হারানো শৈশব; কুড়ানো সেই সব!! (৩৪তম পর্ব)

প্রকাশের সময় : 2018-07-13 12:26:01 | প্রকাশক : Admin
হারানো শৈশব; কুড়ানো সেই সব!! (৩৪তম পর্ব)

ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীনঃ আমাদের সময়ে শিক্ষকরা তটস্ত থাকতেন, যেন কোনভাবেই শিক্ষার্থীদের জীবনে পঙ্গুত্ব না আসে। যেভাবেই হোক, যত খারাপ ছাত্রই হোক, তাঁরা মনেপ্রাণে চাইতেন যেন ফেল করে কারো জীবন থেমে না যায়। একদিন সেভেনের পরীক্ষার হলে আমার ঠিক পেছনে সিট পড়েছে একই ক্লাশে পড়া আমার আপন বড়ভাইয়ের। পিঠাপিঠি হলেও দু’ভাই একই ক্লাশে পড়ি। আমি লিখে চলেছি আর পেছনে বসা ভাইটি আমার কেঁদে চলেছে। মোটামুটি ভালভাবেই কেঁদে চলেছে। আমাকে ছাড়া তার পাশ হবে না। বিষয়টির দৃষ্টি এড়ায়নি আলম স্যারের। কাছে এসে আমাকে কানমলা দিয়ে বললেন, বড়-ভাই বাবার মত; সে কাঁদতেছে, আর তুমি তাকে দেখাচ্ছোনা! এটা কি ঠিক হলো?

এই হলেন আমাদের সময়কার স্যার। শিক্ষার্থীদের আবার ভালমন্দ কি! সবার প্রতি মায়া। ছাত্রদেরকে সব সময় যথাসাধ্য শিখাতে চেষ্টা করতেন। প্রয়োজনে শাসন করতেন। আবার আদর মায়াও করতেন। মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, শাসন করা তারই সাজে, সোহাগ করে যে। যারা একটু দূর্বল ছিল, তাদেরকেও আদর শাসন মাখিয়ে টেনে তুলে নিয়ে যেতেন। যথাসাধ্য চেষ্টা করার পরও যারা এগুতে পারে না, তাদেরকে ফেলে রেখে যাবার তো কোন মানে হয় না। ফেলে রেখে গেলে তারা তো সমাজের কোন উপকারে আসবে না। বরং সমাজের বোঝা হবে।

তাই মায়া দেখাতেন। আমাদের জন্যেই দেখাতেন। আমাদের মঙ্গলের জন্যেই দেখাতেন। প্রত্যেককে যার যার মত করে তৈরী করে ভবিষ্যত দেখাতেন। তাঁদের সকল সিদ্ধান্তই আমাদের ভবিষ্যতের কাজে আসতো। কিন্তু আমরা কোনকালেই বুঝতাম না। আদর করলে মজা পেতাম কিন্তু শাসন করলে মন খারাপ করতাম। তবুও অবুঝ মনের এই স্যাররা আমাদের পূরো জীবন গড়ার কাজে লেগে থাকতেন। কিন্তু স্যারদের কোন কাজে আসিনি আমরা। সেই শিশুকালেও আসিনি; বড় হবার পরেও আসিনি। বরাবর শুধু নিয়েছি তাঁদের কাছ থেকে; কোনদিনই দিতে পারিনি কোন কিছুই! তাঁরাও চাননি কোনদিন!!

বিশেষ করে নিজেদের জন্যে কিছুই চাইতেন না। তাঁরা চাইতেন আমরা আর যাই করি, পড়াশুনাটা যেন ঠিকমত করি। না হলে রাগ করতেন। মাঝেমাঝে বেজায় রাগ করতেন। না পারতে গায়ে হাতও তুলতেন। কিন্তু ভালবাসতে কখনো কৃপণতা করেননি। ভালবাসায় কোন কমতি ছিল না। আমরা খুব বেশী বেতাল করলে আলম স্যারও রাগ করতেন। কিন্তু মারতে পারতেন না। রাগলে আলম স্যার কেবল মুড অফ করে ফেলতেন। গম্ভীর মুখে পেটের ভুরি ধরে চিমটি দিয়ে হালকা আঘাত দিতেন। ধপাশ ধপাশ দিতেন না। ধপাশ ধপাশ দিতেন শফিকুল স্যার। আখতার স্যারও দিতেন। তবে শফিকুল স্যারের চেয়ে কম। ডাষ্টার দিয়ে দিতেন। ডাষ্টার দিয়ে ঘাড়টা নুইয়ে ধপাশ ধপাশ করে গোটা পাঁচেক দেবার কথা আগেই বলেছি।

