চ্যালেঞ্জিং মিশনে সাহসিকতার পুরস্কার

প্রকাশের সময় : 2018-11-07 17:44:25 | প্রকাশক : Admin চ্যালেঞ্জিং মিশনে সাহসিকতার পুরস্কার

রীতা ভৌমিকঃ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে এ বছরও বাংলাদেশ উইমেন পুলিশ অ্যাওয়ার্ড ২০১৮ পেয়েছেন ২০ নারী পুলিশ সদস্য। তাদের মধ্যে অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন বাংলাদেশ পুলিশ হেড কোয়ার্টার এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার শামিমা। ইয়াছমিন পিসকিপিং মিশন ক্যাটাগরি ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রেনিং-২) মৌসুমী মণ্ডল এক্সেলিনেন্স ইন সার্ভিস ক্যাটাগরিতে। তাদের সঙ্গে কথা- কাজের স্বীকৃতি পেতে ভালো লাগে।

মৌসুমী মন্ডল যে কোনো কাজের স্বীকৃতি পেতে ভালো লাগে। ‘এক্সেলিনেন্স ইন সার্ভিস’ অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তিতে কাজের প্রতি আমার কর্মস্পৃহা, উৎসাহ বেড়ে গেল। সব সময় কাজের স্বীকৃতি মিলবে তাও কিন্তু নয়। এরপরও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে। শামীমা বেগম স্যার আমাকে কাজে খুবই উৎসাহ দিয়েছিলেন। স্যারের অনুপ্রেরণায় মনে হয়েছে সত্যিই তো আমি মানুষের জন্য কাজ করতে পারি বললেন বাংলাদেশ পুলিশ হেডকোয়ার্টারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রেনিং-২) মৌসুমী মন্ডল।

শিক্ষকতা থেকে - পুলিশে আসবেন এমনটা স্বপ্নেও ভাবেননি খুলনার ডুমুরিয়ার মেয়ে মৌসুমী মন্ডল। তার স্বামী ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট, পোস্টিং ছিল যশোর জেলা অফিসে। আর তিনি ঢাকার উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইংরেজির প্রভাষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার স্বামী চাইতেন না তিনি বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেন।

কিন্তু তিনি গোপনে বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। তার বাবা অ্যাডভোকেট রবীন্দ্রনাথ মন্ডল চাইতেন মেয়ে এডমিন ক্যাডারে চাকরি করবে। তার বাবাও মেয়ের বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রস্তুতির খবর না জানলেও মা ও বোন বিষয়টি অবগত ছিলেন। তার পছন্দের তালিকায় পুলিশ ক্যাডার ছিল চার নম্বরে।

প্রিলিমিনারি পাস করার খবর তিনি তার স্বামীকে জানান। সেবার পরীক্ষা খুব কঠিন হয়। স্ত্রীর বিসিএস প্রিলিমিনারি পাসের খবর শুনে বর তো মহাখুশি। লিখিত পরীক্ষায় বসার অনুমতি মিলল তার। বিসিএস লিখিত পরীক্ষার ফলাফল বের হলে তার স্বামী অন্য ক্যাডার তালিকায় রোল নাম্বার খুঁজলেও পুলিশ ক্যাডারে খোঁজেননি। ধরেই নেন তিনি পাস করেননি। তার ছোট বোন এক পুরুষ সহকর্মীকে নাম্বারটা দেন বোনের ফলাফলটা দেখার জন্য। ছোট বোনের ওই সহকর্মী ফোন করে সুখবরটা জানান। তিনি বলেন, পুরুষ হলে তো অনেক বড় দান মেরেছে। মেয়ে হলে একটু অসুবিধা।

বোন সঙ্গে সঙ্গে মৌসুমী মন্ডলকে ফোন দিয়ে জানায়, তার পুলিশ ক্যাডারে হয়েছে। সারদা পুলিশ একাডেমিতে এক বছর প্রশিক্ষণ নেন। তার স্বামী ভেবেই নেন তিনি ট্রেনিংটা সম্পন্ন করতে পারবেন না। মৌসুমীর মা-বাবাকে খবারটা জানায়। তার বাবা-মা ভয় পেয়ে যান, মেয়ে কি চাকরি পেল! তিনি নিজেও ভয়ে চারদিন গুটিয়ে ছিলেন।

আসলে তার স্বামীর আশংকা ছিল তাদের পোস্টিং একই জেলায় হবে না। এরপর আবার কলেজে যাওয়া শুরু করেন। কিন্তু তার স্বামীর সহকর্মী কাজী নিশাত রসুল ও সেলিনা বেগম তাকে সাহস জোগান। উৎসাহ দেন। তারা বলেন, ‘তুমি শুনেছ কেউ ট্রেনিং সম্পন্ন না করে ফিরে এসেছে?’ তাদের কথায় মৌসুমী মনে জোর পান। এদিকে বাবা-মাও তাকে উৎসাহ দেন। কারণ এবার তাদের স্বপ্ন পূরণ হবে। আত্মীয়- স্বজনরা তাকে ডাক্তারি পড়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। আর তার বাবা চেয়েছিলেন মেয়ে ইংরেজি সাহিত্যে পড়ে বিসিএস এডমিনিস্ট্রেশনে যোগ দিবে।

