ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীনঃ সাংবাদিক ভাইয়েরা বাইরে অপেক্ষায় আছেন। রুম থেকে বেরিয়ে আজ তিনি কী বলেন সেটা শোনার অপেক্ষায়। শুধু সাংবাদিক ভাইয়েরা নয়, অপেক্ষায় আছে সচেতন জনতাও। কিন্তু অপেক্ষার প্রহরও শেষ হয় না; তিনিও বের হন না।এক পর্যায়ে বের হলেন; একেবারে শান্তশিষ্ট ভদ্রক্লিষ্ট গোবেচারার মত বেরিয়ে এলেন। চোখেমুখেসরলতার ছায়া; যেন কিছুই জানেন না, কিছুই শোনেননি। যেন সবেমাত্র স্বর্গ হতে ধরায় অবতরনকরে মিটমিট করে চোখ মেলে তাকালেন।
অনেকটা আমার শোনিমের মতই। শোনিমও মাঝে মাঝে এমনই করে। আশেপাশে কেউ না থাকলে সুযোগ বুঝে পড়াশুনা ফেলে আইপ্যাডে গেমের জগতে বুদ হয়ে থাকে। কারো উপস্থিতি টের পেলে আইপ্যাডটা হাত থেকে ফেলে এমন ভাব করে যেন এই পৃথিবীতে এক পড়াশুনা ছাড়া তার অন্য কোন কাজ নেই। রুম থেকে বেরিয়ে তিনিও অনেকটা এমন ভাব করলেন। ভাবটা এমন করলেন যেন নিজের মন্ত্রণালয় ছাড়া তার মাথায় আর কিচ্ছু নেই। সাংবাদিকদের চোখে চোখ পড়তেই মোবাইলটা হাতে নিয়ে মনিটরটা পরখ করে আবার রেখে দিলেন পকেটে।
কোন কারণ ছিল না। কাজটা তিনি এমনি এমনি করলেন। তবে লক্ষ্য ছিল। লক্ষ্য একটাই কোন রকমে সাংবাদিকদের পাশ কাটিয়ে লিফটে ওঠা। কিন্তু তাতো হবার নয়। সবাই হুমরি খেয়ে পড়লেন। সবার একটাই কথা; স্যার কিছু একটা বলেন। সারাদেশ থমকে গেছে; অচল। কিন্তু স্যারের মুখে আজ রা নেই। ক্যামেরা, মাইক্রোফোন সব নড়েচড়ে উঠলো। তবুও স্যারের মুখ নড়ে না; কেবল চড়ার চেষ্টা। কোনমতে সবাইকে ঠেলেঠুলে লিফটে চড়ার চেষ্টা। এবং কোন কথা নাই, কোন কথা নাই বলতে বলতেই তিনি লিফটে উঠেও গেলেন।
সচিবালয়ের লিফট। একটানে নীচতলায়। শান্তস্নিগ্ধ সচিবালয়। অবশ্য সচিবালয়ের ভেতরটা এমননিতেও সর্বদা শান্তই থাকে। আজকেও শান্ত। তবে বাইরের চেহারা বেশ জটিল; এবং একেবারেই ভিন্ন। আজ রাস্তায় কোন গাড়ীঘোড়া নেই। অবশ্য ঘোড়া থাকার কথাও না। অনেক অনেক দিন আগে থাকতো। এখন থাকে না। এখন আছে মানুষ; নিরুপায় অজস্র মানুষ। সবাই গাড়ির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। রাস্তায় আজ কিচ্ছু নেই। না আছে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট, না আছে প্রাইভেট। সবকিছু জোর করে বন্ধ করে দিয়েছেন এই মন্ত্রীবাহাদুরের লোকজন।
আজকে তারা ভীষন ক্ষ্যাপা। অনেক হয়েছে; আর নয়। সহ্যের একটা সীমা আছে। এবার কিছু একটা বিহিত করতেই হবে। যেভাবেই হোক রাস্তায় নিজেদের রাজত্ব কায়েম করতে হবে। কোনভাবেই রাস্তায় কারো কোন গাড়ী চলতে দেয়া যাবে না। কী সরকারী, কিংবা বেসরকারী অথবা ব্যক্তিগত। কাউকেই এলাউ করা হবে না। তারা ধর্মঘট ডেকেছিল শুধু নিজেদের গাড়ী দু’দিন চালাবে না বলে। কিন্তু রাস্তায় ভিন্ন চেহারা, ভিন্ন উম্মাদনা।
