করোনা দিনের ডায়েরি...

প্রকাশের সময় : 2020-10-14 15:58:35 | প্রকাশক : Administration
করোনা দিনের ডায়েরি...

৪র্থ পর্ব

করোনায় এমনিতেই বিগড়ে আছে মন। ঘুম তেমন হয় না বললেই চলে। প্রতিদিন ভোর হয়, অতৃপ্তির ভোর। আজও এমন হলো। আজ ভোরে ঢাকার খবর পড়ে মনটা আরো বিগড়ে গেল। নিশ্চিত হবার জন্যে খবরের ভিডিও ক্লিপটা দেখলাম। কঠিন এই সময়ে যেখানে মানবতার সেবায় ডাক্তারদের নিজ জানমালের তোয়াক্কা না করে রুগীর সেবা করা উচিত, সেখানে তাদের এক নেতা কিসিমের লোক কঠিন এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা করে দিলেন। বক্তৃতা কি? রীতিমত সরকারকে হুমকি দিয়ে দিলেন।

করোনা রুগী না দেখার হুমকি। সুরক্ষা সরঞ্জাম না দিলে রুগী দেখবেন না তাঁরা; বাংলাদেশে ডাক্তারদের সুরক্ষায় আসলে কিছুই নেই। এটা কি তিনি এখন দেখলেন? ডাক্তারী পড়ার সময় দেখেন নাই? ভাঙ্গা ভবনের ভাঙ্গা বেড তার চোখে পড়ে নাই কোনদিন? ৬টি বছর মেডিক্যাল কলেজে কাটিয়ে বাংলাদেশের মত গরীব রাষ্ট্রের বাস্তব অবস্থা না দেখেই সার্টিফিকেট নিলেন? আর এখন সুরক্ষা সরঞ্জাম চাচ্ছেন? তাও আবার সরকারের কাছে? তিনি যে আমলে ডাক্তারী পড়েছেন, তখন সাধারণ জনগণকে না খাইয়ে তাদেরকে পানির দরে পড়িয়ে ডাক্তার বানাতে পারাটাই তো সরকারের বড় কৃতিত্ব।

সেই সরকারের দুর্দিনে এখন জ্ঞান দিতে এসেছেন? আর এখন জিজ্ঞাসা করছেন সুরক্ষা সরঞ্জাম নেই কেন? ছাত্রাবস্থায় এ্যাপ্রোণ গায়ে যখন হাসপাতালে রাউন্ডে যেতেন, তখন এ্যাপ্রোণ ছাড়া শিক্ষকদের দেখে জিজ্ঞেস করতেন! জিজ্ঞেস করতেন, কেন পাশ করা ডাক্তার হাতমুজা না পড়ে রোগীকে ফিজিক্যাল একজামিন করেন? রুগী দেখার সময় এ্যাপ্রোণ কি এখনও আপনারা পড়েন? এ্যাপ্রোণ তো আপনারা পড়েন কেবল ছাত্রাবস্থায়। কেবল হাসপাতালেই নয়। রাস্তাঘাটে, হোটেল রেস্তোরায় এ্যাপ্রোণ পড়ে ঘুরে বেড়ান। আর যেদিন পাশ করেন সেদিনই এ্যাপ্রোণ পড়া ছেড়ে দেন।

আর আজ মহামারীর দিনে স্ট্যাথিসকোপের স্টেরেলাইজেশন চান? মানে স্ট্যাথিসকোপ জীবানুমুক্ত করে দিতে হবে সরকারকে। তাইতো? না হয় ওটা সরকার করে দেবে। কিন্তু সরকার কি আপনার মোবাইল ফোনও জীবানুমুক্ত করে দেবে? অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার সময় আপনারা কি মোবাইলখানা বাইরে রেখে যান? নাকি সরকার কঠোর হলে বাইরে রেখে যাবেন?

