সিমেক ডেস্কঃ সারা জীবনই তার বিরোধিতা করেছি। অমূলক কোনও কারণে তা করিনি। বরং বলতে গেলে করার কারণগুলোই যৌক্তিক। আমাদের যৌবনকে তিনি প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। সকালে এক কথা, বিকেলে আরেক কথা। একটা দেশের প্রেসিডেন্ট অথচ তার কথায় কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা নাই, এটা কি মানা যায়?
যেমন ধরুন, নিজের জীবন নিয়েও তিনি হাসিখেলা খেলতেন। রূপকথার গল্পে আমরা পড়েছি রাজা আটকুঁড়ে হলে নাকি অমঙ্গল হয়। এগুলো ধারণা মাত্র। আগের দিনে সংস্কার আর মানুষের বিশ্বাসই ছিল পুঁজি। কিন্তু ইনি এসেছিলেন আশির দশকে। দুনিয়া তখন অগ্রগামী। পাশের দেশ গণতন্ত্রের সুবাতাস পায় আর সীমান্তের এধারে আমাদের মাথার ওপর চেপে বসে এক পাথর। সাহিত্য-সংস্কৃতি-বিনোদন সবকিছু তার কব্জা করতে হবে। নিরীহ প্রেমময় মাধ্যম কবিতাও বাদ গেল না। সরকারী টাকায় ‘কনক প্রদীপ জ্বালো” নামের এক ঢাউস সুন্দর কবিতার বই লিখে কলকাতার দাদাদের ধরে এনে কবি বনে যাবার কি চেষ্টা! দেশের আমলা কবি, সরকারী কবি, স্তাবক কবিরাও জুটে গেলেন। বঙ্গভবনে কবিতা পাঠের লোভে তারাও দাঁড়িয়ে গেলেন লাইনে।
আগে এরশাদ সাহেবের ব্যক্তিজীবনের সেরা মিথ্যাটা বলি। দেশের মানুষ বলা নাই কওয়া নাই হঠাৎ কোনও নিশানা চিহ্ন ছাড়াই দেখলেন রাণীমাতা পুত্র সন্তানের জননী হয়ে গেলেন। পরে সেই পুত্র কোথায় বা কী করে আর কেউ ভালোভাবে জানতে পারলো না। সেই প্রেসিডেন্ট এখনও রাজনীতি করেন। আর আমাদের দেশের রাজনীতি মানেই তো বংশ পরম্পরা। রক্তের উত্তরাধিকার। অথচ এরশাদ সাহেবের পুত্রের খবর নাই। আসল পুত্র হলে এতোদিনে সেই হতো জাতীয় পার্টির কান্ডারী।
বলছিলাম তার কবিতার কথা। কখন লেখেন, কোথায় লেখেন, কেন লেখেন- কেউ দেখেনি, জানেও না। একে রাষ্ট্রপতি তাও আবার জেনারেল! ফলে কে না লিখে দিয়ে পারে? নিজে যদি এক স্তবক লিখেন তো বাকীরা লেখে হাজার লাইন। রাজনীতিতে ছাপোষা বিরোধী দলও দেখলাম প্রথমবার। বলা নাই, কওয়া নাই একদা জাসদ নেতা তখনও বয়স এত হয়নি সেই আ স ম রব চলে এলেন সম্মিলিত বিরোধী দল, যার পোশাকী নাম ছিলো কপ বা কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টির নাম ভূমিকায়। এ লোক তখন জেনারেলের তাঁবেদার।
তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়া মানুষ। অথচ তিনিই বলতে শুরু করেছিলেন এই প্রেসিডেন্টও নাকি মুক্তিযোদ্ধা। কোনও সেক্টর বা কোনও যুদ্ধের নামগন্ধ নাই। আবার দেখুন গদি হারানোর পর রব কোনদিনও এরশাদকে মুক্তিযোদ্ধাও বলেন না, কোন সম্মানও করেন না। এখন যে বিএনপি নেতা মওদুদকে দেখছেন ইনি ছিলেন তার তল্পিবাহক। রাতদিন তার ভজনা আর বন্দনা ছাড়া আর কিছু করতেন না। কিন্তু যেই কিনা গদি গেল তো, আম-ছালা হারানোর ভয়ে চলে গেলেন বিএনপিতে। এই প্রেসিডেন্ট দেশের রাজনীতির বারোটা তো বাজালেনই, তার আমলে বাকরুদ্ধ ছিল মিডিয়া।
