নিষ্ঠুরতার বছর! চরম নিষ্ঠুরতার!!

প্রকাশের সময় : 2020-12-27 17:21:01 | প্রকাশক : Administration
নিষ্ঠুরতার বছর! চরম নিষ্ঠুরতার!!

ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীন

১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের বছর। ঠিক বিশ্বকাপের বছর নয়। সারা বাংলা ছিল কাঁপাকাঁপি আর ফাটাফাটির বছর। বছরজুড়ে দুটো নাম ছিল ফাটাফাটি রকমের আলোচিত। একটি আর্জেন্টিনা, অন্যটি ম্যারাডোনা। মাঠভর্তি সব বিদেশী খেলোয়ারদের বিদেশীনাম অদ্ভুত রকমের শোনালেও ম্যারাডোনা নামটা বাংলানাম হয়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল বাংলায় এরচেয়ে সুন্দর নাম আর হতেই পারে না।

ঘরে ঘরে তখনও টিভি আসেনি। শহরের মহল্লায় কিছু কিছু বাড়ীতে টিভি থাকতো। সেটাও সাদাকালো। সাইজে ১৭ থেকে ২০ ইঞ্চি হলেই সেটাকে ‘বড় টিভি’ বলা হতো। সাদা কালো ২৪ ইঞ্চি ছিল বিশাল বড় স্বপ্নের মত। রাজাবাদশাহদের ঘরে থাকার জিনিস। আমাদের মত মানুষদের ঘরে নয়। ঘটনাক্রমে আমাদের বাসায় ১৪ ইঞ্চি একটা টিভি ছিল। তবে এর গুরুত্ব ছিল সবার থেকে আলাদা। দুটো বিশেষ বৈশিষ্ট্য একে আলাদা করেছিল।

প্রথমত টিভিটি কালার টিভি। দ্বিতীয়ত রিমোটে চলা টিভি। এক এলাহী কান্ড। রিমোট সিস্টেম দূরের কথা, পুরো টংগীর কোথায়ও ২য় কোন কালার টিভি নেই। প্রভাবশালী, প্রতাপশালী কারো ঘরেই নেই। আমরা এর কোন শ্রেণীভুক্ত না হওয়া সত্ত্বেও ঘটনাক্রমে আমাদের ঘরে ছিল। প্রবাসী বড়ভাইয়ের কল্যাণেই ছিল। বড় ভাইয়া বিদেশ থেকে টিভিটা এনেছিলেন। অনেকটা পাগলামী করেই এনেছিলেন। পাগলামীর ধরণটা এমন; নিবো যখন কালারই নিবো। কারো বাসায় যা নেই, তাই নেবো। এলাকা ফাটাইয়া দেবো।

এটাকে বলে মধ্যবিত্তের পাগলামো। “খাই বা না খাই, দেখাইয়া দিতে হবে” টাইপের পাগলামো। পুরোটাই উচ্চবিত্তের কাছ থেকে শেখা। জাতে ওঠার জায়গায় মধ্যবিত্ত সদা অনুসরণ করে উচ্চবিত্তকে। কিন্তু পারে না। উচ্চবিত্তের কাছ থেকে ভাল কিছু শিখে জাতে ওঠার সুযোগ নেই বললেই চলে। যা শেখে সবই পাগলামো। আরও দশটা পাগলামোর মত অন্যকে দেখিয়ে দেবার পাগলামোটাও মধ্যবিত্ত শেখে উচ্চবিত্তের কাছ থেকে। দেখে দেখে শিখে।

ভাইয়াও শিখেছিলেন। ভুল শেখেননি। কালার টিভির বদৌলতে মধ্যবিত্তের মাঝেই আমাদের অবস্থান বদলে গেল। জাতে উঠে গেলাম আমরা। দিনে যেমন তেমন, আমাদের কদর বাড়ে রাতে। ফ্রিজ না থাকুক, সোফা না থাকুক ঘরে; রিমোট সিষ্টেমের কালার টিভি তো আছে। চারিদিকে ছড়িয়ে গেল কথাটা। এটা বুঝতাম সন্ধ্যা হলেই। সন্ধ্যায় প্রায় শ’দুয়েক লোক আসতো টিভি দেখতে। মাগরিবের পরপরই একজন দুইজন করে আসা শুরু হতো। এসে প্রথমে জানালার পাশে উঁকি দিত। তারপর ঘরের দরজায় টোকা।