আপনি ডাক্তার হতে চেয়েছেন, তার জন্য হাজার ছেলেমেয়ের সঙ্গে প্রতিযোগীতা করে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছেন। পেশাটা ভালো লেগেছে বলেই না প্রতিযোগীতা করেছেন। কেন ভালো লেগেছে সেটা আপনিই জানেন। সাধারণভাবে আমরা দেখি, এই পেশায় টাকা পয়সা ভালো পাওয়া যায়, সম্মান ভালো পাওয়া যায়; এসব কারণেই ছেলেমেয়েরা এই পেশায় যেতে চায়। অনেকে মানব সেবার মহান আদর্শের কথাও বলেন। টাকা, সম্মান এবং মহান আদর্শ যাই-ই বলি না কেন, এসবের সঙ্গে একটা দায়িত্বও থাকে। এগুলো এমনি এমনিই পাওয়া যায় না। এতোদিন অর্থ, সম্মান ইত্যাদি সব ভোগ করেছেন; আর যখনই জাতীয় জরুরি পরিস্থিতি হয়েছে, তখনই দায়িত্ব ছেড়ে পালাবেন?

দেশের বড় দুঃসময়ে পাল্টাপাল্টি এমন কথাবার্তার কি আদৌ দরকার ছিল! কি দরকার ছিল পুরো দেশবাসীকে ক্ষেপিয়ে দেয়ার! একটা গরীব দেশের গরীব মানুষেরা এখনো রোগ থেকে মুক্তি পেয়ে বাঁচে আপনাদের উছিলায়। সেই আপনারা মিডিয়া ডেকে যা মনে চায়, তাই বলে দিতে পারলেন! আপনাদের পরিচয়ই বা কি? আপনারা কি বাংলাদেশের মূলধারার ডাক্তারদের প্রতিনিধিত্ব করছেন?

মনে তো হয় না। বরং আমরা দেখছি করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ চলছে, তার সম্মুখভাগে থেকে সরকারী বেশিরভাগ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে চলেছেন। সরকারী চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী করোনা সেবায় অবদান রেখেছেন। সরকারী হাসপাতালগুলোতে যারা কাজ করেন, তাঁরা এগিয়ে এসেছেন এবং তাঁরা কোন গাফিলতি করেননি, নিজেদের ঝুঁকি জেনেও তাঁরা কাজ করে চলেছেন।

তাহলে আপনারা কারা? কেন আপনাদের কথায় দেশবাসী সব ডাক্তারদের দোষারূপ করছে। অধিকাংশরাই তো যুদ্ধে নেমে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছেন, ‘সবাই ভয় পাবে’, এটা মানি আমি। কিন্তু একজন ডাক্তার, তাঁর একটা দায়িত্ব থাকে। রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেয়া চিকিৎসকদের দায়িত্ব। সেই চিকিৎসকরা মানবতাবোধ হারাবে কেন? তিনি ঠিকই বলেছেন। ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়েও বিমানের ক্যাপ্টেন নিজের জীবনের চিন্তা করেন না। টাইটানিক এর ক্যাপ্টেনও করেননি। করলেন আপনারা! বাংলাদেশের সম্মানিত ডাক্তারদের একটা ছোট্ট অংশ।

কথায় কথায় বিদেশের উদাহরণ টানেন। তাহলে পুরোটাই টানেন! ব্রিটেনের অনেক ডাক্তার ময়লা ফেলার পলিথিন ব্যবহার করে চিকিৎসা দিচ্ছে। হাজার-হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে, কিন্তু ডাক্তাররা বুক চেতিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে। মানব সেবা কাকে বলে সেটা তারা দেখিয়ে দিচ্ছে। এ জন্যই তারা উন্নত। ইতালিতে ৮৭ জন ডাক্তার করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। কই? একটি হাসপাতালও তো একজন রোগীকেও ফিরিয়ে দেয়নি। একজন ডাক্তারও তো চিকিৎসা দিতে অসম্মতি জানাননি। তাঁদের কি নিজের ও পরিবারের প্রতি মায়া নেই? আমাদের চেয়ে বেশি ছাড়া একবিন্দুও কম নেই।

ভাবা যায়, ৮৭ জন ডাক্তার করোনা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছে তবুও কোনো ডাক্তার চিকিৎসা দেওয়া থেকে বিরত থাকেনি? আর আপনারা? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের করোনা হয়েছে কেবল এই ধারণার কারণে একের পর এক হাসপাতাল তার চিকিৎসা দিতে অসম্মতি জানিয়েছে। এর চেয়ে অমানবিক কি আর কিছু হতে পারে?

