দোষ সব শিশু কিংবা মেয়েদের!!!
প্রকাশের সময় : 2020-11-26 12:06:17 | প্রকাশক : Administration
ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীনঃ
আমাদের সময় ক্লাশ ফোর এ মোটে চারটি বিষয় ছিল। বাংলা, ইংরেজী, অংক এবং পৌরনীতি। পৌরনীতি কথাটার মানে বুঝতাম না। কিন্তু ভেতরকার বিষয়গুলো ভালই বুঝতাম। বুঝতাম বাংলা বইয়ের মজার মজার পদ্য কিংবা গদ্যসমূহ। বাংলা বইয়ের একটা চ্যাপ্টার ছিল “বেগম রোকেয়া” নামে। বাংলা পড়াতেন কোব্বাত স্যার। ছোটখাট গড়নের মানুষ। লুঙ্গি আর পাঞ্জাবী গায়ে পন্ডিততুল্য এই মানুষটি ক্লাশে ঢুকে আমাকে ছোটখাটো একখানা খোঁচা না মেরে চেয়ারে বসতেন না। এটা স্যারের নিত্যদিনকার কাজ ছিল। কোন না কোন কথা বলে খোঁচা একটা মারবেনই। একদিন কটকটা গরমে টিনের ঘরের ক্লাশরুমে ঢুকে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা এই আমাকে খোঁচাটা মেরেই বললেন, বল্! অমর কাকে বলে!!
তাজ্জব কথা। এটা একটা প্রশ্ন হলো। খুবই সহজ উত্তর। কোনরূপ না ভেবেই পটাপট বলে দিলাম, অমর আমার কাকা। আব্বার অফিস কলিগ, আমাদের অমর কাকা। স্যার হাসতে হাসতে শেষ। মুখভর্তি চমৎকার পাকা দাঁড়ির বাঁকে কোব্বাত স্যারের হাসিও ছিল চমৎকার। একটা পবিত্রতার আদল। স্যার হাসি থামালেন, কিন্তু চেয়ারে বসলেন না। ডানেবায়ে ছেলেমেয়ে সবার দিকে তাকিয়ে একটু গম্ভীর হয়েই বললেন, আর কেউ কি আছে যে জানে অমর কাকে বলে?
ঝটাপট উঠে দাঁড়ালো রোকেয়া। আর পটাপট বলে দিল, যে মরিয়াও মরে না, সে অমর। এবার সারা ক্লাশে হাসির রোল পড়লো। বেশি হাসছি আমি। হিহি করে হাসছি। বলে কি রোকেয়া! কেউ মরিয়াও আবার মরে না কেমনে! কিন্তু কোব্বাত স্যার হাসলেন না। আমার দিকে তাকিয়ে মুখটা ভেংচী দিয়ে বললেন, চুপ কর্। দাঁত বাইর কইরা আর চিগাইস্ না। ভাল কইরা শিখ্! রোকেয়া কী বললো, ভাল কইরা শোন্!!
রোকেয়াকে নিয়ে আর পারি না। প্রায় প্রতিদিনই একটা না একটা ঘটনা ঘটাবেই। আমরা কেউই যা পারি না, রোকেয়া তা পেরে দেখাবে। বেগম রোকেয়া ওরফে রুবী। আমার জটিল প্রতিদ্বন্দী। এই মেয়েটার জ্বালায় আমি শেষ। ক্লাশের সব পড়া আগে আগে শিখে আসে। কেমনে শিখে, কিভাবে শিখে আমার মাথায় ধরে না। আজকেও ধরতেছে না। একজন মানুষ মরে গিয়েও মরছে না। এটা আবার কেমনে!
