করোনা দিনের ডায়েরি...
প্রকাশের সময় : 2021-01-07 11:57:47 | প্রকাশক : Administration
১০তম পর্ব
ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীন
করোনায় একেবারেই ভাল নেই। কেবল আমি নই; কেউই ভাল নেই। কিছু করারও নেই। আমার শোনিমকে কোলে নিয়ে প্রবাস বিভূঁইয়ে শুয়েবসে থাকা ছাড়া আসলেই কিছু করার নেই। এ যে সন্তানকে নিয়ে প্রকৃতির কাছে এক অসহায় বাবার করুণ আত্মসমর্পন। মনকে বোঝাতে পারছি না; বিশ্বাস হচ্ছে না কিছুই। সব যেন বদলে গেছে। সারা পৃথিবীটাই বদলে গেছে। করোনা পুরো পৃথিবীকে ছাড়খার করে দিয়েছে। অদৃশ্যমান করোনা প্রমাণ করেছে দৃশ্যমান মিসাইলের চেয়েও তাদের শক্তি কোটি কোটি গুণ বেশি। প্রমাণ করেছে তাদের কাছে মানুষ বড় অসহায়।
দীর্ঘ পঁচিশ বছরের প্রবাস জীবন আমাকে এতটা অসহায় করেনি কখনো। এতটা শিখিওনি কোনদিন। শুধু শিখেছিলাম, পুরো পৃথিবীটা খুব একটা বড় নয়, কেবল বড়সড় আয়তনের একটি গ্রাম কিংবা গ্লোবাল ভিলেজ। এটাই বুঝতে শিখেছি। যতই বয়স হয়েছে কিংবা যাওয়া আসার মাত্রা বেড়েছে ততই বুঝটা পাকাপোক্ত হয়েছে। নিত্য কাজের প্রয়োজনে যত দূরের দেশেই যাই, মনে হয় এই তো যেন পাশের পাড়া। পাশের বাড়ী।
শুধু বাড়ীর মানুষগুলোর চেহারা ভিন্ন, ভাষা ভিন্ন; ভিন্ন তাদের আচার এবং কালচার। কেউ সাদা, কেউ কালো। কেউ বা সাদা কালোর মিশ্রণ। কারো গায়ে ফতুয়া, কারো পায়ে বুট। কেউ আছে জামা পড়ে, কেউবা স্যুট। একেবারে খালি গায়ের মানুষেরও কমতি নেই। খালি গায়ে লজ্জাস্থান কোন রকম ঢেকেঢুকে যেমনি আছে, তেমনি একরত্তি সূঁতোর ছিটেফোটা ছাড়াও উদাম গায়ের মানুষ আছে। এরাও সমাজবদ্ধ মানুষ। তবে বর্ণগোত্রে যত অমিলই হোক, মিল কেবল একটি জায়গায়। নিজ জাতিস্বত্বার কৃষ্টি ধারণ এবং লালনে সবাই একট্টা। একজোট।
কৃষ্টির একটি আবেগী বিষয় নববর্ষ। এবং উৎসবী বিষয় নববর্ষকে ঘটা করে বরণ করে নেয়া। এটা চলছে যুগযুগ ধরে। সারা পৃথিবীর সব দেশের সব জাতির মধ্যে নববর্ষ নিয়ে একটা উম্মাদনা, উত্তেজনা কাজ করে। সবচেয়ে বেশি করে চীন দেশে। ফেব্রুয়ারীর মাঝামাঝি পুরো জাতি, পুরো দেশ নববর্ষ উদযাপনে ফেটে পড়ে। লাল রঙ চীনাদের ঐতিহ্যের প্রতীক। চায়নীজ নববর্ষে পুরো চায়না লালময় হয়ে উঠে। মিথ্যে বলবো না; লাল এর এমন সমাহার দেখতে আমার খারাপ লাগে না। আমার শোনিমেরও না।
তবে শোনিমের বেশি ভাল লাগে জাপানের নববর্ষ উদযাপন। জন্মভূমি বলে হয়ত কথা। এই জাপানের আলাদা করে নিজস্ব কোন ক্যালেন্ডার নেই। নেই আলাদা বছরের কোন হিসেব নিকেষও। জাপানীজরা ইংরেজী ক্যালেন্ডারই ফলো করে। এবং ইংরেজী নববর্ষই ওরা নিজেদের মত করে উদযাপন করে। উদযাপনের ধরণটাও ভিন্ন। সূর্যোদয়ের দেশ হিসেবে ওরা বছরের প্রথম সূর্য্য পৃথিবীতে সর্বাগ্যে দেখে বলেই বিশ্বাস করে। এবং প্রথম সূর্য্যরে প্রথম পরশ পাবার আশায় বিশাল বিশাল কান্ড করে।
মধ্যরাত থেকে শতশত বিনোদতরীতে চড়ে হাজার হাজার জাপানীজ প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থান নেয় নববর্ষের প্রথম সূর্য্যকে বরণ করবে বলে। সবার আগে দেখবে বলে। রাতভর বেয়ে বেয়ে জাপানের সর্বোচ্চ পাহাড় ফুজিসানের চুড়ায় উঠে রাতযাপন করে অজস্র মানুষ; কেবলমাত্র চুড়া থেকে নতুন বছরের নতুন সূর্য্যকে সর্বপ্রথম দেখার আশায়। মেঘেরও অনেক উপরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা ফুজিসানের চুড়া থেকে নতুন বছরের নতুন সূর্য্যকে সর্বপ্রথম দেখতে পাওয়া একটা বিশাল ভাগ্যের ব্যাপার বলেও অধিকাংশ জাপানীজ মনে করে।
