ব্যাতিক্রম এক বাঁশিওয়ালা
প্রকাশের সময় : 2019-12-18 11:38:05 | প্রকাশক : Administration
সোহেল রানাঃ এক সময়ের বহুল জনপ্রিয় “প্রাণো সখিরে ঐ শোন কদম্ব তলায়, বংশি বাজায় কে” গানটি এখনও বাংলার তথা বাঙালীর মনে নাড়া দেয়। বাঁশি নিয়ে কত গান যে এ পর্যন্ত নানা ভাষায় সৃষ্টি হয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। বাঁশের তৈরি মন কাড়া এ বাদ্য বাঁশির সৃষ্টি সম্ভবত সেই সনাতন কালেই। কেননা কৃষ্ণের হাতের বাঁশুরিই প্রমাণ করে এর উদ্ভব কাল। বাঁশির সুরে এমনই মন্ত্রমুগ্ধতা রয়েছে যা মানুষকে মূহুর্তে বিমোহিত, উদাস, উল্লাস, ও মগ্ন করে দেয়।
বাঁশি মঞ্চে, আসরে সংগঠিত জনতাকে আনন্দ দিতে বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহৃত হলেও, মূলত একে কোন বাদক যখন বন-বাদারে, পাহাড়ের ঢালে, নদীর কিনারে-কদম, বট শিমুল জাতীয় বৃক্ষতলে বসে মন -মাতানো সুর তোলে সেটাই হয়ে উঠে প্রাণবন্ত। পাগলকরা বাঁশুরি সুরে কত রাজ্যকন্যা, জমিদার কন্যা, সওদাগর কন্যা পথে নেমে এসেছেন, আর কত খানদানী, উচ্চ বংশিয় যুবক এবং নানা শ্রেণীর বংশি প্রেমিরা সুরের জাদুতে উদাস হয়ে ঘর ছেড়েছেন। জনব্যস্তময় কোন রেলস্টেশন, লঞ্চঘাট কিংবা, রাজপথেও হঠাৎ বাঁশির সুর বাঁশি প্রেমিকদের চমকে দেয়।
এখানে যে বাঁশি ওয়ালার কথা উল্লেখ করতে যাচ্ছি- তা আরও ব্যতিক্রমময়ী একজন বাঁশিওয়ালা। প্রফেসর ডঃ মোহাম্মদ মাহ্ফুজুল হক (রিপন)। তিনি পেশায় একজন শিক্ষক। ডঃ মাহফুজ ১৯৯৬ সালে (পরীক্ষা অনুষ্ঠিত ১৯৯৯ সালে) বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি), ময়মনসিংহ থেকে বিএসসি ফিসারিজ (অনার্স)-এ প্রথম শ্রেণীতে তৃতীয় স্থান অর্জন করেন। পরবর্তীতে ২০০১ সালে এম.এস-ইন একোয়াকালচারে (মাস্টার্স ডিগ্রি) ডিস্টিংশনসহ প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন করেন।
ঐ বছর মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদে মাস্টার্স ডিগ্রিতে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়-স্বর্ণপদক লাভ করেন। যুক্তরাজ্য সরকারের ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট-এর বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাজ্যের স্টর্লিং ইউনিভার্সিটি থেকে ২০০৮ সালে পি.এইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ড. মুহাম্মদ মাহফুজুল হক ২০০০ সনে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ-এর মৎস্যবিজ্ঞান অনূষদের একোয়াকালচার বিভাগে লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন, পরবর্তীতে ২০০৩ সালে এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে এবং ২০০৮ সালে এসোসিয়েট প্রফেসর হিসেবে পদোন্নতি পান। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালে তিনি প্রফেসর হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে বর্তমানে উক্ত বিভাগে কর্মরত আছেন।
মেধাবী এ মানুষটি যে, এ রকম একজন বংশী প্রেমি বা বাদক তা, নিকট প্রতিবেশী ও আত্বীয়দের একেবারেই অজানা। ছাত্র জীবনে হাইস্কুল জীবনে অষ্টম, নবম শ্রেণিতে থাকাকালে মাঝে মধ্যে তাঁর হাতে বাঁশি দেখা যেত এবং রাত্রিকালে টুক-টাক এলোপাথারী সুর কানে আসত। মেধাবী ছাত্র ফলাফল ভালোর আকাঙ্খায় পড়াশোনায় মনোযোগী হয়ে এস.এস.সি এবং এইচ.এস.সি-তে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহে ভর্তি হন এবং সেখান হতে আকর্ষনীয় একটি ফলাফল অর্জন করলে সৃষ্টিকর্তার কৃপায় ওখানেই প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান।