আপনাদের অনেক কষ্ট আছে। এটা বিনা বাক্য ব্যয়ে সবাই মানবে। আপনারা অবহেলিত। শুধু ডাক্তার কেন, ইঞ্জিনিয়ারও অবহেলিত। ডাক্তার আর ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়ন্ত্রণ করে এবং চালায় অ্যাডমিন ক্যাডার; যাদের এক সময় ডাক্তারি কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার যোগ্যতাই ছিলো না। হওয়ার কথা ছিলো উল্টো। অ্যাডমিন ক্যাডারদের হওয়ার কথা ছিলো ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের সার্ভিস প্রোভাইডার। কিন্তু হলো উল্টো।

উল্টো অসম্মানিত করা হলো। বেছে বেছে সবচেয়ে মেধাবীদের জায়গা করে দেয়া হলো অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীদের অধীনে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের কোন কর্মকান্ডে নেতৃত্ব দেবার মত কোন সুযোগ তাদেরকে কোনকালেই দেয়া হয় না। নেতৃত্ব দেবে কি? কথা বলারই তো কোন সুযোগ নেই। একটা জাতির উন্নয়নে জাতির সবচেয়ে মেধাবীদের কাজে লাগানো হয় না। এর চেয়ে লজ্জার কাজ আর কী হতে পারে!

তবে এখন লজ্জার গল্প করার সময় নয়। এখন যুদ্ধের সময়। করোনা যুদ্ধ। ২য় বিশ্বযুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ। যে যুদ্ধে সম্মুখ সমরে দাঁড়িয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছেন এই বাংলাদেশের ডাক্তার, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা। পরিবার তথা নিজের জীবনকে তুচ্ছ করেই তাঁরা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। মৃত্যুকে ভয় করছেন না। না নিজের মৃত্যু, না নিজের পরিবারের বাকীদের।

তাঁরা জাতীয় সম্মান প্রাপ্য। তাঁরা জাতীয় বীর। তাঁদেরকে বীরযোদ্ধার সম্মান দেয়া দরকার। মুক্তিযোদ্ধাদের মত সম্মান। যেন বংশ পরম্পরায় তাঁরা মর্যাদা, সম্মান এবং সম্মানী সমভাবে ভোগ করতে পারেন। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই কোনভাবেই; মুক্তিযুদ্ধের পর করোনাযুদ্ধই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। একটা স্বাধীনতার আর একটা মানুষকে বাঁচাবার। এ যুদ্ধে সম্মুখ সমরে থেকে যারা যুদ্ধ করছে, তারা করোনা যোদ্ধা। বীর করোনাযোদ্ধা!! চলবে...

 

সম্পাদক ও প্রকাশক: সরদার মোঃ শাহীন
উপদেষ্টা সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম সুজন
বার্তা সম্পাদক: ফোয়ারা ইয়াছমিন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: আবু মুসা
সহ: সম্পাদক: মোঃ শামছুজ্জামান

প্রকাশক কর্তৃক সিমেক ফাউন্ডেশন এর পক্ষে
বিএস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড,
ওয়ারী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০ হতে প্রকাশিত।

বানিজ্যিক অফিস: ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
বার্তা বিভাগ: বাড়ি # ৩৩, রোড # ১৫, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
ফোন: ০১৮৯৬০৫৭৯৯৯
Email: simecnews@gmail.com