জাপানে সবচেয়ে বড় আয়োজন হয় প্লেনে চড়ে। এটা সত্যি সত্যি একটা এডভেঞ্চাচারাস আয়োজন। ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভোরে দেশটির প্রায় সব এয়ারপোর্ট থেকে চাটার্ড করা ঢাউস সাইজের অসংখ্য বিমান আকাশে উড়ে। বিমান ভর্তি যাত্রী। যেন যাত্রীতে গিজগিজ করছে। নববর্ষ উদযাপনের উৎসুক সে সকল যাত্রী। লক্ষ্য সবার একটাই। মেঘের উপর ভেসে ভেসে বিনা বাধায় চিকচিকা নববর্ষের নতুন সূর্য্য অবলোকন করা। প্রায় বারো কিলোমিটার উপর থেকে নতুন বছরের নতুন সূর্য্য অনেকের দেখার আগে দেখার নিমিত্তেই এত বড় আয়োজন।
বাঙালীর এত কিছু লাগে না। এত আয়োজন, এত প্রয়োজন কোনটাই লাগে না। শুধু লাগে উৎসবে মেতে ওঠার ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন ছোট্ট একটা মন। উদ্বেলিত হবার জন্যে অধিকাংশ বাঙালীর সেই আমোদী মনটা আছে। আদিকাল থেকেই আছে। আর আছে বলেই যত না বাহ্যিকভাবে বাঙালী নববর্ষ আয়োজন করে, নববর্ষ মনে ধারণ করাকে তার চেয়ে ঢের বেশী প্রয়োজন মনে করে। প্রয়োজন কৃষ্টিকে ধরে রাখার; জাতিসত্ত্বাকে তুলে ধরার।
ছেলেবেলায় আমি এসব বুঝতাম না। বোঝার কথাও না। তবে ঘরের উঠোন যখন বর্গাচাষীদের আনাগোনা আর বোরো ধানে ভরে যেত, মা যখন পাতিলে বালি গরম করে নতুন চালের মুড়ি করতেন; বুঝতাম মজার মাস বৈশাখ এসেছে। সে কী কর্মযজ্ঞ সারা বাড়ী জুড়ে! নতুন কাঁচা ধানের গন্ধে বাড়ী মৌ মৌ করতো। সিদ্ধ ধানেও করতো। একটা ভ্যাপসা ভ্যাপসা গন্ধ। খারাপ লাগতো না। পরতো মুড়ি খাওয়ার ধুম। বৈশাখ মানে কুচুরমুচুর করে সদ্যভাজা মুড়ি চাবানো। বৈশাখ মানে নবান্ন; বৈশাখ মানে পিঠাপুলির সমাহার।
বৈশাখে বেশী মজা পেতাম ছোটছোট মাটির হাড়িপাতিল কিনে। ওসব বেশি পাওয়া যেত কাছাকাছি কোন মেলায়। অনেক মেলা হতো। প্যাপো প্যাপো করা বাঁশের বাঁশি, রাবারের গুলাইল, মাটির পুতুল, বেলুন, আরো কত কী! তবে মেলার প্রধান আকর্ষণ ছিল গুড়েভাজা গরম জিলাপী। আর কিছু কেনা হোক বা না হোক, জিলাপী কিনতেই হবে। খোলা মাঠে তরতাজা গরম তেলে জিলাপী ভাজা হচ্ছে। উফ! সে কী দৃশ্য! ভাজা শেষে গুড়ের সিরায় হালকা ভিজিয়ে রেখে সামনের পাত্রে রাখছে। মনে হতো গোগ্রাসে সব সাবার করি।
শিশু মনে এমনি কত কিছুই না মনে হতো। সারাক্ষণ মন আনচান করতো। বেশি করতো বৈশাখী ঝড়ে। সন্ধ্যার আগে আগে হঠাৎ আসা বৈশাখী ঝড় সব লন্ডভন্ড করে দিয়ে যেত। গাছপালা উপড়ে পড়তো। বেশি ডলা যেত আমের উপর দিয়ে। কচি মুকুল কিংবা ছোট ছোট কাঁচা আম, মাঝারী আম সব ঝরে পড়তো। দেখে খুব মজা পেতাম আর অপেক্ষায় থাকতাম বৃষ্টি শেষের। বৃষ্টি কোনমতে শেষ হলে দৌঁড়ে যেতাম সেসব কুড়াতে।
ওফ! সে কী এডভ্যাঞ্চার। বৈশাখী এডভ্যাঞ্চার। বৈশাখী ঝড়ের জন্যে মনে মনে দোয়া করতাম আর কবিতা আওড়াতাম বিড়বিড় করে। বড় সখের কবিতা।
ঝড় এলো এলো ঝড়;
আম পর, আম পর।
কাঁচা আম ঠাসা আম; টকটক মিষ্টি!
