করোনা দিনের ডায়েরি...
প্রকাশের সময় : 2020-11-26 12:23:29 | প্রকাশক : Administration
৭ম পর্ব
করোনা আমাদেরকে যে কয়টা নতুন শব্দ শিখিয়েছে তারমধ্যে লকডাউন একটি। সবচেয়ে বেশী আনন্দচিত্তে গ্রহণ করা শব্দ হলো এটি। অনেককেই দেখেছি নিজের এলাকা লকডাউন হবার পর ফোনে খুব গর্বের সাথে সুপ্ত একটা গুডফিলিংস নিয়ে অন্যকে বলে, জানিস! আমরা লকডাউনে আছি। যেন লকডাউনটাও চায়নাটাউনের মত কিছু একটা। শব্দটির মাঝে বিদেশী গন্ধ, বিদেশে থাকার ভাব। একটা স্ট্যাটাস স্ট্যাটাস ভাব।
ঢাকায় আমার অফিস পিয়নকে ভোরে ফোন দিলাম। পাইনা। ভোরের ফোনে আজকাল ওদের পাওয়াই যায় না। রাতভর সজাগ থেকে ঘুমুতে যায় ভোরে। পাবো কিভাবে? অবশেষে দুপুরে পেলাম। জানতে চাইলাম, কি অবস্থা তোমাদের? খুশী মনেই বললো, স্যার খুবই ভাল আছি। লকটাউন এ আছি। প্রথমে বুঝতে না পেরে দ্বিতীয়বার জানতে চাইলাম, কোথায় আছো? একই উত্তর, লকটাউন এ আছি, স্যার। “মানে কি? এই টাউনে কবে গেলা’’? আমি বললাম। খুব স্মার্টলি উত্তর ছেলেটার, সরি স্যার। লকটাউন না। লকডাউন।
আমি হাসতে হাসতে শেষ। হাসতে হাসতেই বললাম, তাই বলো। আচ্ছা, ঠিক আছে। এবার বলো, লকডাউন মানে কি? ছেলেটা হেসে দিল আর খুব কনফিডেন্টের সাথে বললো, মহল্লার রাস্তার মুখ বাঁশ দিয়ে আটকাইয়া লক কইরা বাঁশের নীচ দিয়া ডাউন হইয়া মহল্লায় আসাযাওয়ার নাম লকডাউন। এইটা এখন সবাই জানে স্যার! ফেসবুকেও আসছে, স্যার! ফেসবুক বলতে কথা। তাই খুব বিশ্বাসের সাথেই ছেলেটি বললো।
বর্তমানে জিনিস একখান ফেসবুক। কী নাই এখানে! সব আছে। সব মানুষের সব তথ্যের উৎস এই ফেসবুক। সত্য তথ্য, মিথ্যে তথ্য, অল্প মিথ্যা তথ্য, ঢাহা মিথ্যা তথ্য। বেশী থাকে গুজবীয় তথ্য। গুজবীয় তথ্যের মাঝে সবচেয়ে শক্তিশালী তথ্য হলো, প্রতিদিন হাজার হাজার লাশ গুম হচ্ছে। সরকার লাশ সরিয়ে নিচ্ছে। কবরস্থানে জায়গা নেই। হাসপাতালে কেবল লাশ আর লাশ।
আর বাজারে নাই বাঁশ। থাকবে কিভাবে? কাটতে কাটতে বাঁশঝাড় ছাফা হয়ে যাচ্ছে। কাউকে বাঁশ দেবার জন্যেও আতেলবাজরা বাঁশ খুঁজে পাচ্ছে না।
বাঁশের এখন মহা ক্রাইসিস। বাঁশ ছাড়াই দাফন হচ্ছে। কোথাও কোথাও মাটিচাপাও দিচ্ছে। তবে খুব গোপনে। দেশবাসী যাতে জানতে না পারে, তাই এসব গোপনীয়তা। সরকার লকডাউন দিয়েছে সবকিছু গোপন করার জন্যে।