ছোট্ট বসার ঘর। বড় পাবো কোথায়! মধ্যবিত্তের বসার ঘর কখনই বড় হয় না। তাই ঘরে এত্ত লোককে বসাবার জায়গা দিতে পারতাম না। অবশেষে সবার জন্যে বাসার সামনের মাঠে টিভি বের করে দিতাম। বাসার সামনের খোলা মাঠে বড় একটা টেবিলে খুবই ছোট সাইজের টিভিটা রাখা আর সামনে মাঠভর্তি দর্শক। হা হয়ে দেখতো কালার টিভি। দেখতাম আমিও। শুধু দেখতাম না। মাঝেমধ্যে একটু ভাবও দেখাতাম। সবাইকে বুঝিয়ে দিতাম টিভিটা আমাদের। অকারণে রিমোটটা হাতে নিয়ে মাঝেমধ্যে সাউন্ড বাড়াতাম, কমাতাম। দরকার নেই, তবুও করতাম। একটা পোচপাচ দেখানো আর কি। হাতে রিমোট নিয়ে উঁচু করে সবাইকে দেখিয়ে পোচপাচ দেখাতাম।

সনটা ১৯৮৩ হবে হয়ত। পোচপাচ দেখাতে যেয়ে ভুল বাটনে টিপ দিয়ে ছ্যাড়াবেড়া লাগিয়ে দিলাম। টিভি ঝিরঝির করা শুরু করলো। কম্পিত হাতে রিমোটের বাটনে যতই টিপি চ্যানেল আর আসে না। সারা টিভিতে মোটে একটা চ্যানেল, বিটিভি। সেটাও ফুট্টুশ। আজ বিশেষ রাত। সপ্তাহের নয়; মাসের নাটক চলছে। মানে পূর্ণদৈর্ঘ্য ২ ঘন্টার বিশেষ নাটক। আবার নায়িকা চম্পার প্রথম নাটক; “শাহ্জাদীর কালো নেকাব”। আবদুল্লাহ আল মামুনের পরিচালনায় আংশিক রঙিন নাটক।

তখনও অধিকাংশ নাটক হতো সাদাকালো। অন্যদিকে চম্পা নতুন। কেউ চেনে না চম্পাকে। শুধু জানে ববিতার বোন চম্পা। এইজন্যে আজ মানুষও বেশী হয়েছে। মাঠ ভরে গেছে এ মাথা থেকে ও মাথা। বলা যায় লোকে গিজগিজ করছে। রঙিন নাটকের পর্দায় রঙিন চম্পাকে দেখবে। অথচ আমার পোদ্দারীর জ্বালায় দেখা যাচ্ছে না। শুধু ঝিরঝিরটাই দেখা যাচ্ছে। আর মাঝে মাঝে টিভি শো শো, শো শো করছে। এক পর্যায়ে চ্যানেল পাওয়া গেল। আমিও বাঁচলাম।

ভাগ্যিস কেউ কিছু বলেনি। সাহস পায়নি বলেই বলেনি। বললে কাল থেকে টিভি আর বাসার বাইরে বেরুবে না। নাটক হোক আর উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসর সুর লহরী হোক, রঙিন টিভি দেখার সুযোগ নেই। এই ভয়তেই বলতে সাহস পায়নি। তবে মনে মনে বলতে ছেড়েছে বলে মনে হয় না। মনে মনে যা মনে এসেছে তাই বলেছে। সবচেয়ে বেশী বলেছে, “টিভিডা লইয়া যা ফুডাঙিগিরি মারলি”।

ফুডাঙগিরি মারার সবচেয়ে বেশী সুযোগ আসলো ৮৬ সালে। ম্যারাডোনার সাল। বিশ্বকাপের জ্বরে বাংলাদেশের বিশেষ করে শহরাঞ্চল কাঁপছে। বিদ্যুৎ নেই বলে গ্রামাঞ্চলও থেমে থাকেনি। বাজারে কিংবা গ্রামের চেয়ারম্যানের বাড়ীতে ব্যাটারীচালিত টিভি চলছে। ম্যারাডোনাকে দেখতে উপচে পড়া ভীড় চারদিকে। পত্রিকা এবং রেডিওর কল্যাণেও ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে ম্যারাডোনা। ম্যারাডোনার ছবি আর ভিউকার্ডে বাংলাদেশ মেখে গেছে। স্কুলের খাতাকাগজও ম্যারাডোনার নামে। ম্যারাডোনা, চারদিকে শুধুই ম্যারাডোনা।

আমাদের শৈশব পেরোনো যৌবনের শুরুর কাল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে মিশে ছিল যে নামটি, সেটা ম্যারাডোনা। একটা মন মাতানো, মোহনীয় যাদুকরী নাম। ম্যারাডোনার ছবিওয়ালা খাতায় লিখতে লিখতে আমাদের স্কুলজীবন পার করেছি। ফুটবল মাঠে ছোটখাট সাইজের কেউ একজন বল পায়ে ডানেবায়ে কেটে দৌঁড়ালে তার নাম দিতাম ম্যারাডোনা। নাম তো বিশ্বে আরো ছিল। বিশ্বসেরা ম্যারাডোনার অগ্রজ পেলেও ছিল। কিন্তু মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা ছিল না।

