অস্ট্রেলিয়া দূতাবাসে ভিসা প্রসেসিংয়ে পনের হাজারটা টাকা স্রেফ গচ্ছা। আমরা ছয় বন্ধুর কাউকেই ভিসা দেয়নি। মনটা ভীষণ খারাপ। বন্ধু রাসেল সবুরের মাথায় এলো নতুন বুদ্ধি, ধুত্তুরি অস্ট্রেলিয়া! যামুই না! বেড়ানোর জন্য দেশের অভাব আছে?
তা যে নেই, সে তো আমরাও জানি। কিন্তু সেটা কোথায়? রাসেল সবুরের কঠিন সিদ্ধান্ত - দুবাই! দুবাই! ওখানে তো বাংলাদেশীরা চাকরি করতে যায়। আমরা যাবো বেড়াতে। ওরা আমাদের বলে ''মিসকিন'' মানে ফকিন্নি। ব্যাটারা এবার দেখবে, বাংলাদেশীরা কাজ করে খায়, ভিক্ষা করে না। পয়সা খরচ করে দেশ-বিদেশে বেড়ায়ও।
কঠিন যুক্তি। আমরা সবাই রাজি হয়ে গেলাম। কুরবানির ঈদের দিন রাতেই দিনক্ষণ ঠিক করে রাখা ছিল। এয়ার এ্যারাবিয়ার ফ্লাইটে আমরা শারজাহ বিমানবন্দরে পা রাখলাম । ইমিগ্রেশনসহ আনুষঙ্গিক কাজকর্ম সেরে বের হতেই দেখি, আমাদের অপেক্ষায় আছেন ট্যুর কোম্পানির পাকিস্তানী গাইড গুলাম মুস্তফা শরীফ। ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন শহর। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই দুবাই এডমিরাল প্লাজা হোটেলে পৌঁছে যাই। ফ্রেশ হয়ে হোটেল জিমে খানিক ব্যায়াম, গোসল এবং বুফেতে ৭২ রকমের নাস্তার আইটেম থেকে চেনাজানা কয়েক পদ নিয়ে নাস্তার পর্ব সেরে নিলাম। এ পর্বে বিশাল গ্রাউন্ডে পিনপতন নীরবতার মধ্যে বিশ্বের নানা দেশের শত লোকের সম্মিলন দেখে আমরা বিমোহিত হই।
বিকালে ট্যুর কম্পানির আধুনিক মার্সিডিস বেঞ্জ গাড়ি আমাদের নিয়ে গেল মরুভূমিতে। উঁচুনিচু বালুময় পথে গাড়ি প্রায় উল্টে যাচ্ছে। এমনই পথে চালক কেবলিই গাড়ি ঘুরাচ্ছিলেন। আমাদের গাড়ীর ওপর এসে গড়িয়ে পড়ছিল মরুভূমির বালি। বুঝলাম এমন পথ ও চালনাকেই ডেজার্ট সাফারি বলা হয়। সাফারির শুরুতেই আমাদের সহঅভিযাত্রী ঢাকার বাসিন্দা শরফরাজ ও তার স্ত্রী খুবই ভয় পেয়ে যান। তারা কেবলই সৃষ্টিকর্তাকে জোরে জোরে ডাকছিলেন। একপর্যায়ে তাদের অনুরোধে সাফারি খানিক সংক্ষিপ্ত করা হয়। প্রায় অর্ধশত কিলোমিটার মরুভূমির ভেতর দিয়ে মসৃণ সড়কে গাড়ী চালিয়ে আরেক মরু অঞ্চলে পৌছে যাই আমরা।
সেখানে ডিনার ও কালচারাল শো। অনুষ্ঠানে আরবীয় ঐতিহ্য ইতিহাস ম্যাজিক শো ইত্যাদি তুলে ধরা হলো। মাঝে রাত ১০টায় বুফে ডিনার বিরতি। নানা ধরনের পানীয়ের ব্যবস্থাও লক্ষ্য করলাম। তবে তা পেএ্যবল। বিরতির পর শুরু হল আরবীয় নর্তকীদের বেলী ড্যান্স। একের পর এক ললনারা এসে সহস্র দর্শক-শ্রোতার মনদোলানো নৃত্য গানে মত্ত হচ্ছিল। রাত প্রায় ১টা বাজলে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে।
দুবাইয়ে ১৬৫তলা বুর্জ খলিফা টাওয়ারের নাম কতোই শুনেছি! এবার আমরা সেই টাওয়ারের সামনেই জ্বলজ্যান্ত দাঁড়িয়ে! টাওয়ারের শুরুর দিকে মার্কেট। আছে দুবাই এ্যাকুরিয়ামে শত শত লাল, নীল, হলুদ, সবুজ নানা রংয়ের মাছ। ২০১০ সালে উদ্বোধন হওয়া ২,৭১৭ ফুট উচ্চতার এ ভবনটি বিশ্বের সবচাইতে উঁচু ভবন। ৯০ কিলোমিটার দূর থেকেও একে দেখা যায়।