টরোন্টো শহরও লকডাউনের আওতায়। রাষ্ট্র স্টেট অব ইমার্জেন্সি জারি করেছে। মৃত্যুপুরী হয়ে গেছে চারদিক। সত্যি সত্যি মৃত শহর টরোন্টো। চারদিকে সুনশান নীরবতা। রাস্তায় কদাচিৎ দু’একটা গাড়ীর দেখা মেলে। বড় রাস্তায় যাও মেলে। ছোট রাস্তায় সেটাও নেই। তবুও বিকেল থেকে মনটা আজকে খুবই ভাল। বলা চলে একেবারেই ফুরফুরা। টানা ৩ দিনের বৃষ্টির পরে হঠাৎ চিকচিক করা রোদ উঠলে যেমন লাগে, আজকে বিকেল থেকে ঠিক তেমন লাগছে। মনের মধ্যেও আহারে, উহুরে ভাবটা কেটে গেছে। অসহায়ত্ব আর আফসোসের ভাবটাও খুব একটা নেই। খুশী খুশী ভাব।
খুশীতে সোফা থেকে লাফিয়ে উঠলাম। হুরমুর করে লাফিয়ে ওঠা যাকে বলে। সারাক্ষণ তো সোফাতেই শুয়ে থাকি। মাসব্যাপী সোফায় শুয়েবসে থাকতে থাকতে পিঠে দাগ বসে গেছে। গায়ে সোফা সোফা দাগ; সোফা সোফা গন্ধ। এদিকে কোমরের ব্যাথাও বেড়েছে। তবে মনের সুখের কাছে কোমরের ব্যাথা কোন ব্যাথাই না। মূহুর্তে সব ভুলে গেছি। ভোলারই কথা। ঘরের কর্ত্রী শোনিমের আম্মু ঘোষণা দিয়েছে, আজকে হবে; রাতের ম্যানুতে গরুর গোশত হবে।
টানা ক’দিনের কঠিন গরমের পরে হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি যেমনি স্বস্তি দেয়, শোনিমের আম্মুও আজকে তেমনি স্বস্তিদায়ক খবর দিল। ‘ওয়াও’ বলে শোনিমকে নিয়ে চিৎকার দিলাম। শোনিমের চিৎকার তেমন জোরালো হলো না। জোরালো হলো আমারটা। দৌঁড়ে কিচেনে গেলাম। কিচেনের বেসিনে গরুর মাংশ রাখা। পলকহীন চোখে তাকিয়ে দেখলাম। ছেলেবেলায় একসাথে কোরবানীর সব গোশত বাসায় নিয়ে আসার পর পাতিলের পাশে বসে চোখ বড় করে কাঁচা মাংশ দেখতাম। আজকেও তাই দেখলাম।
চোখ বড় বড় করে দেখলাম। কাঁচা মাংস; কিন্তু দেখতে অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল। গত ক’দিনে মাংস খাওয়ার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। এমনিতেও যে খুব একটা খাই সেটাও নয়। তবে ঘরে থাকার পরে না খাওয়া, আর না থাকার কারণে খেতে না পাওয়া এক জিনিস নয়। আমরা ক’দিন ধরে কম করে খাওয়া শুরু করেছিলাম। ঘরে মজুদ কাঁচা দ্রব্যের টান পড়ায় আমাদের নাভিশ্বাস উঠেছিল। আমরা তিনজনায় বাধ্য হয়েই নিত্যদিনের তিনবেলার খাবার দু’বেলায় নামিয়ে এনেছিলাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠি দেরী করে যেন ব্রেকফাস্ট খেতে না হয়। ব্রেকফাস্ট ঘরে থাকলে না খাবো! তাই জোহর পড়ে বেলা তিনটের দিকে পানিতে নুডুলস ভিজিয়ে খেতে বসি। সকালের নাস্তা কাম দুপুরের খাবার। অবিশ্বাস্য ব্যাপার। মুখে খাবারের রুচি বেড়ে গেছে। কিন্তু কাল কী খাবো এই ভাবনায় খুব বেশী পরিমানে খাই না। হিসেব করে খাই। বেশী খাই পানি। ঢকঢক করে দু’কাপ পানি একবারে খেয়ে নেই। আর আল্লাহকে ডাকি। অন্তত সাপ্লাইয়ের পানিটা যেন বন্ধ না হয়।
