শেখ কামাল।। স্মৃতিচারণ

প্রকাশের সময় : 2020-09-17 17:27:16 | প্রকাশক : Administration
শেখ কামাল।। স্মৃতিচারণ

আবুল ফজলঃ খুব ধারাবাহিকভাবে নয়, মাঝে মাঝে অবসর মতো আমার দিনলিপি লেখার অভ্যাস আছে। ২৩-১০-৭৫ তারিখে দিনলিপি লিখতে গিয়ে হঠাৎ শেখ সাহেবের জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালের কথা মনে পড়ল। পিতার সঙ্গে তাকেও হত্যা করা হয়েছে। তার সঙ্গে আমার মাত্র বার তিনেকের দেখা। স্রেফ দেখাই। তেমন কোন আলাপ-পরিচয় ঘটেনি। একবারই দু’-একটি কথা বিনিময়ের সুযোগ ঘটেছে।

প্রথমবার ওকে দেখেছি অত্যন্ত দূর থেকে। শুধু চোখের দেখা। তখন কিশোর কিংবা কৈশোর উর্ত্তীণের পথে। সন-তারিখ মনে নেই। খুব সম্ভব ১৯৬৬-৬৭ হবে। সুবিখ্যাত সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ‘ছায়ানটের’ বার্ষিক অনুষ্ঠান ঢাকার ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট হলে। আমাকে করতে হয়েছিল সভাপতিত্ব। ভাষণ ইত্যাদি প্রাথমিক পর্ব শেষ হলে শুরু হলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অর্থাৎ গান, বাজনা, নৃত্য ইত্যাদি। মঞ্চ থেকে নেমে এসে আমরা আসন নিয়েছি দর্শকদের চেয়ারে। আমার পাশে বেগম সুফিয়া কামাল। তিনি তখন ‘ছায়ানটের’ সভানেত্রী। সমবেত ঐকতানের প্রস্তুতি নিয়ে শিল্পীরা বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র হাতে মঞ্চে আসন নিয়েছে অর্ধ বৃত্তাকারে। শিল্পীদের সারির মাঝখানে দীর্ঘকায় হ্যাংলাদেহ এক ছেলে সেতার হাতে ঋজু হয়ে আসন নিয়ে সংকেতের প্রতীক্ষায় বসে আছে আসন গেড়ে। সে বয়সেও গোঁফের রেখা অস্পষ্ট। অঙ্গুলি নির্দেশ করে সুফিযা কামাল বল্লেন :

ঐটি মুজিবের ছেলে।

কোন মুজিবের? তখনও এক নামে চিহ্নিত হয়নি শেখ সাহেব। শেখ মুজিবের। ছায়ানটের ছাত্র।

মুজিব তখন জেলে। ভোগ করছেন দীর্ঘ কারাবাস। তারপর সুদীর্ঘকাল গত হয়েছে। এর মধ্যে শুধু পদ্মা-যমুনা মেঘনায় প্রচুর পানি গড়িয়ে যায়নি, দেশের ইতিহাসেও অবিশ্বাস্য রকম রদবদল ঘটে গেছে। সে দিনের কয়েদি আজ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। গুজব ছিল রাষ্ট্রপতির ছেলে নাকি এখন সেতার ছেড়ে বন্দুক-রাইফেলের চর্চা শুরু করেছে। শুনে আমরা দুঃখিত হতাম, হতাম বিস্মিত, সে সঙ্গে লজ্জিতও। অথচ দেখছি সে সেতার বাজাচ্ছে! উপাচার্য হওয়ার পর বিভিন্ন সময় শেখ সাহেবের সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাত ঘটেছে। তাতে আলাপ-আলোচনা প্রসঙ্গে এ সম্বন্ধে আমার উৎকণ্ঠা তাঁকে আমি একাধিকবার জানিয়েছি। অন্যত্র তার উল্লেখও রয়েছে।