সকাল থেকেই পরিবহন শ্রমিকরা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নিয়েছে। বলা চলে শক্ত অবস্থান। প্রথম দিনেই তারা বিভিন্ন পয়েন্টে সহিংস হয়ে ওঠে। পোস্তগোলা, কেরানীগঞ্জ, যাত্রাবাড়ী, ডেমরাসহ বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিকরা এ্যাম্বুলেন্সসহ বিভিন্ন পরিবহন থামিয়ে চালকদের মুখে কালি লাগিয়ে দেয়। আন্দোলনের এ এক অভিনব মাত্রা। হাবাগোবা সেজে প্রথমে জানালায় টোকা দিয়ে গ্লাস খুলতে বলে। ভিতর থেকে গ্লাস খুলতেই পেছনে রাখা কালিমাখা হাতটি লাগিয়ে দেয় যাত্রী কিংবা ড্রাইভারের গালেমুখে। যেমন তেমন কালি নয়; বিষাক্ত পোড়া মবিল। লাগিয়েছে আলকাতরাও। পুলিশের সামনেই লাগিয়েছে। এভাবে দিনভর দেশের বিভিন্ন স্থানে অটোরিক্সা, এ্যাম্বুলেন্স চালকদের মুখে ও গায়ে পোড়া মবিলসহ আলকাতরা লাগিয়ে দিয়েছে আন্দোলনরত শ্রমিকরা।
বাদ থাকেনি কলেজের ছাত্রীরাও। ওদের কলেজ ড্রেসেও মেখে দিয়েছে পোড়া মবিল। যেন ক্ষোভের আগুনে জ্বলেপুড়ে অঙ্গার হওয়াদের একমাত্র প্রতিপক্ষ ঐ ছাত্রছাত্রীদের দল। সাধারণ যাত্রীদের চেয়ে শিক্ষার্থীদের উপরই ওদের ক্ষোভবেশী। স্কুলকলেজের ড্রেস পেলেই সাধ মিটিয়ে ক্ষোভ ঢেলেছে। নেচে নেচে উল্লাস করেছে নারায়ণগঞ্জে। নারায়ণগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীদের বহনকরা গাড়ি ভাংচুর ও শিক্ষার্থীদের গায়ে কালি ছুড়ে ওরা আদিম প্রবৃত্তিতে উল্লাস করেছে।
এভাবে পরিবহন ধর্মঘটের নামে নৈরাজ্য করে সারাদেশে দিনভর চরম জনদুর্ভোগ সৃষ্টির মধ্য দিয়েই তারা আন্দোলনের নামে কায়েম করেছে ত্রাসের রাজত্ব। ভাবখানা এমন, তারা রাস্তার রাজা; সকল আইন কানুনের উর্ধ্বে। ইচ্ছেমত গাড়ী চালাবেন। চালিয়ে মানুষজন মেরে ফেলবেন। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধেরাষ্ট্র কোন ব্যবস্থা নিতে পারবে না। এমনই মানসিকতা থেকেই সদ্য পাস হওয়া সড়ক পরিবহন আইনের কিছু ধারা সংস্কার ও আট দফা দাবি আদায়ে সকাল থেকে টানা ৪৮ ঘন্টার কর্মবিরতির ডাক দেয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন।
মূলত কর্মবিরতি করেনি; করেছে ধর্মঘট। আর চালিয়েছে তান্ডব। বিভিন্ন পরিবহন ভাংচুরের অভিযোগও মিলেছে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে। পরিবহন শ্রমিকদের বাঁধার কারণে অফিসমুখী যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। কেউ পায়ে হেঁটে আবার কেউবা ভ্যানে বাড়তি ভাড়া দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছেছেন। এ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবাও ছিল সীমিত। ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষার পরও এ্যাপে মোটরসাইকেল পাননি অনেকেই। আবার ছুটি নিয়ে যারা ঢাকার বাইরে গিয়েছিলেন তাদের বেশিরভাগই আটকা পড়েছেন।
আতঙ্কিত হয়েছে আপামর জনগণ। সামনে নির্বাচন। এ নিয়ে এমনিতেই আতঙ্কের সীমা পরিসীমা নেই। আতঙ্ক কিংবা শংকায় আছে সরকারও। অথচ এর উপর ঘি ঢালতে এসেছে পরিবহন সেক্টর। স্বয়ং কেবিনেট সদস্যের নেতৃত্বেই ঘি ঢালার কাজটি হচ্ছে। ক্ষমতায় থেকেই এভাবে ক্ষমতাকে শংকায় ফেলার নজির কালেভদ্রে খুব একটা দেখিনি। গেল তিনমাসে আমজনতা দেশব্যাপী দু’দুটি অপ্রত্যাশিত আন্দোলন দেখেছে। যার রেশে ভোগেছে পূরো দেশবাসী তথা দেশ। দুটো অপ্রত্যাশিত ঘটনার সাথেই জড়িয়ে ছিলেন কেবল ঐ একজন মহাক্ষমতাধর ব্যক্তি।
