মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের মাস্টারপ্ল্যান
প্রকাশের সময় : 2021-11-03 13:01:12 | প্রকাশক : Administration
আবু আজাদ: দেশের আমদানি-রফতানির ৯২ ভাগ পরিচালিত হয় চট্টগ্রাম বন্দর ঘিরে। আজ বাংলাদেশের যত সমৃদ্ধি, যত অর্জন সবটুকু চট্টগ্রাম বন্দরের অবদান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই বন্দরের সক্ষমতাও বাড়ানোর চেষ্টা হয়েছে বারবার। কিন্তু কর্ণফুলী নদী ঘিরে গড়ে ওঠা এই বন্দরের সেবা দেয়ার চূড়ান্ত সীমা যেন ফুরিয়ে এসেছে। চট্টগ্রাম বন্দর তার সক্ষমতার শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে।
কিন্তু দেশের অর্থনীতি যেভাবে বিকশিত হচ্ছে, তার সঙ্গে তাল মেলাতে নতুন বন্দরের প্রয়োজন। এর পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম বন্দরের বিকল্প হিসেবে আরও বন্দর গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর ও পতেঙ্গা বে-টার্মিনাল নিয়ে কার্যক্রম চলছে। বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ভারত ও মিয়ানমার ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের প্রায় পুরোটাই সম্পন্ন হয় বঙ্গোপসাগর দিয়ে। দীর্ঘদিন ধরে বঙ্গোপসাগর উপকূলে একটি গভীর সমুদ্রবন্দরের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিল বাংলাদেশ। কিন্তু ভূ-রাজনীতির কারণে তা এতদিন সম্ভব হয়ে ওঠেনি। জাপানি সংবাদপত্র ‘নাইকি’র এশিয়ান রিভিউতে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের প্রকল্প এলাকা ভারত মহাসাগরের উত্তরপ্রান্তে অবস্থিত বঙ্গোপসাগরের সামগ্রিক আয়তন প্রায় ২২ লাখ বর্গকিলোমিটার। শ্রীলঙ্কার উপকূলবর্তী এলাকা ধরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের বাঁক ঘুরে এর বিস্তার থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার মানচিত্র বরাবর দক্ষিণে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা অবধি।
বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ লোক বাস করছে এ উপসাগর ঘিরে থাকা দেশগুলোতে। এছাড়া বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ দুটি অর্থনৈতিক জোটের মেলবন্ধন তৈরি করেছে বঙ্গোপসাগর। মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দরে ৩০০ ও ৪৬০ মিটার দীর্ঘ দুটি টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। আট থেকে ১০ হাজার কনটেইনার পরিবহনের উপযোগী জাহাজ ভেড়ানো যাবে এই বন্দরে।
ফলে বাংলাদেশ ছাড়াও আমাদের প্রতিবেশী যেসব দেশের বন্দর সুবিধা নেই তারাও মাতারবাড়ী বন্দর ব্যবহার করতে পারবে। এছাড়া কলকাতা ও সেভেন সিস্টার খ্যাত ভারতের রাজ্যগুলো এই বন্দর ব্যবহারে দীর্ঘদিন ধরে আগ্রহ দেখাচ্ছে। বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে এ যাবত জাপানের সবচেয়ে বড় উদ্যোগ বিগ-বি-বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট।
এর আওতায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) মাতারবাড়ীতে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কোল জেটি করতে গিয়ে সেখানে একটি বাণিজ্যিক বন্দর নির্মাণের সম্ভাব্যতা দেখতে পায়। মাতারবাড়ী অঞ্চলে সমুদ্রের গভীরতা ১৫.৩ মিটার।
তবে খনন শেষে প্রাথমিকভাবে মাতারবাড়ী চ্যানেলে সারাবছরই ন্যূনতম ১৮ মিটার গভীরতা পাওয়া যাবে। চ্যানেলের বাইরে সাগরের গভীরতা ৩০ মিটার। ফলে এ বন্দরে অনায়াসে বড় আকৃতির মাদার ভেসেল নোঙর করতে পারবে। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরে দুই দেশের মধ্যে বিগ-বি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মাতারবাড়ীতে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
বন্দরের চূড়ান্ত নকশা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে। দুটো স্টেইজে বন্দরের কার্যক্রম শেষ হবে। স্টেইজ-১ ও স্টেইজ-২। স্টেইজ-১ এর আরও দুটি ধাপ থাকবে। প্রথমে একটি কনটেইনার টার্মিনাল ও মাল্টিপারপাস টার্মিনাল দিয়ে কার্যক্রম শুরু হবে। ধারাবাহিকভাবে টার্মিনাল বাড়তে থাকবে। পরিকল্পনা হচ্ছে ২০২৬ সালে মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর দিয়ে এক মিলিয়ন ঘন টিউজ কনটেইনার পরিবহন করা। ২০৩৬ সালে ছয় মিলিয়ন ঘন টিউজ কনটেইনার পরিবহন করতে হবে। ওই সময় মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দরের কোনো বিকল্প থাকবে না। মাতারবাড়ী বন্দর হবে গ্রিন ফিল্ড পোর্ট। এটি হবে একটি আধুনিক বন্দর। এই বন্দরের কনটেইনার টার্মিনালে আট হাজার কনটেইনার নিয়ে জাহাজ আসতে পারবে। আরেকটি মাল্টিপারপাস টার্মিনাল করা হচ্ছে, যেখানে কার্গো ভেসেল এবং কনটেইনারবাহী জাহাজও আসবে।
মাতারবাড়ীতে সমুদ্রবন্দর নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে মোট ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। এই প্রকল্পে ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ টাকার ঋণ দিচ্ছে জাপান। বাকি অর্থের মধ্যে সরকার দিচ্ছে দুই হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ টাকা। পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ দিচ্ছে দুই হাজার ২১৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা। খুবই সহজ শর্তে জাইকা ১২ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে। যা আগামী ২০ বছরের মধ্যে আমাদের পরিশোধ করতে হবে। বাকি অর্থ বাংলাদেশ সরকার ও চট্টগ্রাম বন্দর যৌথভাবে দিচ্ছে। - সূত্র: অনলাইন