বিনা পারিশ্রমিকে সহস্র কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট

প্রকাশের সময় : 2021-12-16 08:49:52 | প্রকাশক : Administration
বিনা পারিশ্রমিকে সহস্র কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট

অধ্যাপক ডাঃ আব্দুল হানিফ টাবলু: আমাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ব্যাচ কে-৪০-এর ফার্স্ট বয় কামরুল, প্রফেসর ডাঃ কামরুল ইসলাম। স্বাধীনতাযুদ্ধে শহিদ পাকশী ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউটের অ্যাগ্রোনমিস্ট বাবা আমিনুল ইসলামের চার ছেলের মধ্যে ২য় কামরুল। চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ পাকশী থেকে ১৯৮০ সালে এসএসসিতে মেধা তালিকায় ১৫তম স্থান অর্জন করে পাশ করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হয় এবং এইচএসসি পরীক্ষায় ১০ম স্থান অর্জন করে। ১৯৮২ সালে তখনকার আটটি মেডিক্যাল কলেজের সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় ১ম স্থান অর্জন করে।

১৯৮৩ সালের ৬ই এপ্রিল আমরা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে একসঙ্গে ক্লাস শুরু করি। তার বাবার অপরাধ ছিল মুক্তিযোদ্ধারা তাদের বাসায় রাতে মিলিত হতেন। ফলে এক রাতে বিহারি ও রাজাকারেরা এসে তার বাবাকে হত্যা করে। তার শহিদ বাবার সম্মানে স্বাধীনতার পর ঈশ্বরদীর সেই এলাকার নামকরণ করা হয় আমিনপাড়া। স্বামীহারা এসএসসি পাশ মা চার ছেলেদের মানুষ করার জন্য ও নিজের পায়ে দাঁড়াবার জন্য আবার পড়াশোনা শুরু করেন। এবং এইচএসসি পাশ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এবং সমাজবিজ্ঞানে ১ম স্থান অধিকার করে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮১ সালে খালাম্মা অধ্যাপিকা রহিমা খাতুন লালমাটিয়া মহিলা কলেজে যোগদান করেন।

আমরা ঢাকা মেডিক্যাল থেকে ১৯৮৯ সালে পাশ করে ইন্টার্নশিপ শেষ করি ১৯৯০-এ এবং পরবর্তী সময়ে একাদশ বিসিএসে ১৯৯৩ সালের ১লা এপ্রিল স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগদান করি। কামরুল পরবর্তী সময়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ট্রেনিং পদে যোগ দেয় এবং সার্জারিতে এফসিপিএস সম্পন্ন করে ১৯৯৫ সালে। এফসিপিএস পাশ করে কামরুল ইউরোলজির ট্রেনিং পদে যোগদান করে তৎকালীন আইপিজিএমআর বা পিজি হাসপাতালে, যা ১৯৯৮ এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। এফসিপিএস করা থাকায় সেখানে কামরুল এম এস ইউরোলজি তৃতীয় পর্বে ভর্তি হয় এবং ২০০০ সালে এমএস সম্পন্ন করে। পরবর্তী সময়ে এডিনবরা থেকে এফআরসিএস পাশ করে ২০০৩ সালে। ওরাই শেষ ব্যাচ, যাদের এফসিপিএস করা থাকলে ডাইরেক্ট এফআরসিএস পরীক্ষা দিতে পারত।

ইউরোলজিতে এমএস প্রোগ্রাম সম্পন্ন করে কামরুল জাতীয় কিডনি ও ইউরোলজি (ঘওকউট) হাসপাতালে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করে ২০০১ সালে। ২০০৭ সালে সফলভাবে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট শুরু করে। পরবর্তী সময়ে আমাদের বন্ধু কামরুল সরকারি হাসপাতালে কাজের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে ২০১১ সালে সরকারি চাকরি থেকে পদত্যাগ করে এবং শ্যামলীতে স্বল্প মূল্যে কিডনি রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য নিজস্ব কিডনি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজ অ্যান্ড ইউরোলজি।

কামরুল ইউরোলজি ও কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টের ওপর ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজ, আহমেদাবাদে ট্রেনিং করে এবং মুলি ভাই প্যাটেল কিডনি ও ইউরোলজি সেন্টার, গুজরাট থেকেও প্রশিক্ষণ নেয়। কিন্তু একজন সহকারী অধ্যাপকের কিডনি ট্রান্সপ্ল−্যান্ট দূরে থাক, সাধারণ অপারেশন করতেও অনেক ঝক্কি পোহাতে হতে পারে। অধ্যাপকের অনুমতির ও কনফিডেন্স অর্জনের বিষয় আছে! বন্ধু কামরুল গাড়ি কেনার জন্য ১৩ লাখ টাকা জমিয়ে ছিল। অনেকেই তখন প্রবক্স কিনছিল; সেও কিনতে চেয়েছিল কিন্তু তা না কিনে আড়াই লাখ টাকায় একটা পুরোনো স্টেশন ওয়াগন কিনে এবং ১০ লাখ টাকা দিয়ে দুইটা রিফারবিশড ডায়ালাইসিস মেশিন কেনে। আমেরিকা প্রবাসী মামা বন্ধুদের সহযোগিতায় আরো দুইটা ডায়ালাইসিস মেশিনের টাকা পাঠান। এই চারটা ডায়ালাইসিস মেশিন কিনে কামরুল ২০০৫ সালে মোহাম্মদপুরের আল মারকাজুল হাসপাতালের পাশে ডায়ালাইসিস সেন্টার চালু করে। পরবর্তী সময়ে প্রায় ৩০ জন কিডনি রোগী নিয়মিত ডায়ালাইসিস নিতে থাকেন।

