করোনা দিনের ডায়েরি...

প্রকাশের সময় : 2021-06-24 11:58:05 | প্রকাশক : Administration
করোনা দিনের ডায়েরি...

২১ তম পর্ব

ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীন

 

দিনটা শুরু করলাম একটা লেখা দিয়ে। পুলিশ কমিশনার মনিরুল ইসলামের চমৎকার লেখা। তিনি বেশ লেখেন। তিনি লিখেছেন, চলতি বছরের শুরুর দিকে পুলিশ সপ্তাহের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল, মুজিব বর্ষের অঙ্গীকার, পুলিশ হবে জনতার। এই শ্লোগান শুনে অনেকে টিপ্পনী কেটেছেন, পুলিশ কি তাহলে এতোদিন জনতার পুলিশ ছিলো না, আর যদি এতো বছরে তা না হয়ে থাকে তবে মাত্র এক বছরে কিভাবে জনতার পুলিশ হবে?

তিনি আরো লিখেছেন, আমি বলি, না; প্রকৃতপক্ষেই পুলিশ জনতার পুলিশ ছিল না। তবে আমার মনেও সন্দেহ ছিল, মাত্র এক বছরে পুলিশের পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব! শতাব্দীর চলমান অভ্যাসগুলো রাতারাতি বদলে ফেলে জনতার পুলিশে পরিণত করার কাজটি অসম্ভব না হলেও নিতান্তই কঠিন। করোনার এই নিদানকালে দেখতে পাই, পুলিশ কনস্টেবল একা পরিত্যক্ত লাশ ভ্যানে তুলে নিজে ভ্যান চালিয়ে থানায় নিয়ে যাচ্ছে। দেখি, সংজ্ঞাহীন বৃদ্ধার সাহায্যে পথচারী কেউ না এগুলেও পিপিই পরিহিত পুলিশ সদস্য বৃদ্ধার মাথায় পানি ঢালছেন।

মনিরুল ইসলাম আরো লিখেছেন, করোনা সন্দেহে মৃত দেহের সৎকারে কেউ এগিয়ে আসছে না। পুলিশ সদস্যরা কবর খুঁড়ে জানাজা শেষে দাফন করছে। বাড়িওয়ালা কিংবা অন্য ভাড়াটিয়া চিকিৎসাকর্মী কিংবা অন্যকোন ফ্রন্ট লাইনারকে বাড়ি ছাড়ার চাপ দিচ্ছে। সেখানেও পুলিশ। ঘরে খাবার নাই, চক্ষুলজ্জার খাতিরে ত্রাণ নিতে পারছে না; গোপনে ত্রান পৌঁছে দিচ্ছে পুলিশ। মূলত হাসপাতালের দরজা থেকে কবরস্থান পর্যন্ত সবখানেই পুলিশ। প্রভু কিংবা শাসক হিসাবে নয়, বন্ধুবেশেই পুলিশ। শতাব্দীর চেনা পুলিশ হঠাৎ করেই লাপাত্তা, কোথা থেকে যেন একদল নতুন পুলিশ। অনেকের কাছেই আবার চেনা চেহারা কিন্তু অচেনা আচরণ; যেন এক অবিশ্বাস্য পরিবর্তন।

লেখাটা কয়েকবার পড়লাম। তিনি ভুল লেখেননি। করোনায় দেশের মানুষ বদলে যাওয়া পুলিশ দেখেছে। বদলে যাওয়া মানুষ দেখেনি। দেশের মানুষ বদলায়নি। অথচ বদলেছে পুলিশ। খুব খুশি হতাম, যদি দেশের মানুষকেও বদলে যেতে দেখতাম। শুধু পুলিশকেই বদলাতে হবে কেন? বরং দেশের মানুষকে, এই আমাদেরকে বদলাতে হবে অনেক বেশি করে। পুরোটাই বদলাতে হবে। আমরা যে কতটা ভয়ংকর রকমের অমানুষ হয়ে আছি, তা আমাদেরকেই অনুধাবন করতে হবে। এবং অনুধাবন করার চমৎকার সময় এই করোনাকাল।