১৭ মার্চ শেখ সাহেবের জন্মদিন। স্বাধীনতার পর ছাত্রলীগ প্রতি বছর এ দিনটি পালন করে থাকে। ১৯৭৪-এর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হওয়ার জন্য ঢাকার ছাত্রলীগ আমাকে অনুরোধ জানায়। আমি রাজি হলাম, তবে দিনে দিনে ফিরে আসতে চাই এ শর্তে। তারা সেভাবে বিমানের টিকেট পাঠিয়ে দিয়েছিল।

১৭ তারিখে ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে আমি চিন্তা করতে লাগলাম, ওরা আমাকে নিতে আসবে কিনা, এলেও আমি চিনতে পারব কিনা। ওদের কারও সঙ্গে তো আমার দেখা নেই। এ যাবত আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে ওদের প্রতিষ্ঠানের চট্টগ্রাম শাখার সদস্যদের কেউ কেউ। তাদের কেউ আবার আমার সহযাত্রীও হয়নি।

নিজের ছোট হ্যান্ডব্যাগটি হাতে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় মেয়ের বাসায় কি করে যাওয়া যায় সে কথা ভাবতে ভাবতে নির্গমন দালানের দিকে এগুতে লাগলাম। দূর থেকে ওই দালানে ঢোকার পথের একধারে দেখলাম একটা ছিপছিপে গোঁফওয়ালা ছেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বেশ লম্বা বলে সহজেই চোখে পড়ে। ছেলেটাকে আমি চিনতে পারলাম না।

লাউঞ্জের প্রবেশ পথে ছেলেটি এগিয়ে বলল : আপনাকে নিতে এসেছি। বলেই আমার হাত থেকে ব্যাগটি আমার আপত্তি অগ্রাহ্য করে নিজের হাতে নিয়ে নিলো। নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য জিজ্ঞাসা করলাম : তুমি ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে এসেছ? ‘জি হ্যাঁ’- নম্র কণ্ঠে জবাব দিল ছেলেটি।

ওর পেছনে পেছনে হেঁটে এসে একটা গাড়িতে উঠে বসলাম। ড্রাইভারের সিটে গিয়ে বসল ও নিজে এবং শুরু করল ড্রাইভ করতে। তার আগে ও জেনে নিয়েছে আমি কোথায় উঠব। গাড়িতে তৃতীয় ব্যক্তি নেই। কিছুদূর যাওয়ার পর আমার মনে হঠাৎ কৌতূহল হলো, জিজ্ঞাসা করলাম :

তুমি কি কর?          

বলল, অনার্স পরীক্ষা দিয়েছি সোসিয়োলজিতে।

ঢাকা থেকে?

জি হ্যাঁ।

শেখ সাহেবের সঙ্গে ছেলেটির দৈহিক সাদৃশ্য আমার মনে ধীরে ধীরে স্পষ্টতর হয়ে উঠছিল। জিজ্ঞাসা করলাম: তোমার নাম?

শেখ কামাল।

ও তুমি আমাদের শেখ সাহেবের ছেলে।

জি হ্যাঁ।

বললাম, এত সব মন্ত্রীরা থাকতে আজকের অনুষ্ঠানে আমাকে কেন তোমরা নিয়ে এলে প্রধান অতিথি হতে? তেমনি আবেগহীন কণ্ঠে ও বললে, আপনার এক কথা ওঁদের হাজার কথার সমান।

মনে মনে সঙ্কোচ বোধ না করে পারলাম না। এবারও আমার আপত্তি অগ্রাহ্য করে ও ব্যাগটি নিয়ে তেতলা পর্যন্ত উঠে এলো। যাওয়ার সময় বলে গেল : আমি আড়াইটার সময় আসব আপনাকে নিয়ে যেতে। আমাদের সভা তিনটায় আরম্ভ হবে।

