করোনা দিনের ডায়েরি...
প্রকাশের সময় : 2020-10-01 11:43:32 | প্রকাশক : Administration
৩য় পর্ব
রাত শেষ হতে বেশী বাকী নেই আর। সুবেহ্ সাদিকের সময় হলো বলে। মোবাইলে ফজরের আযানও হবে হবে করছে। বাইরের সবকিছু সাদা হয়ে আছে। রাস্তাঘাট, বাড়ীর ছাদ সব সাদা। সাদাশুভ্র তুষারপাতে সব একাকার। বেশ ক’দিন পরে আজ তুষার পড়লো। তাপমাত্রাও তেমন নেই। মাইনাস ৪ কি ৫ হবে। টরেন্টো শহরের তাপমাত্রা আস্তে আস্তে বাড়ছে। দিনের বেলায় প্রায়দিনই প্লাস থাকে। মাঝে মাঝে বসন্তের আমেজও পাওয়া যায়।
এমনি আমেজেও কেউ ভাল নেই কানাডায়। কেবল কানাডা নয়; সারা পৃথিবীর কেউই মোটেও ভাল নেই। অদৃশ্য করোনার ভয়তে সবাই কাবু হয়ে গেছে। সারা পৃথিবীকেই লন্ডভন্ড করে দিয়েছে এই করোনা। চারদিকেই আতঙ্ক; কেবলই আতঙ্ক। মৃত্যুর মহা আতঙ্ক আর বিশাল লাশের মিছিল। তাই লড়ছে সবাই। প্রাণপণ লড়াই করে যাচ্ছে অবিরত। দৃশ্যমান মানুষেরা সর্বশক্তি দিয়ে লড়ছে অদৃশ্যমান ভয়াবহ শক্তির বিরুদ্ধে। এ যে যুদ্ধ; কঠিন যুদ্ধ। ২য় বিশ্বযুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ যুদ্ধ।
ভয়াবহ শব্দটি বর্তমানে বহুল প্রচারিত একটি শব্দ। বাংলাদেশের আকাশেও ভাসছে ভয়াবহ নানান কথা। যে যেভাবে পারছে ভাসিয়ে বেড়াচ্ছে। যেন আতঙ্ক ছড়াবার একটা নগ্ন প্রতিযোগীতা। চারদিকে দুঃসংবাদ বলার এবং শোনার হিড়িক পড়েছে। ভাল সংবাদ কেউ শুনতে চায় না। শুনে স্বস্থিও পায় না। সবাই খারাপ সংবাদের অপেক্ষায়। সারাদেশে সূত্রবিহীন অনুমান নির্ভর খবরের ছড়াছড়ি। এ এক বিরাট সমস্যা। এবং সমস্যাটা দিনদিন প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে।
সমস্যার সমাধানে রাস্তায় নেমেছে আর্মি। এমনি এমনি নামেনি এবং নামায়নি। নামাতে বাধ্য হয়েছে সরকার। আর্মি নেমেছে রাস্তার মানুষকে ঘরে ঢোকাতে। আর মানুষ নেমেছে আর্মি নেমেছে কি না সেটা দেখতে। দলেদলে মানুষ রাস্তায় ভীড় করছে। কারো মাথায় করোনার ভয় নেই। থাকবে কি? করোনা তো চোখে দেখা যায় না। আর্মি দেখা যায়। ভাগ্য ভাল। খালি চোখে করোনা দেখা যায় না। দেখতে পেলে করোনা দেখার জন্যে শতশত বাঙালী রাস্তায় নামতো না। ঘর থেকে লড়াই করতো করোনার বিরুদ্ধে। লড়াই যে কেউই করছে না সেটাও নয়। অনেকেই লড়াই করছে। দেশে করছে, বিদেশেও করছে। এবং শুধু যে লড়েই যাচ্ছে, তাই নয়। কোথাও কোথাও জয়ীও হচ্ছে। জয়ী