এই সময়ে অনেক শক্ত সামর্থ মানুষকে ভেঙে পড়তে দেখছি। আগে ফোন দিলে কুছ পরোয়া নেহী মনভাবে কথা বলা মানুষের গলার জোর আর আগের মত দেখি না। গলা ঝিমিয়ে এসেছে। জীবনকে পরোয়া করতে তারা এখন উঠেপড়ে লেগেছে। অনেকের মৃত্যু ভয় পেয়ে বসেছে। সারাক্ষণ উদ্বেগ আর আতংকে থাকে। কাকে কখন করোনা ধরবে, কাকে চেংদোলা দিয়ে কাবু করে ফেলবে; এই আতংকে।

সিমেক গ্রুপে লৌহমানবী হিসেবে দু’জনকে জানতাম! শুধু কি জানতাম! একটু একটু মানতামও। মনে মনে মানতাম। তাদের ভয়ে চারপাশ সদা তটস্থ। কথাবার্তা কিংবা হাঁটাচলায় তারা অলওয়েজ ড্যামকেয়ার। তাদের কাছে দিনও যা, রাতও তা। মানে, দুপুর বারোটা যা, রাত বারোটাও তা। আর সর্দি কাশি? সর্দি কাশি ভাল, ডেঙ্গু কিংবা চিকনগুনিয়াও তারা গোণায় ধরতো না। পাশাপাশি হরতাল কিংবা ধর্মঘট? এসব কোন বিষয় হলো! নো এক্সকিউজ। অফিসে আসা লাগবেই। কথা একটাই; নো ফাঁকির চিন্তা। কাজ করেন, কাজ।

বিটলা টাইপের এ দু’জনার মাথায়ও ফাজিল করোনা ঠাডা ফেললো। ঠাডা মানে, গুরুম গারুম ঠাডা। ঠাডায় এই দু’জনাই চুপসে গেল সর্বপ্রথম। বাতাসভরা বেলুনের বাতাস হঠাৎ করে বের হয়ে গেলে যেভাবে পুউউস করে চুপসে যায়, ঠিক সেভাবে চুপসে গেল লৌহমানবী ইশানা আর ফোয়ারা মেম। চিরচেনা ড্যামকেয়ার ভাব ফুট্টুশ। সে কি অবস্থা! ভয়ে কাচুমাচু। ভেজা গলা শুকনো হয়ে গেল। কথা থেমে থেমে আসে; আসলে স্যার যা ভাবছিলাম তা না। ঘটনা বড়ই খারাপ। একটু আগে এপোলো থেকে আসলাম। করোনার রোগীতে ঠাসা।

কঠিন অবস্থা। এটাসেটা বলে ফোন রেখে কোনমতে ঘুমুতে যাবো। সম্ভব না। কথা শেষই হয় না। আতঙ্ক ওদেরকে আস্টেপিষ্টে ধরেছে। যত কথাই বলছে, ঘুরে ফিরে দুটো শব্দ বেশি আসছে; কোয়ারেন্টাইন এবং আইসোলেশন। যত কথাই বলি স্যার! এই দুইটার বিকল্প নাই। অফিস বন্ধ দিয়ে ঘরে ঢুকতে হবে। বাঁচার চেষ্টা আর কি। যদিও বাঁচার কোন পথ আর খোলা আছে বলে মনে হয় না। পথ একটাই; কোয়ারেন্টাইন এবং আইসোলেশন।

করোনার কল্যাণে বহুল প্রচলিত সেই কোয়ারেন্টাইন এবং আইসোলেশন শব্দদুটো বর্তমানে এক রকম হারিয়েই গেছে। হারিয়ে যাচ্ছে আতঙ্কও। আর কত! দিন যায়, দিন আসে। কিন্তু আতঙ্কের সাথে মিল রেখে ছিটেফোঁটা খবরও আসে না। ১৭ কোটি লোকের দেশ বাংলাদেশ। লোকজনে গিজগিজ করে। গায়ে গায়ে লোকের বাস। কেবল বস্তিতেই নয়। ঘরে-বাইরে সব জায়গায় লোক আর লোক। সেই বাংলাদেশে করোনা ঢুকেছে আজ প্রায় তিনমাস। এরপরেও আক্রান্তের সংখ্যা আতঙ্কের তুলনায় অনেক কম। 