ঠিক তিনটার কিছু আগে এসে ও আমাকে ওর গাড়ি করে সভায় নিয়ে গিয়েছিল। সভায় ঢুকতেই কে এক ছেলে এসে আমার হাতে একটি ফুলের মালা দিয়ে বললে: এটি শেখ সাহেব পাঠিয়ে দিয়েছেন আপনার জন্য। তাঁর শরীর খারাপ না হলে তিনি আপনার সঙ্গে দেখা করতেন। ওই সভাতে আমার প্রথমবারের মতো খোন্দকার মোশতাক আহমদের সঙ্গে দেখা। তিনি ওই সভার অন্যতম বক্তা। আর এক বক্তা ছিলেন মোল্লা জালাল উদ্দিন। প্রতিমন্ত্রী ক্ষিতিশ মণ্ডলও ছিলেন মনে পড়ে। ওই সভায় শেখ কামাল কোন ভূমিকা নেয়নি। সামনের দিকে কোন সারিতেও ওকে দেখা গেল না। পেছনের দিকে কোথাও হয়ত এককোণে বসেছিল। মনে হলো নেপথ্যেই ওর ভূমিকা।

সভাশেষে আবারও মেয়ের বাসায় নিয়ে গেল ও। বিমানের ছাড়তে দেরি নেই। তাই ওখানে আর বসা হলো না। আমার হাতব্যাগটি এবারও নিজের হাতে তুলে নিয়ে নিচে নেমে এসে গাড়ির দরজা খুলে আমাকে বসিয়ে ও ড্রাইভারের সিটে বসে স্টার্ট দিয়ে দিল। দেখলাম ও সবসময় একা।

এয়ারপোর্ট পৌঁছে বোর্ডিং কার্ড করার জন্য নিজেই ব্যাগ হাতে নিয়ে কিউর পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। রাষ্ট্রপ্রধানের ছেলে বলে কোন রকম অধিকার খাটাতে চাইল না। দেখে আমার খুব ভাল লাগল। যখন ওর পালা এলো তখনই শুধু টিকেটটি বাড়িয়ে দিল। বোর্ডিং কার্ড-টার্ড হয়ে যাওয়ার পর বিমান ছাড়া পর্যন্ত ও থেকে যেতে চাইছিল। আমি অনেক বলে-কয়ে ওকে লাউঞ্জ থেকে বিদায় দিলাম। একই দিন ওর গাড়িতে ও আমাকে চারবার লিফ্ট দিয়েছে, কিন্তু নিজে চারবারও বোধকরি কথা বলেনি। তাতে মনে হলো ও অত্যন্ত স্বল্পবাক।

শুনেছি, অত্যন্ত ক্রীড়াপ্রিয় ছিল। রাষ্ট্রপতির ছেলে হয়েও কোন ধনীর মেয়েকে বিয়ে করেনি, বিয়ে করেছিল দেশের সেরা ক্রীড়াবিদ মেয়েটিকে। বাংলাদেশের সেরা ক্রীড়া সংস্থা ‘আবাহনী’ ওরই নিজের সংগঠন, ওরই সৃষ্টি।

সেদিন দেখেছিলাম অবিকল বাবার মতো করেই গোঁফ রেখেছে ও। সেদিনের ঋজু দেহ দীর্ঘ লিকলিকে চেহারার সুদর্শন তরুণটির নম্র মধুর ছবি আমার মনে আজও গাঁথা হয়ে আছে। আজ ও নেই। বাংলাদেশের সেরা মেয়ে ক্রীড়াবিদ ওর নববধূটিও হারিয়ে গেছে। (লেখকের অপ্রকাশিত দিনলিপি থেকে; লেখক : প্রয়াত বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদ, ভিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)

 

সম্পাদক ও প্রকাশক: সরদার মোঃ শাহীন
উপদেষ্টা সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম সুজন
বার্তা সম্পাদক: ফোয়ারা ইয়াছমিন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: আবু মুসা
সহ: সম্পাদক: মোঃ শামছুজ্জামান

প্রকাশক কর্তৃক সিমেক ফাউন্ডেশন এর পক্ষে
বিএস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড,
ওয়ারী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০ হতে প্রকাশিত।

বানিজ্যিক অফিস: ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
বার্তা বিভাগ: বাড়ি # ৩৩, রোড # ১৫, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
ফোন: ০১৮৯৬০৫৭৯৯৯
Email: simecnews@gmail.com