হয়ে আনন্দ করছে। করোনাকে ঝেটিয়ে বিদায় করে সেদিন চীন মহানন্দে আতশবাজি করেছে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া কিংবা সিংগাপুরও দেখিয়ে দিয়েছে অল্প সময়ে সবকিছু মোকাবেলা করে কিভাবে টিকে থাকতে হয়। কিভাবে করোনাকে নিয়ন্ত্রণ করে বিদায় করতে হয়। এসবও কিন্তু মিথ্যে নয়।
দেশের মানুষের একটা অংশ এসব দেখেও না দেখার ভান করছে। আর চেষ্টা করছে কিভাবে দেশের বারোটা বাজানো যায়। অবিরাম চেষ্টা শুরু করেছে। চেষ্টা করছে সকল মানুষের মনের মধ্যে একটা বিশ্বাস ঢুকিয়ে দেয়ার। যে কোনভাবেই প্রমাণ করতে হবে বাংলাদেশ শেষ। এটা প্রমাণ করতে খুব সুক্ষ্মভাবে একটা ছবি একে দিচ্ছে মানুষের মনে। আতঙ্ক আর ভয়ের ছবি। ভয়ানক রকমের ভয়। ঢাকার রাস্তায় লাশের সারি। লাশ আর লাশ। শহরে লাশ, গ্রামে লাশ।
আর পাশে রেখেছে বাঁশ। বাঁশ রেখেছে সরকারের জন্যে। যেনতেন বাঁশ নয়; আইক্কাওয়ালা বাঁশ। ইনিয়ে বিনিয়ে এই বাঁশ এমনভাবে সরকারকে দিতে চায় যেন ঘুরে দাঁড়াবার সব শক্তি সরকার হারিয়ে ফেলে। দেশের রাজনীতির ইতিহাসে প্রতিপক্ষকে লাশ আর বাঁশ দেবার ইতিহাস নতুন নয়। খুবই পরিকল্পিতভাবে বাঁশ আর লাশ চাপিয়ে দেয়া হয় সেই আদিকাল থেকেই। বলার চেষ্টা করা হয়, যত দোষ ঐ বেটা নন্দঘোষ।
সরকারকে নন্দঘোষ বানাবেই। করোনা নিয়েও নন্দঘোষ বানাবার জন্যে রীতিমত হাউকাউ শুরু করে দিয়েছে। যে যেখান থেকে পারছে হাউকাউ করেই যাচ্ছে। কেউ করছে টিভিতে, কেউ খবরের কাগজে, আর কেউ বা ফেসবুকে। সব জায়গায় কেবল কথা আর কথা। ভাল কথা, মন্দ কথা; আকথা, কুকথা। কেবল কথা আর কথা। সাথে প্রতিবাদও আছে, মিছিলও আছে। তবে একটাও ভাল কাজে নয়।
কাজের কাজে নয়। সবই মানুষের অকল্যাণ আর অকাজে।
তেমনি একটা লজ্জাস্কর অকাজ হয়ে গেল আকিজ গ্রুপকে নিয়ে। আকিজের মতো একটি বড় কোম্পানি নিজেদের উদ্যোগে তেজগাঁয়ে একটি অস্থায়ী করোনা হাসপাতাল বানাতে চাইলো। ওদের সহ্য হলো না। মানুষকে ভুল বুঝিয়ে সেখানে মানব প্রতিরোধ গড়ে তুললো এবং উদ্যোগটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বন্ধ করে দিল। আমাদের দেশের মানুষ নিজেরাই জানে না তারা আসলে কী চায়। জাতিগতভাবে আমরা প্রচন্ড নেগেটিভ মানসিকতার জাতি। যে কোন নেগেটিভ ইস্যু আমাদের অনুপ্রাণিত করে খুব দ্রুত। অথচ পজেটিভ কাজে আমরা অনুপ্রাণিত হই না।
