প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয়! প্রাণের ক্যাম্পাস!
প্রকাশের সময় : 2021-12-16 08:31:33 | প্রকাশক : Administration
আর রাজী: আমাদের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা যার যার বিশ্ববিদ্যালয় ও ক্যাম্পাসকে “প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয়” ও/বা “প্রাণের ক্যাম্পাস” সম্বোধন করেন। এই “প্রাণের ক্যাম্পাস” বলতে তারা সম্ভবত যা বুঝাতে চান তার মধ্যে আছে বিভিন্ন ভবন, পথঘাট, জলা-জঙ্গল, টেন্ট-ঝুপড়ি-টিস্টল, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন, দোকানদার-অফিস স্টাফ, হয়তো শ্রেণীকক্ষও।
কিন্তু শিক্ষকরা কি আছেন, এই প্রাণের ক্যাম্পাসে বা প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয়ে? কবর-ফলকের মতো যাদের নাম যুগের পর যুগ ঝুলতে থাকে বিভিন্ন কক্ষের দেয়ালে, দরজার ওপরে- সেই শিক্ষকরা কি এই প্রাণের ক্যাম্পাসের অংশ? নানান উপলক্ষ্য আয়োজনে ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষার্থীদের আবেগ থর থর লিখা দেখি। স্মৃতিচারণ দেখি, “প্রাণের ক্যাম্পাস” নিয়ে। খুব খুব কম তাতে শিক্ষকদের কথা থাকে।
নিজের ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে যেসব সাবেকরা আসেন, তারা নানান স্থাপনার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলেন, বর্তমান শিক্ষার্থীদের সাথেও ছবি তুলে ফেসবুকে শেয়ার করেন। কালেভদ্রে শিক্ষকদের সাথেও তাদের কারও কারও ছবি দেখা যায় বটে কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওই শিক্ষকরা মিডিয়ার কারণে সেলিব্রেটি কিংবা ক্ষমতাসীন, নইলে ওই ছবিতে তাদের স্থান হতো কি না সন্দেহ। খুবই কম দেখি শিক্ষার্থীরা তাদের ক্যাম্পাসের মূল কর্মকাণ্ড পড়াশোনা নিয়ে কথা বলছেন বা কে কেমন পড়াতেন এসব স্মরণ করছেন। কালেভদ্রে যদি কোনো শিক্ষকের কোনো অবদানের কথা তারা উল্লে−খ করে স্মরণ করেন, অবাক হয়ে দেখি ওই শিক্ষক আসলে বে-আইনি, বিধিবহির্ভূত আলগা কোনো সুবিধা করে দিয়েছিলেন, যাকে বেচারা “শিক্ষকের মহত্ত্ব” বলে ধরে নিয়েছেন। এর বাইরে শিক্ষকরা নাই!
ব্যাপারটা কি এমন যে, ইউনিভার্সিটির শিক্ষকরা কোনো ছাপই রাখেন না শিক্ষার্থীদের মনে? কিংবা পাঠদান বা পাঠকক্ষের বিষয়টি নিয়ে আমাদের সাবেকরা কিছুই স্মরণ করতে পারেন না? পড়ালেখাহীন ক্যাম্পাস আমাদের কাছে কীভাবে “প্রাণের ক্যাম্পাস” হয়ে উঠে? আসলেই কি এটা আমাদের প্রাণের ক্যাম্পাস/প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয়? না কি কেবল বলার জন্য বলা?
না কি ইউনিভার্সিটিতে যে আমরা একদা পড়েছিলাম তার কোনো লক্ষণই আমাদের আচার-আচরণে প্রকাশ পায় না বলে সামাজিক স্বীকৃতির একটা সঙ্কটে ভুগি আমরা- আর তাই ফেসবুকে নানান উপলক্ষ্যে স্মরণ করিয়ে দেই যে আমাদের একটা “প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয়” আছে!
শিক্ষকদের স্মৃতির অন্তরালে রেখে যে ক্যাম্পাসটা প্রাণের ক্যাম্পাস হয়ে উঠেছে সেখানে আমরা কখনো সখনো যাই- আহ্লাদ করি। আড্ডা দেই। ছবিটবি তুলি কিন্তু এই প্রাণের সেবায় কি কোনো দিন কিছু নিয়ে আসি? শিক্ষকদের কথা নাই বা বলি, আমি দেখিনি যে প্রাণের ছোটভাইবোনদের জন্য আমরা কোনো উপহার নিয়ে যাচ্ছি, প্রাণের বিভাগের জন্য কাজের কিছু কিংবা কেনা দুইটা বই নিয়ে যাচ্ছি, বিভাগের তহবিলে কোনো অর্থ দিচ্ছি খুব কমই এমন ঘটে।
তবে মাস্তির জন্য পয়সা আমরা খরচ করি বটে। ব্যতিক্রম আছে, খুব অনুল্লেখযোগ্য সে ব্যতিক্রম। সাধারণভাবে, প্রাণের প্রতি মায়া প্রকাশের কোনো আয়োজন নাই। প্রাণের দাবি মেটানোর কোনো চিন্তা নাই। কেবল যাওয়া আর আসা, আর ফেসবুকে লেখা- প্রাণের ক্যাম্পাস!
স্মৃতিপটে শিক্ষকহীন যে ক্যাম্পাস, তা কেমন করে প্রাণের ক্যাম্পাস হয়ে ওঠে? আমি বুঝতে চেষ্টা করি। এর মধ্যে নিশ্চয়ই আকলমন্দদের জন্য ইশারা রয়েছে। সেই ইশারা ধরার চেষ্টা করি। বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করি, আমাদের সময়ের শিক্ষার্থীদের আবেগময় ভালবাসার প্রকাশ হিসেবে কোনো শিক্ষকের নামে সাধারণে কিচ্ছু নাই! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বরং চা-বিক্রেতা হাকিমভাইয়ের স্মরণে হয়েছে, হাকিম-চত্ত্বর!
শিক্ষক- শিক্ষা- অব্যবস্থাপনা, অবিচার- অনিয়ম- দুর্যোগের স্মৃতিহীন যে “প্রাণের ক্যাম্পাস” শিক্ষিত- বাঙালী তার মানসলোকে নির্মাণ করেছে তার প্রাণ আসলে কোথায়? কেউ বলতে পারবেন? সম্মানিত শিক্ষক মহোদয়গণ, আপনারা কি লক্ষ্য করেছেন, আপনাদের শিক্ষার্থীদের মনোলোকে স্থান করে নিতে আপনারা ব্যর্থ হয়েছেন!