সৈয়দ মুজতবা আলী: গল্পের মানুষ
প্রকাশের সময় : 2021-12-16 08:30:28 | প্রকাশক : Administration
জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাশের বাংলা ভাষার অভিধানে ‘কিংবদন্তী’ শব্দটির অর্থ এভাবে দেওয়া হয়েছে: লোক-পরম্পরায় কথিত ও শ্র“ত বিষয়। তাহলে কারও পক্ষে কিংবদন্তীর বিষয়ে পরিণত হতে হলে লোকপরম্পরার একটি দীর্ঘ সময়ক্রম প্রয়োজন। কিন্তু সৈয়দ মুজতবা আলী যে তাঁর জীবদ্দশাতেই কিংবদন্তীর চরিত্রে পরিণত হলেন, সেটি কি প্রকারে? যাঁরা মুজতবা-সাহিত্য পড়েছেন, তাঁদের কাছে উত্তরটি সোজা কিংবদন্তী শব্দের ভেতরে বলার যে বিষয়টি আছে, সেই ‘বলা’ই তাঁকে এই মহিমা দিয়েছে। তিনি বলে গেছেন তাঁর গল্প-উপন্যাস-কাহিনিগুলো, তাঁর মতো করে; মানুষ তাঁকে নিয়ে বলে গেছে তাদের যা বলার তা; এবং এক (লোক) প্রজন্মে তিনি অর্জন করেছেন এক ঈর্ষণীয় উচ্চতা, যে উচ্চতায় কিংবদন্তীর চরিত্রেরা উড়ে বেড়ায়। তাঁর গল্প বলার ভঙ্গি, তাঁর মেজাজ, তাঁর শৈলী, তাঁর ঐশ্বর্য অননুকরণীয়। তিনি পরিশীলিত ভাষার চর্চাকারী, রবীন্দ্রনাথের ভাষা তিনি কণ্ঠে তুলে নিয়েছেন অনেক সাধনায়, তাঁর ছিল ভাষার অহংকারী সব নির্মাণ ও ভাষার লিখিত রূপের মেধাবী প্রকাশ। কিন্তু সেই তিনিই অবলীলায় বিচরণ করতেন কথ্য ভাষার অলিগলিতে, মৌখিক সাহিত্যের পথেপ্রান্তরে। ফলে তাঁর ‘বলা’ ছিল বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।
মুজতবা আলী অনেকগুলো ভাষা জানতেন, কিন্তু ভাষার পাণ্ডিত্য দেখানো ছিল তাঁর প্রবৃত্তির বাইরে। ভাষা শিখে তিনি যা করেছেন; ওই সব ভাষার সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক বয়ানগুলো অভিনিবেশ নিয়ে পড়েছেন। এক ভাষার লেখা সাহিত্যের সঙ্গে অন্য ভাষার সাহিত্যের তুলনা করেছেন; ভাষার প্রাণ ও ভাষার অন্তর্গত গান খুঁজে বেড়িয়েছেন; ভাষার মানুষি আদলটি পরম যতেœ উন্মোচিত করেছেন। চিহ্নিত করেছেন ভাষার ভেতরের শক্তিকে, ভাষার প্রতিরোধ-প্রতিবাদের ক্ষমতাকে।
এ জন্য সেই ১৯৪৮ সাল থেকেই বাংলা ভাষা নিয়ে তাঁর সক্রিয়তা। তাঁকে কেউ ভাষাসংগ্রামী বলে ডাকেনি, ডাকলে সেই অভিধা তাঁকে কিছুটা আমোদই দিত, যেহেতু তিনি বলতেন, যে ভাষায় সংগ্রামের ইন্ধন নেই, প্রাণের প্রাচুর্য আর সুধা নেই, সেই ভাষায় কোমল-মধুর গান গাওয়া যায় কিন্তু জীবনের কথাগুলো বলিষ্ঠভাবে বলা যায় না। বাংলা ভাষার ‘আঞ্চলিক-লৌকিক-প্রমিত-পরলৌকিক’ সব