নির্মোহ ও আড়ালচারী এক সৃজনশীল মানুষ
প্রকাশের সময় : 2019-12-18 11:10:18 | প্রকাশক : Administration
এম. নজরুল ইসলামঃ যে আদর্শ মানুষকে দেয় মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠার, বেঁচে থাকার অধিকার- সেই প্রগতিশীল রাজনীতির আদর্শে দীক্ষা তার শৈশবে। যে পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন, সেই পরিপার্শ্ব তাকে শিখিয়েছে বিনীত হতে। আদর্শকে উঁচুতে ধরে তুলতে।
নিজেকে জাহির না করে সমাজের জন্য নীরবে-নিভৃতে কাজ করতেই আনন্দ। তার সত্যবাক মানুষটি তাই একইসঙ্গে মিতবাক। দূর থেকে যে মানুষটিকে দেখা যায় আপাতগম্ভীর, সেই মানুষটির ভেতরেই যে সতত বহমান অপত্য মমতা, ভালবাসার এক গভীর সাগর- তা তার নিকটবর্তী অনেকের কাছে এখনও অনাবিষ্কৃত। মানুষ হিসেবে তিনি সৃজনশীল মানুষ গড়েন। প্রাপ্তিযোগের বিষয়ে চিরকাল নির্মোহ। ক্ষেত্রবিশেষে তাকে একান্তই নিজের ভেতরে নিজে নিমজ্জমান মনে হলেও তার ভাবনায় আগামী দিনের মানুষ। যে পেশাটিকে বেছে নিয়েছিলেন ছয় দশক আগে, সেই পেশাতেই আজও নিয়োজিত।
বলছি তোয়াব খানের কথা। আমাদের তোয়াব ভাই। প্রতিদিনই বাংলাদেশের সংবাদপত্রে আধুনিকতার ছাপ রেখেছেন যারা, তোয়াব খান তাদেরই একজন। ১৯৫৫ সালে সাংবাদিকতার হাতেখড়ি কেজি মুস্তাফার সাপ্তাহিক জনতা পত্রিকার মাধ্যমে। ১৯৫৫ সালেই যোগ দেন সংবাদে। ১৯৬১ সালে সংবাদের বার্তা সম্পাদক। ১৯৬৪ সালে যোগ দেন দৈনিক পাকিস্তানে।
নানা ইতিহাসের সাক্ষী তিনি। নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখছেন সময়ের বয়ে চলা, পরিবর্তন। ব্রিটিশ ভারতে জন্মেছিলেন দেখেছেন দেশভাগ। পাকিস্তানি অপশাসন দেখেছেন। দেখেছেন স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম । দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রণী সৈনিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেও ভুল হয়নি তার। কলম-সৈনিক হিসেবে নিজেকে দেশমাতৃকার সেবায় নিয়োজিত করেছিলেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। ‘পিন্ডির প্রলাপ’ লিখেছেন নিয়মিত। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত হতো ‘পিন্ডির প্রলাপ’।
তার চেতনায় একাত্তর, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ। সাংবাদিক হিসেবে তিনি পরিবর্তনগুলো যেমন দেখেছেন, তেমনি সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবেও দেখেছেন খুব কাছ থেকে। ১৯৭৩-৭৫-এ তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেসসচিব হিসেবে কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধুই বেছে নিয়েছিলেন তাকে। ১৯৮৭ থেকে ৯১ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি এরশাদ ও প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের প্রেসসচিব। ১৯৮০-৮৭-তে তিনি ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা। পালন করেছেন বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকের দায়িত্বও। তোয়াব খান খুব কাছে থেকে স্বাধীনতার মহানায়ক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে দেখেছেন। দেখেছেন এরশাদের মতো স্বৈরাচারী রাষ্ট্রপতিকে। হাজারো অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ এই মানুষটি কেবল ইতিহাসের সাক্ষী নন, তিনি নিজেও এক ইতিহাস। সমৃদ্ধ তার জীবনখাতার প্রতিটি বর্ণিল পাতা।
১৯৩৪ সালে তার জন্ম সাতক্ষীরার রসুলপুরে। পড়েছেন সাতক্ষীরার সাধশর্ত বছরের পুরনো পিএন (প্রাণনাথ) স্কুলে। ঢাকায় কলেজে পড়তে আসার বছর না ঘুরতেই ভাষা আন্দোলনে উত্তাল দেশ। ভাষা আন্দোলনেও সক্রিয় অংশগ্রহণ। পরিবর্তনের সঙ্গে এভাবেই একের পর এক সঙ্গী হওয়া। রাজনৈতিক পরিবর্তন যেমন, তেমনি নিজের পেশার জগতে যে পরিবর্তন হয়েছে, তার অনেক কিছুরই সূচনা তার হাত ধরে। বাংলাদেশের সংবাদপত্রে অনেক মাইলফলক রচিত হয়েছে তারই নেতৃত্বে। দেশ ও দেশের মানুষকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দেন তিনি। নতুনদের মধ্যে দেখেন অমিত সম্ভাবনা।
অসাম্প্রদায়িক চেতনার অগ্রদূত, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও ইসলামী পন্ডিত মওলানা মুহাম্মদ আকরাম খাঁ পরিবারের সদস্য তিনি। প্রথিতযশা সাংবাদিক, সাহিত্যিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কাছ থেকে শুনেছি, বঙ্গবন্ধু অসম্ভব ভালবাসতেন ও বিশ্বাস করতেন তোয়াব খানকে। বঙ্গবন্ধু যথার্থই তোয়াব খানকে বুঝেছিলেন। সব ক্ষেত্রে তোয়াব খান এক অনন্য ব্যতিক্রম। নিজ মত ও বিবেক বিসর্জন না দিয়ে নিজের মত ও আদর্শের বিরোধী পক্ষের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রেখে কাজ করতে পারা এবং তাদের কাছ থেকে সম্মান, শ্রদ্ধা অর্জন ও তা ধরে রাখতে পারার মতো কঠিন কাজ তিনি করতে পারেন।
তোয়াব খানের নেতৃত্বে ‘দৈনিক জনকণ্ঠ’ মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে সমাজ ও রাজনীতিসহ সব ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে চলছে। বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতে তার নামটি উচ্চারিত হয় সম্মানের সঙ্গে। দেশে ও বিদেশে আছে তার অসংখ্য গুণগ্রাহী ও ভক্ত। দেশের অনেক প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিকের হাতেখড়ি তোয়াব খানের কাছে। কোমলে-কঠিনে মিলে এক আদর্শ ব্যক্তিত্ব তিনি। তোয়াব খানের কর্মজীবন সুদীর্ঘ ও বর্ণাঢ্য। তা সত্ত্বেও রয়েছে তার বিশেষ অতৃপ্তি। পরিচিতজনদের কাছে আক্ষেপ করে তাই বলেন, ‘মনে হয় আরও কিছু করে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু পারিনি।’ মনে করেন তার সেই অসমাপ্ত কাজ হয়তো করবে আগামী প্রজন্ম। - অস্ট্রিয়া