সারদা পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণকালীন কোনো সমস্যা হয়েছিল কি না জানতে চাইলে মৌসুমী মন্ডল বলেন, ২০১০ সালের ১ ডিসেম্বর যোগদান করি। প্রশিক্ষণ ছিল খুবই কঠিন। আমার ওজন বেশি ছিল। ওজন না কমিয়ে ট্রেনিং করা সম্ভব ছিল না। প্রথম মাসে ট্রেনিং করে আট কেজি ওজন কমাই। দু’মাসে আরও তিন কেজি ওজন কমে যায়। হাঁটতে কষ্ট হতো। পুরুষদের সঙ্গে সমান তালে প্যারেড, শারীরিক কসরতগুলো করতে মাসদুয়েক কষ্ট হয়েছে।

এরপর ভালো করতে থাকি। ঘোড়ায় চড়া, লাফ দিয়ে ওয়াটার ডিস পার হওয়া, পাঁচ ফুট কাঁঠের দেয়াল টপকানো ইত্যাদি প্রশিক্ষণে ছিল। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে ট্রেনিং শেষে আমি ছয় মাসের প্রবেশনাল পিরিয়ডে যোগদান করি মানিকগঞ্জ জেলায়। এরপর পোস্টিং হয় ২০১২ সালের জুলাইতে ঢাকা মেট্রোপলিটন সহকারী কমিশনার (স্পোর্টস অ্যান্ড কালচার) পদে। এখন স্বামীও তাকে সহযোগিতা করছেন।

বাংলাদেশ পুলিশ হেডকোয়ার্টারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (কমিউনিটি পুলিশিং) খন্দকার শামিমা ইয়াছমিন সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদান করেন ২০০৫ সালের ২ জুলাই। বাংলাদেশ থেকে ২০১০-১১ সালে প্রথম নারী পুলিশ সদস্য হিসেবে হাইতি শান্তিরক্ষা মিশনে ফিমেল এফপিইউ পার্সোনেল অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

প্রথমবার হাইতিতে যাওয়া, দক্ষতা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করা ছিল তার জন্য চ্যালেঞ্জিং। চ্যালেঞ্জে এবং দক্ষতার সঙ্গে তিনি এক বছর কাজ করেন।

দ্বিতীয়বারও তিনি ২০১৬-১৭ সালে পার্সোনেল ম্যানেজমেন্ট সেকশন এ পার্সোনেল অ্যান্ড এডমিন অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ প্রসঙ্গে খন্দকার শামিমা ইয়াছমিন জানান, দৈনন্দিন, সাপ্তাহিক ও মাসিক কাজের প্রতিবেদন নিয়মিত জাতিসংঘ সদর দফতরে প্রেরণ করতাম। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের কন্টিনজেন্টের সঙ্গে সমন্বয় করে জাতিসংঘের ম্যান্ডেট অনুযায়ী শৃঙ্খলা ও কার্যক্রম এবং নতুন নির্দেশ তাদের অবগত করতেন।

নরসিংদী সরকারি কলেজ থেকে ১৯৯২ সালে বি এ পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৪ সালে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ করেন। স্বামীর অনুপ্রেরণায় তিনি বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। বিসিএস ক্যাডার তালিকায় তার প্রথম পছন্দ ছিল পুলিশ। কারণ তার বাবা খোন্দকার আবদুল হালিম ছিলেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। তার বাবাও তাকে পুলিশে চাকরিতে উৎসাহ দিতেন। পাঁচ ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি ষষ্ঠ। সারদা পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণ শেষে ২০০৬ সালে সহকারী পুলিশ কমিশনার হিসেবে তার প্রথম নিয়োগ হয় ঢাকা মেট্রোপলিটনের অর্থ বিভাগে।

পুলিশে কাজ করতে কেমন লাগছে জানতে চাইলে খন্দকার শামিমা ইয়াছমিন বলেন, সারদা পুলিশ একাডেমিতে এক বছরের প্রশিক্ষণ আনন্দের সঙ্গে করেছি। সহকারী পুলিশ কমিশনার হিসেবে ২০০৬ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ডিএমপিতে অর্থ, প্রশাসন, শৃঙ্খলা ইউনিটে পর্যায়ক্রমে দায়িত্ব পালন করি। ২০১১ সালে সেরা কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ আইজিপি ব্যাজ পেয়েছি।

২০১২ সালের জুন মাসে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে র‌্যাবে যোগদান করি। ২০১২-১৫ সাল পর্যন্ত র‌্যাব-৩এ সিপিএসসি (ক্রাইম প্রিভেনশন স্পেশালাইস্ট কোম্পানি) তে কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে প্রায় তিন বছর দায়িত্ব পালন করেছি। এখানে দায়িত্ব পালনকালে সেরা কাজের জন্য বেসবট কোম্পানি কমান্ডার এবং সিপিএইচসি কোম্পানি চ্যাম্পিয়ন পুরস্কার পাই। ২০১৫ সালের মে মাসে বদলি হয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) হিসেবে যোগদান করি।