এদের মধ্যে একজন লতা খান, যার স্বামী স্কুটার চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন, রোগের জন্য কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টের প্রয়োজন হয়। মা মেয়ের জন্য একটি কিডনি দিতে চান। কিন্তু ট্রান্সপ্ল−্যান্ট করার খরচ তো অনেক। কামরুল তখন তৎকালীন বিএসএমএমইউয়ের ইউরোলজি প্রধান অধ্যাপক এস এ খান সার ও করাচির সিন্ধ ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজি অ্যান্ড ট্রান্সপ্ল্যান্ট (ঝওটঞ) থেকে সাত বছর প্রশিক্ষণ নিয়ে ও ইউরোলজিতে এমএস করে আসা ডাক্তার আরিফকে নিয়ে লতার কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টের প্রস্তুতি শুরু করে। পরে এস এ খান স্যার আমাকে বললেন, ‘আমি শুধু দাঁড়িয়ে ছিলাম; কামরুলই সব করেছে!’

কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট এবং অপারেশনের জন্য আইসিইউ ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট প্রয়োজন হলে ইস্ট ওয়েস্ট মেডিক্যাল কলেজের ডাঃ মোয়াজ্জেম ভাই তার প্রতিষ্ঠানের জন্য জাপান থেকে আনা দুইটা কার্ডিয়াক মনিটর স্বল্পমূল্যে কামরুলকে দেন। ২০০৭ সেপ্টেম্বর মাসে লতার কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট সম্পন্ন হয় সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে। মা ও মেয়ে সুস্থ হয়ে ওঠেন। এখন সমস্যা দেখা দেয় লতার ওষুধ কেনার পয়সা নিয়ে। ট্রান্সপ্ল্যান্ট অপারেশনের পর কিছু ওষুধ নিয়মিত খেতে হয়! আবারও আমাদের বন্ধু কামরুল এগিয়ে এলো। পরে লতাকে ডায়ালাইসিস করতে আসা মহিলা রোগীদের সেবার কাজে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর লতা প্রায় ৯ বছর বেঁচে ছিলেন। সেই যাত্রা শুরু এবং এরপরে শুধু মানুষের ভালোবাসায় এগিয়ে যাওয়া।

কামরুল তার শহিদ বাবার সম্মানে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করার জন্য কোনো পারিশ্রমিক নেয় না। পাশের দেশেও যেখানে ২৫-৩০ লাখ টাকা খরচ হয় সেখানে কামরুলের হাসপাতালে খরচ মাত্র ২ লাখ ১০ হাজার টাকা! সে বাদে তার ১২ সদস্যের টিমের সদস্যদের আর ওষুধপত্র ও অপারেশনের আনুষঙ্গিক খরচ, থাকা-খাওয়া!

ওর হাসপাতালের ২২ বেডের ডায়ালাইসিস ইউনিটে ডায়ালাইসিসের খরচ মাত্র ১ হাজার ৫০০ টাকা, আইসিইউ বেডের খরচ ৭ হাজার থেকে ৯ হাজার টাকা! আমাদের সদা হাস্যময় অসম্ভব বিনয়ী বন্ধু কামরুলকে তার মা, ভাই, স্ত্রী, তিন কন্যাসহ পরম করুণাময় ভালো রাখুন, সুস্থ রাখুন, দীর্ঘদিন মানুষের সেবা দেওয়ার সুযোগ দিন। নিশ্চয় জাতি নিভৃতচারী এই গুণী শিক্ষক ও সার্জনকেও যথোপযুক্ত সম্মান জানাতে কার্পণ্য করবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস।

লেখক: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ

 

সম্পাদক ও প্রকাশক: সরদার মোঃ শাহীন
উপদেষ্টা সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম সুজন
বার্তা সম্পাদক: ফোয়ারা ইয়াছমিন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: আবু মুসা
সহ: সম্পাদক: মোঃ শামছুজ্জামান

প্রকাশক কর্তৃক সিমেক ফাউন্ডেশন এর পক্ষে
বিএস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড,
ওয়ারী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০ হতে প্রকাশিত।

বানিজ্যিক অফিস: ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
বার্তা বিভাগ: বাড়ি # ৩৩, রোড # ১৫, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
ফোন: ০১৮৯৬০৫৭৯৯৯
Email: simecnews@gmail.com