ছিল ম্যারাডোনাই। ফুটবলের জাদুকর দিয়েগো ম্যারাডোনা । বিশ্ব সেরা তিনি। সেরাদেরও সেরা। বল তার পাঁয়ে পড়লে আর রক্ষে নেই। তিনি জানতেন, দর্শকও জানতো; গোলের জালে বল পৌঁছবেই। নিজ দলের ডি বক্সে বল পেয়ে ছোঁ মেরে সেই বল পাঁয়ে ছুটলেন। ছুটলেন তো ছুটলেনই। কেউ তার নাগালই পায় না। প্রথমে সেন্টার মাঠ পার করলেন। কেউ একজন বাঁধা দিল। বাঁধা টপকে তাকে কাটিয়ে বল পাস দিলেন একটু বাঁকিয়ে সামনে। দৌঁড়ে গিয়ে সেই বল আবার নিজেই ধরলেন। আবার দৌঁড়ালেন। এভাবে প্রতিপক্ষের ডিবক্স। এবার গোলকীপার সামনে। তাকেও কাটালেন। তারপর আস্তেধীরে জালে ফেললেন।

এমন যাদুকরী খেলা ম্যারাডোনাই দেখাতে পারেন। একবার নয়, বারবার পারেন। পারেন বলেই তাঁর অকাল প্রয়াণে বিশ্ববাসী কাঁদে। ফুটবলের জাদুকর দিয়াগো ম্যারাডোনার চির বিদায়ের খবর স্তব্ধ করে দিয়েছে পুরো বিশ্বকে। ২০২০ এ বিশ্ববাসী কাঁদতে কাঁদতে শেষ। করোনাভাইরাস মহামারীর ভয়াল থাবা নিয়ে শুরু হওয়া ২০২০ সালে মানুষের মৃত্যুর মিছিলের মধ্যে একের পর এক কিংবদন্তী হারানোর তালিকাটাও ক্রমেই লম্বা হচ্ছে। নিষ্ঠুর এই বছরে তারকা থেকে সাধারণ মানুষ, কেউ বাদ পড়েনি।  

ক্রমশ আরও নিষ্ঠুর হচ্ছে ২০২০। ম্যারাডোনার পরপরই চলে গেলেন আলী যাকের। প্রথিতযশা জাদরেল অভিনেতা। আশির দশকে তিনিও বিনোদন দিয়েছেন আমাদের প্রজন্মকে। কী নাটক, কী থিয়েটার! সব প্লাটফর্মে তিনি খেলেছেন প্রচন্ড শক্তিমত্তায়। আমাদের ঘরের ছোট্ট টিভির পর্দায় তিনি হাসিয়েছেন আমাদের। কাঁদিয়েছেনও আমাদের। এবার চিরবিদায় নিয়ে শেষবারের মত কাঁদালেন।

কেবল আলী যাকের নয়, একএক করে অনেকেই চলে গেছেন। কাকে বাদ দিয়ে কার কথা লিখবো! শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবি, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, রাজনীতিবিদ, এমপি, মন্ত্রী, আমলা, পুলিশ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কার কথা বলবো? বাংলাদেশের নক্ষত্রের আকাশে জ্বলজ্বল করে জ্বলা নক্ষত্রগুলো একের পর এক নিভে যাচ্ছে। এমনও দিন গেছে একই রাতে একাধিক নক্ষত্রের পতন হয়েছে। আমরা কেবল চেয়ে চেয়ে দেখেছি। করোনাকালের নক্ষত্রের রাত দেখেছি।

দেখতে দেখতে বড় ক্লান্ত আমরা। বছর শেষ হয়ে এলো। তবুও করোনা শেষ হলো না। কে জানে কখন শেষ হবে বা আদৌ শেষ হবে কি না। বড় খারাপ সময় গেল সালটা। ২০২০ সালটা আসলেই বড় ভয়ানক একটা সাল! মরণ বিষে ভরা বিশ সাল! আমাদের চারপাশ আস্তে আস্তে খালি করার সাল। হায় রে বিশে বিশ! আর কত নিষ্ঠুর হবি!! আর কত!!!

 

সম্পাদক ও প্রকাশক: সরদার মোঃ শাহীন
উপদেষ্টা সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম সুজন
বার্তা সম্পাদক: ফোয়ারা ইয়াছমিন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: আবু মুসা
সহ: সম্পাদক: মোঃ শামছুজ্জামান

প্রকাশক কর্তৃক সিমেক ফাউন্ডেশন এর পক্ষে
বিএস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড,
ওয়ারী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০ হতে প্রকাশিত।

বানিজ্যিক অফিস: ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
বার্তা বিভাগ: বাড়ি # ৩৩, রোড # ১৫, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
ফোন: ০১৯১২৫২২০১৭, ৮৮০-২-৭৯১২৯২১
Email: simecnews@gmail.com