ঢাকাই মসলিনের বাণিজ্যিক উৎপাদন
প্রকাশের সময় : 2021-05-05 14:44:24 | প্রকাশক : Administration
ফেরদৌস সিদ্দিকী: প্রায় দুই শতাব্দী আগে বিশ্বজুড়ে রাজত্ব ছিল মিহি সুতিবস্ত্র ‘ঢাকাই মসলিনের’। কিন্তু নানা কারণে প্রায় ১৭০ বছর আগে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক এই পণ্যটি হারিয়ে যায় দৃশ্যপট থেকে। হারানো মসলিনের পুনর্জন্ম হলো আবার। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) শিক্ষকের নেতৃত্বে ঐতিহ্যের সেই মসলিন ফিরেছে বাংলায়। দীর্ঘ ছয় বছরের চেষ্টায় ‘মসলিন’ বুনতে সক্ষম হয়েছেন তারা।
এবার ঐতিহ্যবাহী মসলিনের বাণিজ্যিক উৎপাদনের প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। প্রথম দিকে কাঁচামাল না পাওয়া কিছুটা সংশয় হলেও গবেষক দলের একান্ত প্রচেষ্টায় দুই শত বছরের পুরনো মসলিন পুনরুদ্ধার হয়েছে। বাঙালি জাতির আরও একটি ঐতিহ্য হচ্ছে সল্ক। যা রাজশাহীতে রয়েছে। সিল্ককে কিভাবে আরও সামনের দিকে নিয়ে যাওয়া যায়, সে বিষয়ে কাজ করা হচ্ছে।
সর্বশেষ ১৮৫০ সালে লন্ডনে প্রদর্শন হয় ঢাকাই মসলিনের। এর প্রায় ১৭০ বছর পর বাংলাদেশে ফিরেছে ঐতিহ্যবাহী এই মসলিন। মসলিন ফেরাতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ঢাকাই মসলিন তৈরির প্রযুক্তি ও পুনরুদ্ধার নামের প্রকল্পটি ২০১৪ সালে হাতে নেয়া হয়েছিল। এ নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যানকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়।
পরে গবেষণা কাজের স্বার্থে কমিটিতে যুক্ত করা হয় আরও সাতজন সদস্য। বই থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী মসলিন কাপড় বোনার জন্য ‘ফুটি কার্পাস’-এর কথা জানা যায়। পূর্ব ভারত তথা বাংলাদেশে এই গাছ চাষ হতো। ‘ফুটি কার্পাস তুলা সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন জায়গায় খোঁজখবর নিয়েছিলেন তারা। কাপাসিয়ায় এ তুলার চাষ হতো।
গাছের খোঁজে সে এলাকার বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদরাসায় চিঠি পাঠানো হয়, মাইকিং করা হয়। পরে সেখানে নয়টি তুলাগাছ পাওয়া গিয়েছিল। এছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৩৮ প্রজাতির তুলাগাছের সন্ধান পাওয়া যায়। সংগ্রহ করা এসব গাছ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা মাঠে চাষ শুরু করা হয়।
স্থানীয় উৎস থেকে মসলিন খুঁজতে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করা হয় আট টুকরা কাপড়। সেগুলোর কোনোটি মসলিন ছিল না। লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়াম থেকে মসলিনের কাপড়ের নমুনা ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। কাপাসিয়া থেকে সংগ্রহ করা তুলার আঁশ বেশি শক্ত, সাদা ধবধবে। এটা মসলিনের সেই সুতার কাছাকাছি যেতে পারে এমন ধারণা করা হয়েছিল।
তারপর লন্ডন থেকে সংগৃহীত মসলিন কাপড়ের ডিএনএ আর সেই তুলার ডিএনএ মিলিয়ে দেখা হলো। কাপাসিয়া থেকে সংগ্রহ করা তুলার জাতটা ফুটি কার্পাস। মসলিন তৈরি করার জন্য সাধারণত ৩০০ থেকে ৫০০ কাউন্টের সুতার প্রয়োজন হয়। কিন্তু ফুটি কার্পাস থেকে ৫০০ কাউন্টের সুতা তৈরি করা সহজ নয়।
এ সুতা আধুনিক যন্ত্রে তেরি করা সম্ভব হয়নি, চরকায় কাটাতে হয়েছিলো। চরকায় সুতা কাটা তাঁতিদের খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে কুমিল্লায় তাদের পাওয়া যায়। কিন্তু তারা মোটা সুতা কাটেন, যাতে কাউন্টের মাপ আসে না। পরে তাদের ৪০ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সেখান থেকে ছয়জনকে বাছাই করা হয়। বাছাই করতেই প্রায় দুই বছর লেগে যায়।
কিন্তু এতো মিহি সুতা দিয়ে কেউ বানাতে রাজি হচ্ছিলেন না। পরে তাদের কয়েক ধাপে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। বহু কষ্টে তারা বুনন পদ্ধতি রপ্ত করেন। অবশেষে ১৭১০ সালে বোনা শাড়ির নকশা দেখে হুবহু একটি শাড়ি বুনে ফেলেন তাঁতিরা। প্রথম অবস্থায় শাড়িটি তৈরি করতে খরচ পড়ে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
মোট ছয়টি শাড়ি তৈরি করা হয়। যার একটি প্রধানমন্ত্রীকে উপহার দেয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৪ কোটি ১০ লাখ টাকা। বরাদ্দের ৩০ শতাংশ খরচ হয়েছে। অবশিষ্ট ৭০ শতাংশ টাকা সরকারের কোষাগারে ফেরত দেয়া হয়েছে। প্রায় ১০ মাস আগে মসলিনের পাঁচটি নমুনা দিয়ে জিআই স্বীকৃতির জন্য আবেদন করে বাংলাদেশ।
গত ২৮ ডিসেম্বর ঢাকাই মসলিনকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ হয়। এতে মসলিনের উৎপত্তি, বুনন পদ্ধতি ও সুতা বাংলাদেশের বলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়া হয়। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে শিগগিরই দেশে মসলিনের বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হবে। এতে বাংলাদেশ পা দেবে মসলিনের নতুন অধ্যায়ে। -জাগোনিউজ২৪ডটকম