বাংলার শ্রেষ্ঠ দানবীর হাজি মহসিন

প্রকাশের সময় : 2021-03-18 12:25:18 | প্রকাশক : Administration
বাংলার শ্রেষ্ঠ দানবীর হাজি মহসিন

রাশিদ রিয়াজ: কিংবদন্তীতুল্য বাংলার শ্রেষ্ঠ দানবীর হাজী মুহাম্মদ মহসিনের অবদান অনস্বীকার্য। তিনি শুধু দানবীরই ছিলেন না; তিনি ছিলেন মানুষের প্রতি মায়া-মমতার মূর্তপ্রতীক। মুসলমানদের উচ্চ শিক্ষায় সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে এই মুসলিম দানবীর ১৮০৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘মহসিন ফান্ড’ নামক সংস্থায় তাঁর সর্বস্ব দান করেছিলেন।

হাজি মুহাম্মদ মহসিন খ্রিস্টীয় ১৭৩২ সালের ৩ জানুয়ারি (মতান্তরে ১৭৩০ খ্রিস্টাব্দে) পশ্চিম বঙ্গের হুগলিতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আগা মুহাম্মদ ফয়জুল্লাহর দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল জয়নব। তাঁর পূর্ব পুরুষের আদি নিবাস ছিল সুদূর পারস্যের ইস্ফাহান। সেখান থেকে ভাগ্য অন্বেষণে এসেছিলেন এদেশে। তারপর স্থায়ীভাবে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি শহরে আবাস গড়ে তুলে ছিলেন।

১৮১২ সালে মৃত্যুবরণ করেন হাজি মহসিন। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের (ইংরেজি ১৭৭০ সালে) সময় তাঁর দানের ওপর নির্ভর করে লক্ষ লক্ষ মানুষ অন্নাভাবজনিত মৃত্যু থেকে বেঁচে গিয়েছিল। ১৮০৬ সালে তিনি তাঁর প্রায় সমস্ত ভূ-সম্পত্তি একটি ওয়াকফ দলিলের মাধ্যমে দান করে যান।

হাজি মুহাম্মদ মহসিনের মায়ের নাম জয়নব খানম। তিনি ছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেবের খাজাঞ্চি আগা মোতাহারের দ্বিতীয় স্ত্রী। ভাগ্যের অন্বেষণে ভারতবর্ষে আসা আগা মোতাহার সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান ছিলেন। তাঁর প্রথম স্ত্রীর ঘরে কোনো সন্তান না হওয়ায় তিনি জয়নব খানমকে সন্তান লাভের আশায় বিবাহ করেন। দীর্ঘ দিন পর মোতাহারের দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে জন্ম নিল এক কন্যা সন্তান। তাঁর নাম ছিল মন্নুজান। আগা মোতাহার একসময় তাঁর মেয়ের নামে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি দান করেন। মন্নুজান ছোট থাকায় এ দানপত্র তিনি একটি মাদুলিতে ভরে তাঁর গলায় পরিয়ে দেন এবং তাঁর মৃত্যুর পর তা দেখার জন্য উপদেশ দেন। আগা মোতাহারের মৃত্যুর পর মন্নুজান শবে মাত্র কৈশোরে পদার্পন করেছে। সে মাদুলি খুলে দেখেন আগা মোতাহার তার সমস্ত সম্পদ মেয়ের নামে লিখে দিয়ে গেছেন। যা দেখে জয়নব খান মন্নুজানকে হাতছাড়া করতে চাচ্ছিলেন না। তাই তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করলেন আগা মুহাম্মদ ফয়জুল্লাহকে। এ ঘরেই জন্ম গ্রহণ করেন দানবীর হাজি মুহাম্মদ মহসিন। তখন সৎ বোন মন্নুজানের বয়স ১৩ বছর। মন্নুজানও ভাই পেয়ে মহা খুশী। হাজি মুহাম্মদ মহসিনের লালন-পালন, দেখাশুনা ও বাল্য শিক্ষা মন্নুজানের তত্ত্বাবধানেই চলতে লাগলো।

এদিকে মন্নুজান যৌবনে পদার্পন করেন। হাজি মুহাম্মদ মহসিন শিক্ষাকালে মন্নুজান হুগলিতে একাকি বাড়িতে থাকতেন। একদিকে তাঁর অনেক সম্পদঅন্য দিকে যুবতী মেয়ে। তাই কিছু দুষ্ট লোক তাঁর পেছনে ষড়যন্ত্র করতে লাগলো। তাই মন্নুজান ষড়যন্ত্রের কথা জেনে ভাই হাজি মুহাম্মদ মহসিনকে পত্র পাঠান। পত্র পেয়ে হাজি মুহাম্মদ মহসিন বোনকে রক্ষায় বাড়ি ফিরে আসেন। ভাই মহসিনকে তিনি তাঁর সমুদয় সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেন।