এই যা এলো বুঝি বৃষ্টি!!!
একবার বৈশাখী বৃষ্টি শেষে গায়ে কাঁদা মেখে ঝরে পড়া গোটা কয়েক আম কুড়িয়ে বাসায় ফিরছি। ধলার পুরানো জমিদার বাড়ীতে আব্বার অফিসকর্তা ম্যানেজার সাহেবের বাসার পরেই আমাদের বাসা। সিলেটি ম্যানেজার। বিটলার বিটলা। হাম্ভরা ভাব। যেন পুরো জমিদার বাড়ীটিই তার। সরকারী গাছের আম। কিন্তু তিনি কেবল একা খাবেন; কাউকে দিবেন না। হঠাৎ বিটলাবাবুকে সামনে দেখে আমি ভড়কে গেলাম। চটজলদি আমগুলো লুকোবার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। খাটো আকৃতির গুমরোমুখো বিটলাবাবু হাঁক দিলেন; কিতা করছরে কেরানীর পোয়া! চুরি করতাছইসনি! চুরি কইরা আম গুলাইন সব লইয়া যাইবিনি!
কপাল ভাল। কষ্টে টোকানো আমগুলো রেখে দিয়েছেন কেবল। গায়ে হাত তোলেননি। বাবার বস; হাত তুলতেই পারেন। জমানাটাই তখন তেমন। এবং একবার তুলেছিলেনও। ক্লাস থ্রির ছাত্র আমি। তার ছেলে সোহেলও আমার সহপাঠী। ঘটনাটি সকাল বেলার; ঈদের দিনের সকাল। ঈদের জামাতে সহপাঠীকে নিয়ে বৈশাখের সেই সকালে প্রথম কাতারে দাঁড়িয়েছিলাম। কেরানীর ছেলে হয়ে সামনের কাতারে দাঁড়ানোর অপরাধে পেছন থেকে মাথায় শক্ত করে একটা চটকানা মেরেছিলেন ম্যানেজার কাকা। বাপতুলে ছোটখাট একখানা গালি দিতেও বাদ রাখেননি।
আজও ভাবলে কষ্ট লাগে; লজ্জাও লাগে। এবং বৈশাখী সেই লজ্জার কথা বৈশাখ এলেই মনে পড়ে। আজ বৈশাখের প্রথম দিন। করোনার বৈশাখ। করোনা জীবনকে বন্দি করেছে বটে; মনকে পারেনি। উড়াউড়া মন তাই আজ সারাদিন নস্টালজিকতা নিয়েই কাটিয়ে দিচ্ছে। মন তো মনই। বড় দুষ্ট জিনিস। মাঝেমধ্যেই পুরাতন স্মৃতিকে সামনে নিয়ে আসে। বিশেষ করে কষ্টের স্মৃতি। পুরানো কষ্টের স্মৃতি আর আজকের করোনার কষ্ট মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে এবারের বৈশাখে। মনেও পড়ছে সব।
তবে বৈশাখ কেবল মনে পড়ায় না। ভুলতেও শিখায়। ভুলিয়ে দেয় পুরানো স্মৃতি, পুরানো গল্প। অতীত দিনের দুঃখ বেদনা কিংবা চাপাকান্নার পুঞ্জিভূত জলরাশি বাস্পে মিলিয়ে বৈশাখ সামনে এগুতে শেখায়। হয়ত এজন্যেই কবিগুরু ঠিক এভাবে আমাদের গাইতে শিখিয়েছেন; যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি! যাক অশ্রুবাস্প সুদূরে মিলাক! যাক যাক। এসো এসো। এসো হে বৈশাখ এসো এসো!!! চলবে