পানি বন্ধ হলে মহাবিপদ হয়ে যাবে। নির্ঘাত মৃত্যু হবে। যুদ্ধ করে বেঁচে থাকার শেষ অস্ত্রটাও আর থাকবে না। তাই পানিটা দরকার। বেঁচে থাকার মত খাবার যথেষ্ট আছে। চাল আছে, ডাল আছে। আর আছে পর্যাপ্ত লবণ। তেল পেঁয়াজ তেমন নেই। লাগবেও না। ভাতের সাথে ডালসেদ্ধ হলেও ঢের টিকে থাকা যাবে। শোনিম খুব শক্ত। ও আমাকে সাহস দেয়। শক্তি দেয়। দেয় বেঁচে থাকার প্রেরণা। গত কয়টা দিনের হিসেবী জীবন আমাকে এবং আমাদেরকে সত্যি বদলে দিয়েছে।
রাতের ডাইনিং টেবিল। বাপবেটার দুই প্লেটে দুটো গোশতের স্ট্যাক রাখা। কাঁচা অবস্থায় স্ট্যাক দুটো যতটুকু মোটাসোটা ছিল; ভাঁজার পর একেবারেই তেমনটি নেই। শুকিয়ে গেছে। আস্ত ইলিশ মাছের শুকনো শুটকী দেখতে যেমন, ঠিক তেমন। তবে শোনিম তাতেই খুশী। আফটার অল বিফস্ট্যাক। সাথে দুটো করে এসপারাগাস ভেঁজে রাখা। আমার চক্ষু এসপারাগাসের দিকে। ওটা তো ফুরিয়ে গেছে অনেক আগে। আবার আসলো কোত্থেকে!
নিজের প্লেটে এসপারাগাস নিতে নিতে শোনিমের আম্মু বললো, ফ্রিজের তলায় পাওয়া গেছে। এসপারাগাস নিলেও বিফস্ট্যাক নিল না সে। স্ট্যাক ভাল লাগে না বলে আমাদেরকে খাবার শেষ করার তাগিদ দিল। অভিনয়! মিথ্যে মিথ্যে অভিনয়! বিফস্ট্যাক আর থাকলে তো নেবে? অথচ এমনভাবে অভিনয়টা করলো যেন এর চেয়ে সত্যি কথা দুনিয়াতে দ্বিতীয়টি নেই। এতটা বছরে মানুষটি একটুও বদলালো না। ঘরের কর্ত্রীরা বোধ হয় এমনই হয়। দুনিয়া বদলে যায়; তারা কখনোই বদলায় না।
এমনি না বদলানো মানুষটি ভাতের সাথে ডাল আর এসপারাগাস মাখতে মাখতে ঠিক একই ভঙ্গিতে আরো একটা খুশীর খবর দিল। কাল বাজার আসবে। শপিংমলে অর্ডার দেয়া বাজার। ছেলেবেলায় ঈদের আগের দিন আব্বা ঈদের বাজার নিয়ে বাসায় ফিরতেন। অনেক বাজার। চাল, ডাল, শেমাই, গোশত! আরো কত কী? প্যাকেট ভর্তি গরম মশল্লা আনতেন। দারুচিনি, কিসমিস এর গন্ধে ঘর মৌ মৌ করতো। আমরা গোল হয়ে বসতাম বাজার ঘিরে। আর একটু একটু করে খেতাম। টুশটুশ করে ভাঙতে ভাঙতে কাঁচাশেমাই খেয়ে প্রায় শেষ করে ফেলতাম। আর খেতাম কিসমিস। ততক্ষণ, যতক্ষণ না মা বকা দেন।
আজ মা নেই, বকা দেবারও কেউ নেই। একটু আগে বাজার এসেছে। কিন্তু খাচ্ছি না কিছুই। শুধু তাকিয়ে আছি। এত্ত এত্ত বাজার দেখে তাকিয়ে আছি। কলা, ডিম, দুধ, পাউরুটি, পেঁয়াজ, আলু, সবজি; আরো কত কী! ঘর ভরে গেছে। ঘরের সাধারণ বাজার দেখতেও যে এতটা অসাধারণ লাগতে পারে, এই জীবনে সেটা কোনদিন বুঝিনি! আমার শোনিমেরও বোঝার কথা না!! শোনিম বোঝেও না!!! চলবে...