এ ভবনের ৮০ থেকে ১৫০ তলায় থাকাকালীন মুসলিমগণ ইফতার ও নামাজ দুই মিনিট দেরীতে আদায় করবেন। কারণ, তারা দেরীতে সূর্য্য ডুবতে দেখেন। তার উপরের তলাগুলিতে আরও দুই মিনিট পর ইফতার ও নামাজের সময় হয়। বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত চলাচলকারী লিফট রয়েছে এ ভবনে। ১২০ তলার উপরে উঠলে অক্সিজেন নিয়ে উঠতে হয়। তখন কানে তালা লেগে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
দুবাইয়ে একটি বিষয় বেশ চোখে পড়ে। তা হলো, সরকারি উদ্যোগে অনাবরত সাগর ভরাট করা। নানা স্থানে সাগরের বেশ কিছু অংশ ভরাট করা হচ্ছে, আর তাতেই গড়ে উঠছে শত শত সু-উচ্চ অট্টালিকা - হোটেল, আবাসিক ভবন, দর্শনীয় স্থান, কলকারখানা। জাহাজযোগে দূরবর্তী কোথাও হতে বালু আর কংক্রিট এনে ভরাট করা হচ্ছে সাগর। দুবাইয়ে এমন ভরাটকৃত স্থানে গড়ে উঠেছে শতাধিক হোটেল। আবাসিক এলাকা। নান্দনিক সব ঘরবাড়ি।
প্যাকেজ কোম্পানির বদৌলতে জাহাজ ভ্রমণের মজা আরও ভিন্ন রকম। বিকেল সন্ধ্যা ফুল এয়ারকন্ডিশন্ড শত শত জাহাজ তীর ছেড়ে যাচ্ছে। যাচ্ছে ডেরা দুবাই কিংবা যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে গভীরসমুদ্র পানে। নান্দনিক আলোকসজ্জায় সজ্জিত সেসব জাহাজে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের উপস্থিতি দেখার মতো। আরবীয় পাকিস্থানী ও ইন্ডিয়ান শিল্পীরা জাহাজে সংগীত পরিবশেন করে সমুদ্র অভিযাত্রীদের মনোরঞ্জন করছে।
দেশ-বিদেশ যেখানেই বেড়াতে যাই সেখানকার গ্রাম আমাকে কেবলই হাতছানি দেয়। দুবাইয়ের আশপাশে গ্রাম নেই জেনে আমরা সিদ্ধান্ত নেই, তাদের কৃষিখামার দেখতে যাব। প্রস্তাব এলো শেখ পরিবারের সবজি বাগান দেখতে যাওয়ার। শেখদের গড়ে তোলা বাগানে গিয়ে আমাদের চোখ ছানাবড়া! এত ধরনের সবজি, কিভাবে সম্ভব? আরবীয়রা পেট্রো ডলারের মালিক। তারা তো পারবেই। তাদের সবজি বাগানের ভেতর দিয়ে আইল বাতরের বদলে কংক্রিটের মসৃণ পথ। গ্রীণ হাউজ পদ্ধতিতে লেটুস পাতা, ক্যাপসিক্যাম, অনিয়ন, টমেটো, গাজর, সালাদ পাতা ইত্যাদি উৎপাদন হচ্ছে।
দুবাইয়ে রয়েছে বিদ্যুৎ, পানির সুব্যবস্থা। চওড়া রাস্তাঘাট। পরিচ্ছন্ন শহরটি দেখে আপনারও মনে হতে থাকবে এ যেন ইউরোপের উন্নত একটি দেশ। প্রশস্ত সড়কের পাশে সাইন বোর্ডে সর্বোচ্চ গতিসীমা লেখা রয়েছে। কোনো চালকই এ গতিসীমা অতিক্রম করছেন না। করলেই সড়কে স্থাপিত ক্যামেরা বা রাডার গাড়ীর ছবি তুলে রাখবে। জরিমানা সাথে সাথে মোবাইলে পৌছে যাবে।
পাঠক, আপনিও ঘুরে আসতে পারেন আধুনিক শহর দুবাই। খরচ সর্বসাকুল্যে এক লাখ টাকার মধ্যে সম্ভব। -বিবার্তা/হুমায়ুন/সোহান