রূপ দেখেছেন বলে তিনি গর্ব করতেন (পরলৌকিক? হ্যাঁ, তিনি বলতেন, পরকালের কথা বয়ান করতে গিয়ে ধর্মপ্রাণ মানুষ নিজের ভাষার ওপর একটুখানি গোলাপজল না হয় গঙ্গাজল ছিটিয়ে পরিশ্র“ত করে নেয়)। সেই বাংলার মর্যাদার প্রশ্নে তিনি লড়লেন, পাকিস্তানিদের চক্ষুশূল হলেন ও দেশান্তরে গেলেন! আঞ্চলিকতা নিয়েও যথেষ্ট অভিমান ছিল মুজতবা আলীর। তিনি আজীবন সিলেট-সমর্পিত মানুষ ছিলেন। আমাদের সঙ্গে যখন কথা বলতেন, যে সিলেটি ব্যবহার করতেন তার তুলনা অন্য কারও চর্চায় আমি পাইনি। তিনি বলতেন, তাঁর ভাষাটি ছিল ন্যাপথলিনের যতেœ সুরক্ষিত তোরঙ্গে তোলা সিলেটি, যেহেতু এর ব্যবহার প্রতিদিন তাঁকে করতে হতো না। কিন্তু মনেপ্রাণে তিনি ছিলেন বৈশ্বিক।
মুজতবা আলীর লেখালেখিতে রম্য ও রসের যে উপস্থিতি, তা কখনো মাত্রাতিরিক্ত নয়। কোন কথায়, কতটা কথায়, কোন প্যাঁচে কে কতটা হাসবে এবং হাসতে হাসতে ভাববে, নিজেকে মাপবে, সেই রসায়ন তিনি জানতেন। তাঁর এই পরিমিতিবোধ ছিল অসামান্য। তিনি বলতেন, মোনালিসা যে এত অবিস্মরণীয় এক চিত্রকর্ম, তার পেছনে দা ভিঞ্চির আঁকিয়ে-হাতের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না তাঁর পরিমিতিবোধ। ব্রাশের একটা অতিরিক্ত সঞ্চালন ছবিটির রহস্য কেড়ে নিত। একজন রম্যলেখকেরও থাকতে হবে সেই জ্ঞান, তালে-ঠিক কোনো মদ্যপায়ীর মতো, ঝানু জুয়াড়ির মতো।
বাংলা সাহিত্যে মুজতবা আলীর পাকাপোক্ত স্থান রম্যলেখক হিসেবে। কিন্তু এটিই তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়। মুজতবা-গবেষক নূরুর রহমান খান (মুজতবা-সাহিত্যের রূপবৈচিত্র্য ও রচনাশৈলী, ঢাকা ২০১০) সেগুলোকে শ্রেণিবদ্ধ করেছেন এভাবে: ক. হাস্যরস-প্রধান গল্প, খ. করুণ রসাত্মক গল্প, গ. বিশেষ উদ্দেশ্যমূলক গল্প, ঘ. প্রণয়মুখ্য গল্প, ঙ. অম্লমধুর গল্প, চ. ভয়ংকর রসের গল্প। ভয়ংকর রসের গল্প অবশ্য মাত্র একটি, ‘রাক্ষসী’, যেখানে এক বৃদ্ধার মৃতদেহের বর্ণনা সত্যিই ভয়ংকর। মুজতবা আলীর গল্পগুলোর কাহিনি ও বিস্তার এবং এদের অন্তর্গত জগৎটি বিচিত্র। এই বৈচিত্র্যের একটি কারণ তাঁর ঋদ্ধ অভিজ্ঞতা। নানা দেশে গিয়েছেন তিনি, অদ্ভুত সব অভিজ্ঞতার সামনাসামনি হয়েছেন, বিচিত্র সব মানুষজন দেখেছেন, শুনেছেন তাদের গল্প। ফলে তাঁর সাহিত্যের জগৎ হয়েছে বহু স্তরে বিন্যস্ত, বহু রেখায় নির্ণিত। আমাদের সীমিত অভিজ্ঞতার কম্পাস সে জগতের হদিস করতে পারে না। - সূত্র: অনলাইন