বোনকে সুপাত্রস্থ করার জন্য মহসিন চিন্তিত হয়ে পড়লেন। অবশেষে হুগলিতে নবাবের নিযুক্ত ফৌজদার সালাহউদ্দিনের সঙ্গে বোনের বিবাহ দিলেন। ধন-সম্পদের প্রতি নিরাসক্ত হাজি মুহাম্মদ  মহসিন বোনের বিয়ের পর দেশ ভ্রমণে বের হন। সফরকালে তিনি হজ্ব পালন করেন। তিনি মক্কা, মদিনা, কুফা, কারবালাসহ ইরান, ইরাক, আরব, তুরস্ক এমন নানা স্থান সফর করেছেন। সফর শেষে দীর্ঘ ২৭ বছর পর তিনি দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু তাঁর বিবাহ-শাদিতে মন বসছিল না। তাই তিনি সংসার জীবন থেকে দূরে ছিলেন।

বোনের অনুমতিক্রমে হাজি মুহাম্মদ মহসিন মুর্শিদাবাদে আসেন। তখন তাঁর বয়স ৬০ বছর। এ দিকে নিঃসন্তান বোন মন্নুজান স্বামীকে হারিয়ে বিধবা। তিনিও বার্ধক্যে উপনীত। এদিকে বিশাল সম্পদের মালিক আবার একাকি নিঃসঙ্গ। বোন মন্নুজান সম্পদের পেরেশানি থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর ধ্যানে জীবন কাটাতে ছোট ভাইয়ের নামে তাঁর সমস্ত সম্পদ লিখে দেন। সম্পদ লিখে দেয়ার কয়েক বছর পর ১৮০৩ সালে বোন মন্নুজান ইন্তেকাল করেন। হাজি মুহাম্মদ মহসিন খুব ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন এবংসহজসরল জীবনযাপন করতেন। তিনি চিরকুমার ছিলেন। ৭০ বছরের হাজি মহসিন এ বিপুল সম্পদ দানসদকায় ব্যয় করার মনস্থ করলেন। এ বিশাল সম্পদ তিনি মানবতার সেবায় ব্যয় করেন। দেশের সকল গরীব-দুঃখী ও দুঃস্থদের সেবায় তিনি নিজের সব সম্পদ বিলিয়ে দেন। বিপুল সম্পদের মালিক হয়েও মহসিন ছিলেন খুব ধার্মিক ও নিরহঙ্কারী। তিনি তার প্রতিষ্ঠিত ইমাম বাড়া প্রাসাদে বাস করতেন না। ইমাম বাড়ির পাশে একটি ছোট কুটিরে বাস করতেন। আর কুরআন শরীফ নকল করে যা পেতেন তা দিয়েই চলতেন। নিজ হাতে রান্না করে অধিনস্তদের নিয়ে বসে খেতেন। একবার এক চোর তার ঘরে প্রবেশ করে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে। মহসিন যখন জানতে পারে যে দরিদ্র লোকটির পরিবার ক্ষুধার্ত তখন সে তাকে আলমারির সিন্দুক থেকে যত ইচ্ছা অর্থ নিতে বলে। চোরটি যখন জানতে পারে যে এই ব্যক্তি হচ্ছেন দানবীর মহসিন তখন সে অভিভূত হয়ে পড়ে।

তিনি মুসলমানদের সুশিক্ষায় ১৮০৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘মহসিন ফান্ড’ নামক তহবিল প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর সমুদয় অর্থ এ ফাউন্ডেশনের জন্য দান করেন। এ ফান্ডের কার্যক্রম সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্য দুই জন মোতাওয়াল্লি নিয়োগ করেন। শুধু মোতাওয়াল্লি নিয়োগই নয়, মহসিন ফান্ডের ব্যয় নির্বাহের জন্য দানকৃত সম্পত্তিকে নয়ভাগে ভাগ করেন। তন্মধ্যে তিনভাগ সম্পদ ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে ব্যবহারের জন্য। চারভাগ সম্পদ পেনশন, বৃত্তি ও দাতব্য কর্মকাণ্ডে খরচ করার জন্য এবং দুইভাগ সম্পদ মোতাওয়াল্লিদের পারিশ্রমিকের জন্য বরাদ্দ করেন। তাছাড়া তাঁর দানকৃত অর্থে অসংখ্য দরিদ্র ছাত্রের পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়।

হাজী মুহম্মদ মুহসীনকে আমরা দানবীর বলে জানলেও তিনি একজন বড় মাপের সঙ্গীতজ্ঞ ও গণিতশাস্ত্রবিদও ছিলেন। বাংলার শ্রেষ্ঠ দানবীর হাজি মুহাম্মদ মহসিন ১৮১২ সালে ৭৯ মতান্তরে ৮০ বছর বয়সে হুগলির নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। তাকে হুগলির ইমামবাড়ায় দাফন করা হয়। - সূত্র: অনলাইন

 

সম্পাদক ও প্রকাশক: সরদার মোঃ শাহীন
উপদেষ্টা সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম সুজন
বার্তা সম্পাদক: ফোয়ারা ইয়াছমিন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: আবু মুসা
সহ: সম্পাদক: মোঃ শামছুজ্জামান

প্রকাশক কর্তৃক সিমেক ফাউন্ডেশন এর পক্ষে
বিএস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড,
ওয়ারী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০ হতে প্রকাশিত।

বানিজ্যিক অফিস: ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
বার্তা বিভাগ: বাড়ি # ৩৩, রোড # ১৫, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
ফোন: ০১৮৯৬০৫৭৯৯৯
Email: simecnews@gmail.com