ডাষ্টারের মাইর! একেবারে বাঁকা হয়ে গেলাম। সেদিন বেজায় ক্ষেপেছিলেন স্যার । ক্ষেপারই কথা। স্যারদের সাথে কতটুকু মজা করা যায় সেটা হাতে কলমে শিখিয়েছিলেন আখতার স্যার। জীবনভর ওটা মনে রেখেছি। আজো যখন স্যারের ফোন বাজে, স্যারের সাথে ফোনে কথা হয়, আমি খুব সতর্ক থাকি। ফোনটা ধরে আস্তে করে বলি, হ্যালো! মনে হয়, উল্টাপাল্টা কিছু বললেই তিনি দেবেন। ঘাড় ন্যুইয়ে দেবেন। ডাস্টার দিয়ে ধপাশ ধপাশ করে একটার পর একটা দেবেন।

আবার ঠিক ঘাড়ে নয়, কানে ধরে আলতো করে গালে দিতেন বজলু মাওলানা স্যার। ক্লাশে ঢুকেই সরাসরি আমার কাছে এসেই কানে ধরতেন। তারপর আলতো করে গালে একখানা বসিয়ে দিয়ে বলতেন, রে অরিন্দম, বইটা দে। স্যার আমাকে সব সময় অরিন্দম বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। সময়টা ১৯৭৮ সাল। ইউপি নির্বাচনের ডামাডোল শুরু হয়েছে। রাত নামলেই চারিদিকে নারায়ে তাকবির শ্লোগান । বিকেলে আমরা ছোটরাও আমার ভাই, তোমার ভাই শ্লোগান শ্লোগান খেলি। কোন প্রার্থী সামনে দিয়ে গেলেই আমরা ছুটতাম তার কাছ থেকে একটা ছাপানো পোষ্টার নেবার জন্যে। যেন পোষ্টার নয়, যক্ষের ধন পেয়েছি। হাঁড়কিপটে ছিল তখনকার প্রার্থীরা। বেশীরভাগ সময়ই পেতাম না। তবুও তার নামেই শ্লোগান দিতাম।

একদিন স্যারের সামনে পড়ে গেলাম। ধরে ফেলবার আগেই কোনমতে পালিয়ে বাসায় ফিরেছি বটে। তবে পরদিন ক্লাশে এসেই কানে ধরে বললেন, দে, শ্লোগান দে। জোরে জোরে দে। মাথা নীচু করে আমি তো চুপ। স্যার কান মোচড়াচ্ছেন। আজকে আর আলতো করে নয়, একটু যেন জোরেই মোচড়াচ্ছেন। এক পর্যায়ে কান ছেড়ে হেসে দিয়ে বললেন, দুষ্টামি যাই করো, পড়া না পারলে খবর অছে। তবে পারলে সব মাফ। বুঝছিস অরিন্দম? এবার বল! চেয়ারম্যান প্রার্থীদের নাম বল।

দু’জন প্রার্থী। রানিং চেয়ারম্যান তফাজ্জল হোসেন সাহেবের সাথে নতুন প্রার্থী বাদল ভাইয়ের নির্বাচন যুদ্ধ জমেছে বেশ। বয়সে খুবই তরুন কিন্তু সম্ভাবনাময়ী গোলাম মোহাম্মদ বাদল ভাই। তবে তফাজ্জল চেয়ারম্যানকে হারানো খুবই কঠিন। তাঁর শক্ত ইমেজ। বাদল ভাইয়ের একমাত্র সম্বল তিনি মরহুম শরাফত চেয়ারম্যান সাহেবের বড় ছেলে। এটাই তার পরিচয়। এই পরিচয়েই তার যুদ্ধে নামা। যতটুকু মনে পড়ে, দাঁড়িপাল্লার সাথে হারিকেনের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই।

এদিকে আব্দুল হাই চাচাও নেমেছেন মেম্বার প্রার্থী হয়ে। এটাও তার জীবনের প্রথম নির্বাচন। চেয়ার মার্কা নিয়ে তিনি নেমেছেন। তফাজ্জল চাচা পাশ করতে পারেননি। সবাইকে অবাক করে দিয়ে বাদল ভাই প্রথমবারের মত চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। হাই চাচাও নির্বাচিত হন। মজার বিষয় হলো বাদল ভাই আজও এলাকার চেয়ারম্যান। চতুর্থবারের মত চেয়ারম্যান। হাই চাচাও মেম্বার। গেল ৪০ বছরে কোন নির্বাচনে না হারা অপরাজিত মেম্বার। মনে হয় বাকী জীবনও তিনি অপরাজিত থাকবেন।