ক্ষমতার দাপটে সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থী হত্যাকান্ডের সংবাদ তিনি সহাস্যে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন অন্য দেশের তুলনায় এটা তেমন কিছুই না। তার এই মহাদায়িত্বহীন কথাবার্তা পূরো দেশেকে কাঁপিয়ে দেয়। কাঁপিয়ে দেয় সরকারের শক্ত ভিতকে। সারা দেশে ছিঃছিঃ শুরু হয়। সদা হাসিমাখা মুখখানি এতেও গোমরা হয়নি। মলিন হয়নি। সরকার পরিস্থিতি কোনমতে সামাল দিয়েছে বটে; কিন্তু তাঁর উপর আচড় লাগেনি সামান্যটুকুও। তিনি বহাল তবিয়তেই ছিলেন।
তিনি এখনো বহাল তবিয়তেই আছেন। কেবল নেই হাসিমাখা সেই বদনখানি। এবার এটাকে তিনি কৌশলে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছেন। জনতার নেতা না হতে পারলেও চরম অভিনয় করে পরম অভিনেতা হতে পেরেছেন। এবং পেরেছেন দেশবাসীকে জিম্মি করে সরকারকে পুনরায় বিব্রত করতে। কিন্তু ভাবখানা এমন করেছেন যেন তিনি কোন কিছুর সাথেও নেই, পাছেও নেই।
ভাবখানা তিনি যেমনি করুন, আমজনতা বিষয়টিকে মোটেই ভালভাবে গ্রহন করেনি। শ্রমিক সংগঠনের একজন প্রধান নেতা সাংগঠনিক নেতৃত্বে থেকেও কেবিনেটে মন্ত্রিত্ব করবেন এটা জনতা কিছুতেই মানতে পারছে না। বিষয়টি একদিকে যেমন হাস্যকর, অন্যদিকে ভয়ংকর হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে। কেবিনেটে যে আইন তাঁর উপস্থিতিতে পাশ হয়, সেই আইনেরই বিরোধিতায় তিনি নামেন রাজপথে। করেন সহিংসতা। জাতির সঙ্গে ঠাট্টা মশকরা করার বড় উপমা এর চেয়ে আর কিছুই হতে পারে না।
এসবে জাতি খুবই অসহায় বোধ করে। ধিক্কার দেয়। ধিক্কার দেয় গোটা সরকারকে। আর সরকার হয় বিব্রত। বারবার সরকারকে এরূপ বিব্রতকর অবস্থায় ফেলা এই খান সাহেবের খুঁটির জোর কোথায় তা জনগণ বোঝেও না। জানেও না। অহেতুক একের পর এক ঘটনার জন্ম দিয়ে তাঁর বহাল তবিয়তে থাকার বিষয়টি দেখতে দেখতে জনগণের জানার আগ্রহও শেষ হয়ে গেছে। আর আগ্রহ থাকলেই বা কি? ফ্যালফ্যাল করে তাঁর সকল কর্মকান্ড চর্মচোক্ষেদেখা ছাড়া আমজনতার কিচ্ছু করারও নেই।
সচিবালয়ের লিফট থেকে নেমে খান সাহেব পতাকা লাগানো গাড়ীতে চড়ে বাড়ীতে গিয়েছেন। পরিবহন শ্রমিকদের চোখের সামনে দিয়েই গিয়েছেন। এতে তাঁর কোন সমস্যা হয়নি। সমস্যা হয়নি তাঁর গাড়ীর ড্রাইভারেরও। তাদের জানালার গ্লাস খুলে চোখেমুখে কেউ পোড়া মেবিল মাখিয়ে দেয়নি। কিংবা দেয়নি আলকাতরার দাগ। তবে রাস্তার মানুষদের মুখে এসব দাগ দেখে নিশ্চিত তাঁরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছেন। ধর্মঘট আর আন্দোলনের সফলতায় হেসেছেন। গোঁফের ফাঁকে দাঁত বের করে হা হা করে হেসেছেন।
বড় কদাকার বিশ্রী সে হাসি! কিন্তু হাসতে পারেনি বাংলাদেশ! কিভাবে পারবে? গোবেচারা গোঁফের ফাঁকে হা হা করে হাসছে বেশ! পোড়া মোবিলের গন্ধে মাখা লাঞ্ছিত আজ বাংলাদেশ!!