শুরুতে সবাই যেভাবে বলাবলি করছিল, তাতে তো আকাশ বাতাস লাশের গন্ধে ভারী হয়ে যাবার কথা। লাশের স্তুপ জমে যাবার কথা। পাড়ায় মহল্লার রাস্তায় সারি সারি লাশ থাকার কথা। কার সাধ্য এসব লুকায়! বুঝলাম সরকার এখনো লুকাচ্ছে। কিন্তু আমরা প্রতিটি মানুষও তো একেকজন তথ্যের ভান্ডার। আমরাও কি লুকাচ্ছি? আমাদের চারপাশ, প্রতিবেশী, কর্মস্থল, চেনাজানা বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় অনাত্মীয়দের সংখ্যাও তো নেহায়েত কম নয়। চারদিকে লাশ পড়লে এখানেও তো পড়ার কথা।

কিন্তু পড়েছে কি? পড়ে নাই। ব্রাহ্মনবাড়িয়ার জানাজায় লাখ লাখ লোকের উপস্থিতি কিংবা দুইবার ফেরী পাড়ি দিয়ে হাজার হাজার লোকজনের গ্রামের বাড়ী আসা যাওয়ার পরেও তো হুহু করে বাড়তে পারতো। বেড়েছে কি হুহু করে? হয়ত একারণেই বাংলার মানুষের বিশ্বাস বদলাতে শুরু করেছে। যত গর্জেছে তত বর্ষাবে না বলে ভাবনাটা বাঙালীর মনে প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। আর ধীরে ধীরে চারপাশ হচ্ছে স্বাভাবিক। ধাপে ধাপে আরো স্বাভাবিক হবে। এক সময় মানুষ পুরোপুরি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। সিমেকিয়ানরা ফিরে আসবে সিমেকের আঙিনায়।

বরাবরই আমি সাহসী মানুষ। সাহস আমার পেটভর্তি। করোনা ফরোনাকে কোনদিন গোণায় ধরিনি। লৌহমানবীদের মত ভয়ও পাইনি। ভয় পাবো কেন? আমি কি ওদের মত দম যায় যায় করা পুতুপুতু টাইপের আধমরা নাকি! করোনার টেনশানে ঘনঘন টয়লেটে যাওয়া আর সারাক্ষণ ঝিমানো ছাড়া আমার কোন প্রবলেমই ছিল না। পেট একআধটু পাতলা হতো। তাতে কি? পেট থাকলে ওটা মাঝেমধ্যে পাতলা হয়ই।

দেখার বিষয় হলো, সেই পাতলা জিনিস ডিসপোজেবল হবার গেইট আছে কি না। গেইট আছে। কথায় আছে না; যার আছে যেমন পেট, তার খোলা তেমন গেইট। গেইট থাকতে সমস্যা কি? যতবার লাগে যাবো! লাগলে ঘরের বাইরেও তো যাই। সেদিনও তো গেলাম। ৮ তলা থেকে গেল ৭৮ দিনে দুইবার নীচে নেমেছি। ভয়ে বেহুশ হয়ে যাইনি। লিফটে উঠেছি কারো দিকে না তাকিয়ে; মাথা নীচু করে। ভয় পেলে নামতাম আমি! নামতাম না!

করোনা একটি জিনিস হলো! পুঁচকে ভাইরাস। শুক্কুরে শুক্কুরে এর বয়স এখনও একবছর হয়নি। একে এত ভয় পাবার কী আছে? ধারে কাছে এসে দেখতো! কাঁচা খেয়ে ফেলতাম! জাপানীজ হলেও কথা ছিল! ব্যাটা চায়নীজ মাল। একে গোণায় ধরে কী করবো? চায়নীজ মাল বেশিদিন লাষ্টিং করে? করে না। করোনারও করার কথা না!!! চলবে...

 

সম্পাদক ও প্রকাশক: সরদার মোঃ শাহীন
উপদেষ্টা সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম সুজন
বার্তা সম্পাদক: ফোয়ারা ইয়াছমিন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: আবু মুসা
সহ: সম্পাদক: মোঃ শামছুজ্জামান

প্রকাশক কর্তৃক সিমেক ফাউন্ডেশন এর পক্ষে
বিএস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড,
ওয়ারী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০ হতে প্রকাশিত।

বানিজ্যিক অফিস: ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
বার্তা বিভাগ: বাড়ি # ৩৩, রোড # ১৫, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
ফোন: ০১৮৯৬০৫৭৯৯৯
Email: simecnews@gmail.com