হই দ্বিধান্বিত। আর থাকি চোখ বুঝে। চোখ বুঝে ঝিমাই। খুব কষ্ট লাগে এসব দেখতে। কষ্ট-বেদনা কিংবা হাসি-আনন্দের এমনি সব কথা দেখে এবং শুনে দুচোখের পাতা এক করতে পারি না। রাতভর জেগে থাকি। বিছানায় যাই না। শোনিম রাতভর একা বিছানায় ঘুমিয়ে থাকে। একা ঘুমুতে চায় না। ইচ্ছের বিরুদ্ধে বাধ্য হয়। ঘুমুবার আগে আমাদের ডাকে। বারবার ডাকে। এখনো ছোট্ট বাচ্চাটির মত করে।
ঘুমুনোর আগে নানান বায়না তার। বাবা কিংবা মা; একজনকে পাশে লাগবেই। দুজনের কাজ দু’রকমের। একজন হাত টিপে দেবে; পা টিপে দেবে। তাড়াহুড়া করা যাবে না। আস্তে আস্তে দিতে হবে। থামা যাবে না। অন্যজন পাশে শুয়ে পিঠ চুলকিয়ে দেবে। যেমন তেমন চুলকানো হলে হবে না। সারা শরীরে আঙ্গুল বুলিয়ে দিতে হবে। এটা হলো কাজের অর্ধেক। বাকী অর্ধেক মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়া। বড়বড় চুলের মাঝে আঙ্গুল মিলিয়ে হাত বুলানো। অবুঝ ছেলে আমার! করোনা বোঝে না। বোঝে না করোনার ভয়াবহতা। বুঝতে পারে না পুরো পৃথিবী জুড়ে কী মহাবিপদই না ভর করেছে।
খুব মায়া হয় ওর জন্যে! মায়া হয় সিমেক পরিবারের সবার জন্যেও! জানি না দূরদেশে এই পরিবারের সদস্যরা আজ কে কেমন আছে! কেমন আছে প্রত্যেকের পরিজন; আপনজন! কেমন করে পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে সবাই! খুব কঠিন সময়! কঠিন এই সময়ে কাজ একটাই; ঘরে থাকা আর সচেতন থাকা। সতর্কতার সাথে প্রত্যেকেই যার যার বাসায় অবস্থান করা।
ভাল লাগে না কিছু ওদের চিন্তায়। সারাক্ষণই চিন্তায় থাকি। কিছু করতে পারি না; শুধু বিড়বিড় করি। আনমনে বিড়বিড় করে ওদেরকে সারাক্ষণই বলি, “সবাই শুধু বেঁচে থাকার চেষ্টা করো। বেঁচে থাকলে বাকী জীবন সব করা যাবে। ভুলেও ঘরের বাহির হবে না। ভয় পেয়ো না! সামান্যতম ভয় পেয়ো না। একটুও ভেবো না! অবস্থার পরিবর্তন হবেই হবে! আল্লাহ্ নিশ্চয়ই আছেন আমাদের সবার সাথে!”
তোমাদের জন্যে অনেক দোয়া করছি। আমাদের জন্যেও দোয়া করো। আমরাও খুব একটা ভাল নেই। মৃত্যু উপত্যাকায় বসে ভাল কি থাকা যায়! যায় না! শোনিমকে নিয়ে আমাদের প্রতিটা নির্ঘুম রাত যায় তোমাদের নিয়ে। করোনার রাত। পুরো রাত সোফায় বসেই কাটিয়ে দেই। বিমর্ষ থাকি। থাকি ফজরের অপেক্ষায়। করোনামুক্ত একটি সুন্দর সকালের প্রত্যাশায়। যে সকালের আলোয় আলোকিত হয়ে হাসবে পুরো পৃথিবী! হাসবে তোমরা!! হাসবে আমার শোনিম!!!" চলবে...