এসবের মাঝেও তিনি যে নিবির ভাবে বাঁশিটিকে এমন সঙ্গি করে নিয়েছেন যা অনেকটাই অভাবনীয়, অকল্পনীয়। তিনি যদি সেদিন নিজ থেকে তাঁর মোবাইলের ভিডিও ফোটেজ না দেখাতেন তবে, আমি অন্তত বিশ্বাস করতে পারতাম না। এতে তার প্রতি ভিন্ন রকমের শ্রদ্ধা, ভাবনা ও ভালোলাগার দ্বারও উন্মোচিত হলো। ঐ ভিডিও ফুটেজটিতে ছিল- তিনি গ্রীস হতে ডেনমার্ক যাচ্ছিলেন জলপথে ফেরী পারাপার হয়ে। উপরিভাগে গীটার ও মাদলের টুন শুনে তিনি সেখানে পৌঁছান এবং বিদেশীদের সাথে অল্প সময়ের আলাপচারীতায় তাদের সাথে মিশে যান। শিল্প ও সংস্কৃতির মধ্যে জাতী-ধর্মের বালাই থাকে না। বিদেশীদের পর্ব শেষে তিনিও “সাধের লাও, বানাইলে মোরে বৈরাগী” গানটি বাঁশির সুরে সুরায়িত করে ওদের সাথে আনন্দ উৎসব ভাগাভাগী করে নেন। এতে ওনার যেমন আত্মতৃপ্তি বা উপলদ্ধি, তেমনি দেশের জন্যও গৌরবের। এরপর তিনি মনের ভাব ও কিছু কথা প্রকাশ করলেন এভাবে-“আমি দেশের বাহিরে কোথাও বের হলে আমার ব্যাগে বাঁশি থাকবেই”। ইংল্যান্ডে এক ফিসারিজম এর ঘরোয়া অনুষ্ঠানে নিজের বাঁশি বাজানোর কথা বললেন।
আরও একটি মজার গল্প নিজ থেকেই প্রকাশ করলেন ডঃ হক...... “আমি কিন্তু মাঝে মধ্যেই বাসায় বসে বাঁশি বাজাই, আমার উপরের ফ্লাটে যিনি থাকেন তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাটেনারীর একজন অধ্যাপক এবং তিনি নামাজি ও র্ধামিক প্রকৃতির মানুষ। উনার স্ত্রীও নামাজি ও পরহেজগার একজন মহিলা। ‘তো’ আমি আমার স্ত্রী রুমাকে বলি, ঐ ভাই-ভাবীদের এই নিয়ে কোন সমস্যা হচ্ছে কী না, একটু জেনে দেখো। রুমা ঐ দিনই সে ভাবীর কাছে জিজ্ঞেস করলে- ভাবীটি বললেন, তোমার হাজবেন্ডের বাঁশির সুর আমরা চুপটি মেরে শ্রবণ করি। তিনি তো আর আযান ও নামাজের সময় বাঁশিতে ফু দেননা। আমি সফরে দেশের বাহিরে থাকলে ১০-১৫ দিনের গ্যাপে, ঐ ভাবীটি নিচে এসে, রুমা কে জিজ্ঞেস করে, এই রুমা তোমার বাঁশিওয়ালা কোথায়? তার বাঁশির আওয়াজ পাচ্ছিনা বেশ ক’দিন”।
প্রফেসর ডঃ মাহ্ফুজ সাহেবের আরও একটি গর্বের বিষয় লক্ষ্য করলাম, তিনি কবি ও সাহিত্যিকদের ন্যায় কাঁদে ঝোলানো লম্বা একটি ব্যাগ ব্যবহার করেন। ঐ দিন তিনি নিজ এলাকা লংগাইর এসেছিলেন ৭১ এ গণহত্যা ও গণকবর অর্থাৎ বদ্ধভূমি নির্ণয়ে বাংলা একাডেমির উপ-গবেষণা বিভাগের উপ-পরিচালক মহোদয়ের সফর সঙ্গী হয়ে। পাটের সে ব্যাগটি ডঃ হকের কাঁধেই সর্বদা শোভা পাচ্ছিল। এই ব্যাগটিকেই তিনি পৃথিবীর যে কোথাও সফরের সঙ্গী করে রাখেন। আর এ ঝোলনাটিতে দু-একটি বাঁশি সর্বদাই থাকে।
সোনালী আঁশ অর্থাৎ পাটের তৈরী ব্যাগটি একজন ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনকারীর কাঁধে শোভা পায় এবং তিনি এতে করে এ দেশের কৃষি, শিল্প ও সংস্কৃতিকে বিশ্বের নানা অঙ্গনে ভিন্ন রূপে তুলে ধরেছেন। সময় সুযোগ ও পরিবেশ মিললেই, ব্যাগে রাখা বাঁশি বাজিয়ে বাংলার ঐতিহ্যের একটি অংশকে বিদেশীদের মাঝে উপস্থাপন করছেন। সত্যিকারার্থেই ওনার এসব কর্ম কৃতিত্বের, বড়ত্বের ও মহত্ত্বের।
ডঃ হক সেদিন হাসি মুখে, আক্ষেপ ভরা সুরে এলাকা সফরের বিদায় মুহূর্তে বললেন, “আমার সংগ্রহে প্রায় শতাধিক বাঁশি রয়েছে, এর কোন কোনটার মূল্য হাজার/দেড়হাজার/আড়াই হাজার পর্যন্ত, আমার এত এত বাঁশি, এগুলো- আমি মারা যাবার পর কী হবে”? আমি হাঁসতে হাঁসতে উত্তর করেছিলাম- কেন ভাই - আমি একটি সংগ্রহশালা তৈরী করে নেব।
প্রকৃত কথা হলো তাঁর এসমস্ত কর্মগুলোই দেশ ও জাতীর গর্ব। মেধা, মননে, কর্মে স্বচ্ছ ও সুষ্ঠতায় জাতির গৌরব ভবিষ্যত। দুর্নীতিভাবে অঢেল বিত্ত উপার্জন, অপ-সংস্কৃতি, অপ-রাজনীতি, ক্ষমতা আর ভোগ বিলাসিতায় নয়। পরিশেষে ডঃ হক এঁর মেধা, গবেষণা, শিল্প ও সংস্কৃতিবোধময় কর্ম যেন, আপন বলয়কে ছাড়িয়ে বিশ্বাঙ্গনেও বহুল পরিচিতি লাভ করে এবং তাঁর স্ত্রী ও একমাত্র কন্যা তাসফিয়া হক জয়িতাকে নিয়ে সার্বিকভাবে সুখী ও সমৃদ্ধময় জীবন-যাপন করেন, আমরা সকলে সে প্রত্যাশাই রাখি। - লংগাইর, পাগলা, গফরগাঁও, ময়মনসিংহ।