ত সরব ছিলেন আদালত আর মিডিয়ায়।

এখন অনেকটাই নীরব। কেমন আছেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। তাঁর ঘনিষ্ঠজনরা জানান, বার্ধক্য তাকে কাবু করেছে। অনেকদিন ধরে শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। দিন কাটাচ্ছেন অনেকটা নীরবে, নিভৃতে। বই, পত্রিকা পড়ে, টিভি দেখে সময় কাটে তাঁর। পারতপক্ষে বাসা থেকে বের হন না। বের হলেও হুইলচেয়ারই ভরসা। প্রিয়প্রাঙ্গণ সুপ্রিম কোর্টেও এখন নিয়মিত পা পড়ে না তার। যান কালেভদ্রে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নতুন-পুরনো প্রায় সব মামলাই পরিচালনা করেন তার ছেলে ব্যারিস্টার ফাহিমুল হক ও জুনিয়র আইনজীবীরা। তিনি পরামর্শ দেন। পুরানা পল্টনের ওই বাসার নিচতলায় তার চেম্বার বেশিরভাগ সময়ই নীরব থাকে। চেম্বারে দায়িত্বরত একজন বলেন, ‘স্যার বেশিরভাগ সময়ই বাসার দোতলার কক্ষে থাকেন। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া সেখান থেকে নিচে নামেন না। কথা বলেন কম। 

আগে গাজীপুরের চন্দ্রায় তার প্রতিষ্ঠিত হাসপাতাল ও বাগানবাড়িতে যেতেন প্রায় প্রতি সপ্তাহে। এখনও যান তবে, অনিয়মিত।’ সম্প্রতি ব্যারিস্টার রফিক-উল হক’র পুরানা পল্টনের ‘সুবর্ণা’য় কথা হয় তার সঙ্গে। কেমন আছেন? তিনি বলেন, ‘ভালো নেই। বয়স হয়েছে।’ বর্তমান রাজনীতি ও সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কী ভাবছেন- রফিক-উল হক বলেন, ‘আমার এখন মরার বয়স হয়েছে। ওসব নিয়ে এখন আর চিন্তা করি না। ভাবিও না। আগে ভাবতাম। কথা বলতাম। এখন আর বলি না। বলতে চাইও না।’

ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে রাজধানীর বেসরকারি একটি হাসপাতালে তার বাম পায়ে অস্ত্রোপচার হয়। এরপর থেকে তার স্বাভাবিক হাঁটাচলা ব্যাহত হচ্ছে। মাঝেমধ্যে পায়ে ব্যথা হয়। যে কারণে হুইল চেয়ারে যাওয়া-আসা করতে হয়। তার ঘনিষ্ঠজনরা জানান, ২০১১ সালে প্রিয়তমা স্ত্রী ডাঃ ফরিদা হকের মৃত্যুর পর থেকেই নিঃসঙ্গতা অনুভব করতেন তিনি। আর এখন বার্ধক্য যোগ হয়ে সেই নিঃসঙ্গতা আরো বেড়েছে। পুরানা পল্টনের ওই বাসার দোতলায় তাকে দেখাশোনা করেন একাধিক গৃহভৃত্য। তারা জানান, পরিমিত আহার করেন। খাবারের তালিকায় থাকে কাঁচা ছোলা, চা, ভাত, আম, দুধ, চিড়া।

রফিক-উল হকের জুনিয়র এক আইনজীবী বলেন, ‘স্যার লোকসমাগম ও গণমাধ্যম এড়িয়ে চলেন। কারো সঙ্গে বেশি সময় নিয়ে কথা বলেন না। সংবিধান, আইন, আদালত, দেশের রাজনীতির প্রতি এখন আর আগের মতো আগ্রহ নেই। আগে যেভাবে এসব নিয়ে সরব ছিলেন এখন তা একেবারেই নেই। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া আদালতেও আসেন না খুব একটা। স্যারের মামলাগুলো এখন আমরাই পরিচালনা করি। তিনি আমাদের পরামর্শ দেন। পুরানা পল্টনের বাড়িটি তার এত প্রিয় যে এখান থেকে কোথাও যেতে চান না তিনি।’

ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের জন্ম ১৯৩৫ সালের ২রা নভেম্বর কলকাতার সুবর্ণপুর গ্রামে। ১৯৫৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক, ১৯৫৭ সালে দর্শন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। ১৯৫৮ সালে এলএলবি পাস করেন। ১৯৬২ সালে যুক্তরাজ্য থেকে বার এট ল’ সম্পন্ন করেন তিনি। ১৯৬৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে এবং ১৯৭৩ সালে আপিল বিভাগে আইনজীবী হিসেবে আইন পেশা শুরু করেন তিনি।

তিনি একজন মেধাবী ও পরিশ্রমী আইনজীবী। মামলার প্রয়োজনে প্রচুর পড়াশোনা করেন। মক্কেলদের প্রচুর সময় দেন। মামলা পরিচালনাও করেন খুব নিখুঁতভাবে। আদালতে যখন মামলার শুনানিতে আসেন, পুরোদমে প্রস্তুতি নিয়েই আসেন এবং সময়মতো আসেন, কাজ এবং দায়িত্বের ব্যাপারে কখনোই তাকে অধৈর্য হতে দেখিনি। একজন সাহসী ও স্পষ্টভাষী মানুষ হিসেবেও তিনি অন্য সবার চেয়ে আলাদা। স্পষ্ট এবং সত্য কথা বলতে কখনো তিনি কাউকে পরোয়া করেননি।

আইনের ব্যাপারে তার যেমন অগাদ জ্ঞান, তেমনি আইনকে তিনি আইনের দৃষ্টিতে দেখেছেন সবসময়। কোন দল দেখেননি। বিনে পয়সায়ও তিনি অনেকের মামলা পরিচালনা করেছেন। তার যুক্তিতর্ক খুবই স্পষ্ট ও সাবলীল। ব্যক্তি হিসেবেও তিনি অত্যন্ত সদয় ও স্নেহপরায়ণ। একজন স্পষ্টভাষী ও সাহসী মানুষ হিসেবেও তার সুনাম রয়েছে।

ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে কাজ করেছেন। বিগত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জমানায় দুই নেত্রী যখন কারাগারে তখন তাদের জন্য অকুতোভয়ে আইনি লড়াই করেন তিনি।

একই সঙ্গে দুই নেত্রীর সমালোচনা করতেও পিছপা হননি তিনি। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ভাবমূর্তি রক্ষায় বরাবরই সোচ্চার রফিক-উল হক। দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক ও আইনি বিষয় নিয়ে সরকারকে সহযোগিতা করেছেন বর্ষীয়ান এই আইনজীবী। ১৯৯০ সালের ৭ই এপ্রিল থেকে ১৭ই ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন রফিক-উল হক।

কিন্তু কোনো সম্মানী নেননি। এটিও বিরল দৃষ্টান্ত। পেশাগত জীবনে তিনি কখনো কোনো রাজনৈতিক দল করেননি। তবে, নানা সময়ে রাজনীতিবিদরা সবসময় তাঁকে পাশে পেয়েছেন। রাজনীতিবিদদের সম্মান সবসময়ই অর্জন করেছেন তিনি। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক তাঁর জীবনের উপার্জিত অর্থের প্রায় সবই ব্যয় করেছেন মানুষের কল্যাণ ও সমাজসেবায়। আর তাঁর এই উদ্যোগকে বিরল বলে অ্যাখ্যায়িত করেছেন আইন অঙ্গনে তার সমসাময়িকরা। -সূত্রঃ মানবজমিন