অপরাজিত থাকাটা যেনতেন কোন বিষয় নয়। যেনতেন বিষয় হলো পরাজিত হওয়া। বারবার জয়ের লক্ষ্য নিয়ে খেলতে নেমে বারবারই পরাজিত হবার রেকর্ড আমার আছে। স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতায় নাম লিখিয়েছি সব আইটেমে। ক্লাশে ফার্ষ্ট হবার মতই এখানেও চ্যাম্পিয়ন হবো এই  আশায়। পারিনি কাদিরের জন্যে। আমাদের সময়কার ম্যারাডোনা ‘মুন্তু ভাই’য়ের ছোটভাই পিচ্চি কাদিরের জ¦ালায় পারিনি। ছোটখাট গড়নের আব্দুল কাদির সবটাতেই ফার্ষ্ট। দৌঁড় শুরু করলে আর পেছনে ফিরতো না।

বড় আশা ছিল আর কিছু না পারি, বিষ্কুট দৌঁড়ে দেখিয়ে দিব সবাইকে। আমি ১০০% কনফিডেন্ট। সমস্যা হলো এই দৌঁড়ে হাত পেছনে বাঁধা থাকতো। বিপদটা এখানেই। দৌঁড়ে আমরা বিস্কুটের কাছে চলে গেলাম। সবাই মুখ দিয়ে বিস্কুট ধরার জন্যে লাফাচ্ছি। যতই লাফাই, কারা যেন বিস্কুট ততই উপরে টেনে তুলে। মেজাজ ঠান্ডা রাখা দায়। বিস্কুট ঢুকতে যাবে মুখে, অমনি রশিতে টান। ফলাফলে লাড্ডু। তবে ভাল করেছি ফুটবলে। বেশ ভাল করেছি। দম নিয়ে দৌঁড়াতে পারতাম না বলে জায়গা হলো গোলকিপারে। জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল বানিয়ে খেলা শিখে শিখে গোলকিপার হয়েছি। রোজ বিকেলে খেলতাম।

একদিন বন্ধুদের সাথে খেলছিলাম বাসার খুব কাছের ছোট মাঠে। প্রাইমারী স্কুলের খেলার মাঠ। এক সময়ে লক্ষ্য করলাম মাঠের খুব কাছের একটা বাসার পাশে দাঁড়িয়ে মা ইশারা করে আমায় ডাকছেন। খেলা ফেলে দৌঁড়ে মায়ের কাছে যেতেই মুখের মধ্যে কিছু একটা পুরে দিয়ে বললেন, তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। আমি চিবুচ্ছিলাম কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না কি খাচ্ছি। মা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, এইটা কমলা; খুবই দামী ফল। জীবনে এই প্রথম তোর মুখে দিতে পারলাম!!

এই হলো আমার মা! পাশের কোন বাসায় হয়তো বেড়াতে গিয়ে কমলার দুটো ছোট কোয়া পেয়েছিলেন আর সেটা নিজে না খেয়ে আঁচল তলে করে আমার জন্যে এনেছিলেন। আমাকে কিছু একটা দেবার জন্যে মা যে আমার কতটা পাগল ছিলেন তা আমি ছাড়া আর কেইবা জানবে! বাংলাদেশ আমলের প্রথম দিকে দেশটি এক রকম বিদেশী ফলশূন্য ছিল বিধায় আমাদের ছেলেবেলায় কমলা, আপেল চোখেও দেখিনি কিংবা চেখেও দেখিনি!!

জীবনের এই বয়সে এসে দেশবিদেশের নানা ফলের স্বাদ পেয়েছি প্রচুর। যতনা নামজানা ফল খেয়েছি, ঢের বেশী খেয়েছি নাম না জানা ফল। কত আকৃতির, কত রঙয়ের; কত দেশের! কিন্তু মায়ের হাতে তুলে দেয়া সেদিনের সেই কমলার কোয়ার স্বাদ আজো আমার মুখে লেগে আছে অমৃতের মত। এ এক অপূর্ব স্বাদের, অপূর্ব অনুভূতির!! চলবে...

 

সম্পাদক ও প্রকাশক: সরদার মোঃ শাহীন
উপদেষ্টা সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম সুজন
বার্তা সম্পাদক: ফোয়ারা ইয়াছমিন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: আবু মুসা
সহ: সম্পাদক: মোঃ শামছুজ্জামান

প্রকাশক কর্তৃক সিমেক ফাউন্ডেশন এর পক্ষে
বিএস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড,
ওয়ারী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০ হতে প্রকাশিত।

বানিজ্যিক অফিস: ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
বার্তা বিভাগ: বাড়ি # ৩৩, রোড # ১৫, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
ফোন: ০১৮৯৬০৫৭৯৯৯
Email: simecnews@gmail.com