“কেমনে” বিষয়টা কোব্বাত স্যার বুঝিয়ে দিলেন। বুঝিয়ে দিলেন, পায়রাবন্দ গ্রামের বেগম রোকেয়া নারী জাগরণে ভূমিকা রেখে কিভাবে আজো অমর হয় আছেন। কিভাবে তিনি মেয়েদেরকে পড়াশুনার ব্যাপারে আগ্রহী করেছেন। তাদের অধিকারবোধ শিখিয়েছেন। কিভাবে মেয়েদেরকে বাঁধা পেরুতে শিখিয়েছেন। তবে স্যার নিজে তখনো বোঝেননি, তারই প্রিয় ছাত্রী রোকেয়াও বাধাগ্রস্ত হবে। ক্লাশ ফাইভে বৃত্তি পাওয়া মেয়েটা এইটের গন্ডি পেরুনোর আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসবে, এটা স্যার বোঝেননি।
রোকেয়া নিজেকে বুঝেছিল। নিজের ট্যালেন্ট চিনেছিল। তাই বাল্যবিবাহ রোকেয়াকে থামাতে পারেনি। তিনটি মেয়ের মা হয়েছে বটে। স্বামী সংসার করেছে। কিন্তু পড়াশুনাটাও চালিয়ে গেছে বেগম রোকেয়ার মত করেই নিভুনিভু আলোতে যেন বাচ্চাদের ঘুম ভেঙে না যায়। ভার্সিটিতে গিয়েছে মেয়েদের সাথে। পড়েছেও বড় মেয়েটার সাথে একই ক্লাশে। মা-মেয়ে একসাথে মাস্টার্স করে বেরিয়েছে। এখন দিব্বি শিক্ষকতা করে বেড়াচ্ছে। মেয়েদের শিক্ষা এবং নারী জাগরণে রাখছে বলিষ্ঠ ভূমিকা।
আমার ছেলেবেলায় সহপাঠী রোকেয়ার মত মেয়েদের সংখ্যা একেবারেই কম ছিল। তবে বর্তমানে চিত্র পাল্টেছে। পরিস্থিতি বদলে গেছে। বর্তমান জমানায় নারীশিক্ষায় ভূমিকা রাখা নারী আছেন অজস্র। তাদের জন্যেই নারীশিক্ষা আজ এতদূর এগিয়েছে। পাশাপাশি প্রতিবাদী নারীও কম নেই। চুন থেকে নুন খসলেই তারা ক্যাচাং করে ওঠেন। অবশ্য নারীদের পক্ষেই ওঠেন এবং প্রতিবাদ করেন। প্রতিবাদের জোয়ার বসান।
পাশাপাশি নারীবাদী নারীর সংখ্যাও কম নয়। নারী অধিকার নিয়ে তাদের দৌঁড়ঝাপ আর ব্যস্ততার অন্ত নেই। কিন্তু বেগম রোকেয়ার মত নেই একজনও। থাকলে সদ্য গত হওয়া ধর্ষণ মৌসুমে সারা বাংলা নারীদের মিছিলে প্রকম্পিত হতো। হয়েছি কি? তেমন করে হয়নি এবং হবেও না। মিছিল হয়েছে, মানব বন্ধন হয়েছে। রাজপথ প্রকম্পিতও হয়েছে। তবে নারী নেতৃত্বে নয়। রাস্তাঘাটের একাংশের দখলে ছিল মুখোশধারী নারীবান্ধব শতশত পুরুষের পদভারে। তারা মুখে নারীদের পক্ষে সোচ্চার হলেও প্রকৃত অর্থে তারা কতটা নারীবান্ধব সেটা কোটি টাকার প্রশ্ন। তাদের স্বচ্ছ চোখের আড়ালে কতটা অস্বচ্ছতা লুকিয়ে আছে কিংবা তাদের সহমর্মিতায় কতটা সততা আর ভন্ডামী, সেটা ভাবার সময় হয়েছে।
সময়ই বলে দিচ্ছে, তাদের ভন্ডামী যেমনি বেড়েছে, তেমনি লজ্জাশরমও অনেক কমে গেছে। লজ্জাশরম থাকলে ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত মুখচেনা অনেকেই প্রকাশ্যে মাঠে নেমে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন করতো না। তাদের লজ্জাহীনতার মূলশক্তি তাদেরই অনুসারীর দল। কেননা অনুসারীরা বিশ্বাসই করতে চায় না যে তাদের প্রিয় মানুষগুলো এমন কাজ করতে পারে! যে কাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক করতে পারে, মাদ্রাসার শিক্ষকও পারে; তাহলে অনুসারীদের প্রিয়নেতা এমন কোন সাধু যে পারবে না!
তারা সাধু না হলেও সাধু সাজার চেষ্টা করেন। এমনি সাধু সাজা মানুষদের কারণেই দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি ঘটনা গুরুত্ব হারায়। এই সাধুদের অনুসারীরাই বেঁচে থাকা সুন্দরী মেয়ে সামনে দিয়ে গেলে জিহবায় পানি আনে। বুকের মধ্যে ফিলিংস এর ঝড় তোলে। আর ইভটিজিং করে বলে, একখান সলিড মাল। আর যেই না কারো ধর্ষণে তেমনি কোন মাল হঠাৎ মরে যায়; অমনি শোকের মাতম শুরু হয়। দেশশুদ্ধ শুরু হয়। তখন সেই মাল আর মাল থাকে না। সাক্ষাত সহোদর বোন হয়ে যায়। “আহারে বোন আমার” বলে সে কী মাতম!