আমরা খবরের কাগজ বা টিভিতে কাজ করার এমন সুযোগ দূরে থাকুক ন্যূনতম আশাও করতাম না। কারণ মিডিয়াই খোলার অনুমতি ছিলনা তখন। ফলে ছাত্র-যুবক আর সাধারণ মানুষের আন্দোলনের মুখে তাকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। তারপর আর যাই হোক বা না হোক হুড়মুড় করে মিডিয়ার দরজা খুলতে শুরু করলো। মুক্ত হতে শুরু করলো মানুষের জীবন।
মানুষটির ভালো দিক নাই? আছে। না থাকলে কিভাবে পতনের পরপর জেলে থেকেও ভোটে জেতেন? রংপুর এলাকায় তাকে হারানোর মানুষ পয়দা হয়নি। যা প্রমাণ করে এলাকায় তিনি তুমুল জনপ্রিয়। প্রতি নির্বাচনে জিতে রেকর্ড করা জেনারেলের আরেক গুণ। ভদ্রলোকের আরেক গুণ সুন্দর করে কথা বলা। ভালো করে গুছিয়ে কথা বলা তিনি ভালোই শিখে গেছেন।
সবকিছু ছাপিয়ে তার যে গুণ বা দোষ তাকে বিখ্যাত করে রেখেছে তার নাম প্রেম অথবা সম্পর্ক। বাংলাদেশে এমন প্রেমিক, এবং স্পর্শকাতর এক্স প্রেসিডেন্ট দ্বিতীয় কেউ নাই।
তিনি নিজেই বলেন, তিনি যান না নারীরাই তার কাছে আসে। কথাটা মিথ্যা না। কবিকন্যা বিদিশা থেকে মেরি মরিয়ম, গায়িকা-নায়িকা এমন কি শেষ বয়সে পাশে ভিড় করা রমণীরা বারবার জানিয়ে দিয়েছে তাকে তাদের কতটা পছন্দ। এর পেছনে নিশ্চয়ই নানাবিধ কারণ আছে। নারী নই বলে আমি তা বুঝিনা।
রাজনীতিতে টিকে থাকার আরেকটা কারণ হলো তার চতুরতা। সবাই যা বলে বলুক তিনি খুব ভালো বোঝেন, কখন কোথায় থাকতে হবে। এবারের আগের বারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, শেখ হাসিনা ও দেশকে বিপদে ফেলার জন্য বিএনপি- জামায়াত-হেফাজত মিলে সেকি ধুন্দুমার কাণ্ড বাঁধিয়েছিল। নৈরাজ্য আর অরাজকতার সেই সময়ে তার ভূমিকা ছিল রহস্যজনক। তবে নির্বাচনে যাবো না যাবো না করে হাসপাতালে গিয়ে শুয়ে পড়ে লোক হাসালেও তিনি এবং তার দল দেশকে সম্ভাব্য বিপদের হাত থেকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছিল। অতি চালাকির কারণে বৌ সম্মানিত হলেও তিনি তার পাওনা আদায় করে বিশেষ দূত হতে ছাড়েননি।
এই মানুষটির আর দুটি গুণের কথা বলে শেষ করবো। নির্মলেন্দু গুণ লিখেছিলেন-ঘোরতর বিরোধিতা করতেন এমনকি বিরুদ্ধে কবিতা লিখতেন জেনেও তার কন্যা মৃত্তিকা গুণকে সেনাকুঞ্জের এক অনুষ্ঠানে এরশাদ কাছে টেনে নিয়ে বলেছিলেন তিনি কতটা তার বাবার ভক্ত।
আজীবনই এরশাদ নেতা থেকে গেলেন। থাকলেন মিডিয়ার পাদপ্রদীপের আলোয়। তার মতো কথায় কথায় আলোড়ন তোলা নেগেটিভ-পজেটিভে মিডিয়া মাতিয়ে রাখা বিনোদনে ভরপুর কেউ নাই রাজনীতিতে। এটা মানতেই হবে জেনারেল এরশাদ একাই একশ। ‘একশতে এক’- একজন নেতা এবং রাজনীতিবিদ।