কেবল মাতম নয়, জিকিরও তোলে। মেয়েরা ধর্ষিতা হলে জিকিরের মিছিল শুরু হয়। জিকিরে কেউ বলে, পর্দা জরুরী। পর্দা থাকলে এমন হতো না। কেউ বলে, শালীন পোষাকের কথা। কিন্তু কেউই বলে না যে, এসবই সত্যি কথা। কিন্তু এসবের বাইরেও আরো সত্যি কথা আছে। না থাকলে ছোট ছোট ছেলেরা বলাৎকার হয় কেন? সুযোগ পেলেই পুরুষেরই একটি দল চেপে ধরে কেন ছেলেদের? বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন সমাজে বলাৎকার হয় না? কোথায় হয় না? ঘরে হয়, স্কুলে হয়। মাদ্রাসায়ও হয়।
আদালতে জবানবন্দি দেয়া কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার শাহ আহমদীয়া মাদ্রাসার নাছির হুজুর রুটিন করে প্রতি রাতে ছোট ছোট ছেলে শিশুদের বলাৎকার করেন। তরতাজা খবর। অথচ চারদিকে কোনো আওয়াজ নেই। নেই কোন মানব বন্ধন। সবাই চুপসে গেল। না যেয়ে উপায়ও নেই। কেননা এখন তো বলা যাবে না, ছেলেদেরও পর্দায় থাকতে হবে। ছোট্ট ছোট্ট ছেলেরা পর্দা আর হিজাব পড়ে ঘুরবে। আবার এটাও বলা যাবে না, বলাৎকার ধর্ষণের শ্রেণিভুক্ত নয় ।
বলাৎকার নিশ্চিত করেই ধর্ষণের চেয়েও ভয়ংকর এবং তাতে করে নির্যাতিত শিশুটির মানসিকতার উপর গুরুতর নেগেটিভ ইম্প্যাক্ট তৈরী করে। সুস্থ মনোবিকাশ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্থ হয়। অথচ ওরা ছিল নিষ্পাপ এবং কখনোই অশালীন পোশাক পড়েনি। তাই নিশ্চিত করেই বলা যায়, ধর্ষণ কিংবা বলাৎকার মোটেও পর্দা কিংবা পোষাকের সমস্যা না। এটা খাচ্চইরা পুরুষদের খাচ্চইরা সমস্যা।
এখন জরুরী হলো, পুরুষদের খাচ্চইরা স্বভাব ত্যাগ। বলা বাহুল্য, মেয়েদের শালীন পোষাক এবং পর্দায় থাকাও খুবই জরুরী। কিন্তু তার চেয়েও কম জরুরী নয়, ধর্ষণ কিংবা বলাৎকার সমস্যার অতীব গভীরে যাওয়া। মূলত মূল্যবোধ, নৈতিক অবক্ষয়, পারিবারিক, সামাজিক এবং সঠিক ধর্মীয় শিক্ষার অভাবই এর জন্য দায়ী। পবিত্র কোরআনে পরিষ্কারভাবে এসেছে, ‘মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য মঙ্গল আছে।’ -সুরা নূর, আয়াত ৩০।
বড় স্পষ্ট কথা। ধর্ষণ বন্ধে শুধু নারীর পর্দা নিয়ে যারা কথা বলছেন, তারা ভাল করে কোরআনের উপরোক্ত স্পষ্ট নির্দেশটিও পড়েছেন তো? নাকি ভিপি নূরের মত একচোখা? সব দোষ চাপিয়ে দেন মেয়েদের উপর? যে ঘটনার উদাহরণ দিয়ে নূর তার খুব কাছের সহকর্মীদের দ্বারা ধর্ষিতা মেয়েটিকে ‘দুশ্চরিত্রা’ বলেছিলেন, সে ঘটনায় তার সঙ্গী ছেলেটির চরিত্র নিয়ে কিন্তু নূর কোনো প্রশ্ন তোলেননি।
তোলেননি, কারণ তিনি একচোখা। আর সবার মতই একচোখা। ঘটনা যাই ঘটুক, পুরুষের কোন দোষ নেই। দোষ সব শিশু কিংবা মেয়েদের। হয় তাদের পোষাক খারাপ, নয় তাদের চরিত্র। পুরুষের কোনটাই খারাপ না! না তাদের পোষাক, না চোখ কিংবা চরিত্র!! আহারে পুরুষ!!!